Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মিয়ানমার জান্তাপ্রধানের সরকারপ্রধান হওয়ার নেপথ্যে

Icon

তন্ময় চৌধুরী

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মিয়ানমার জান্তাপ্রধানের সরকারপ্রধান হওয়ার নেপথ্যে

১ ফেরুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং লাইং আসিয়ান সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং দ্বিতীয় সফর হিসাবে ২১ জুন রাশিয়া সফর করেন।

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক মস্কো সম্মেলনে (২২-২৪ জুন) অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান নিকোলাই পেত্রোশেভ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্গেই শুইগো এবং অস্ত্র রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান আলেক্সান্দার মিকিভের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।

ওই সফরে তাকে রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী ‘লবণযুক্ত রুটির খাবার’ দিয়ে বরণ করা হয়নি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করতে পারেননি। তাছাড়া রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা ‘তাস’ তাকে রাষ্ট্রের প্রধান না বলে ‘সামরিক বাহিনীর প্রধান’ হিসাবে খবর প্রচার করে। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র রাশিয়া সফরের এমন অসম্মানজনক পর্বই মিন অং লাইংকে জান্তাপ্রধান থেকে সরকারপ্রধান হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

১ আগস্ট তিনি ক্ষমতাশালী ‘স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল’কে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারে’ রূপান্তরিত করে নিজেকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদে আখ্যায়িত করেন। তাছাড়া ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখলের কয়েকদিন পর সামরিক জান্তা যে এক বছরের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল, তা তারা আড়াই বছর পর্যন্ত বাড়িয়েছে। যদিও তাদেরই প্রণীত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কোনো বিধান নেই। এটি আসলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কুকর্মের ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তি, যা মনে করিয়ে দেয় ১৯৫৮ সালের ঘটনা, যখন তারা সবকিছু বাতিল করে নতুন সরকার গঠন করে।

কালক্ষেপণের মাধ্যমে ক্ষমতা স্থানান্তরের একটি রোডম্যাপ হিসাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সামরিক পরিষদকে বেসামরিক প্রশাসনে উন্নীত করল। তারা সাময়িক সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকার কথা বলে জনগণকে তাদের শাসনের অধীনে নতুন নিয়মের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চায়। এর মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে নিজেদের বৈধ সরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে। নিজেদের বেসামরিক সরকারে পরিবর্তন করার আরেকটি কারণ হলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করা।

প্রায় ৮২ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে অং সান সু চির দল এনএলডি ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করলেও সামরিক বাহিনী ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় এবং পরে গণতন্ত্রপন্থি দলের নেতাদের আটকপূর্বক নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ গড়ে উঠলে গণআন্দোলনকারী প্রায় ৯৫০ জন সাধারণ নাগরিককে হত্যা করে সামরিক বাহিনী এবং সামরিক শাসনবিরোধী প্রায় ৬ হাজার নাগরিককে গ্রেফতার করে। মিয়ানমারের সর্বস্তরের মানুষের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও হত্যা, হুমকি ও নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রেখেছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও জঘন্য সামরিক বাহিনী। রাশিয়া ও চীন ছাড়া বিশ্বের অন্য দেশগুলো মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে সরাসরি সমর্থন প্রদান করেনি। তাই উল্লেখিত দেশ দুটির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং প্রতিবেশী কিছু রাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের চেষ্টা চালাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।

১৮ জুন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমারে ‘অস্ত্রপ্রবাহ রোধ’ বিষয়ক একটি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরপর দেশটির জান্তাপ্রধানের রাশিয়া সফরটি ছিল অভূতপূর্ণ ঘটনা। ওই প্রস্তাবে শুধু বেলারুশ রেজুলেশনের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল; অন্যদিকে চীন, রাশিয়া এবং অন্য ৩৪টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের ঐতিহাসিক সামরিক সম্পর্ক সামরিক অভ্যুত্থানের পর আরও সুদৃঢ় হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী মার্চ মাসে বিদেশি কোনো কর্মকর্তার প্রথম উচ্চপর্যায়ের সফর হিসাবে রাশিয়ার উপ-প্রতিরক্ষা সচিব আলেক্সান্দার ফোমিনের মিয়ানমার সফর, জুন মাসে মিয়ানমার বিমান বাহিনীর প্রধান কমান্ডার মং মং কিউয়ের নেতৃত্বে একটি সামরিক প্রতিনিধিদলের মস্কো সফর, জুন মাসেই মিয়ানমারে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ড. নিকোলাই লিস্তোপাদভ এবং মিয়ানমারের সামরিক সরকার নিযুক্ত শিল্পমন্ত্রী ড. চার্লি থানের মধ্যে ওষুধ উৎপাদন এবং রাবার ও পোশাক উৎপাদনে সহযোগিতাসহ শান রাজ্যে একটি নিষ্ক্রিয় ইস্পাত কারখানায় আবার কাজ শুরু করার বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার মতো ঘটনাগুলো প্রমাণ করে কিভাবে রাশিয়া মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যদিও রাশিয়া ও মিয়ানমারের মধ্যে সামগ্রিক বাণিজ্য সর্বনিু পর্যায়ে রয়ে গেছে, তদুপরি দেশ দুটি সম্প্রতি তাদের সামরিক সহযোগিতা গভীর করেছে এবং রাশিয়া এখন চীনের পর মিয়ানমারে দুই নম্বর সামরিক রপ্তানিকারক দেশ।

২০ জুলাই রাশিয়ার বার্ষিক MAKS এয়ার শোতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আলেক্সান্দার মিকিভ বলেন, মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রোজোবোরোনেক্সপোর্টের (রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) অন্যতম প্রধান গ্রাহক এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা সংস্থা রোস্টেকের প্রধান অংশীদার। SIPRI’র তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার কাছ থেকে আনুমানিক ১.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক হার্ডওয়্যার কিনেছে মিয়ানমার, যা তার মোট অস্ত্র আমদানির ৩৯ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া মিয়ানমারের জান্তাকে অস্ত্র বিক্রিসহ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, বিভিন্ন ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং হাজার হাজার সৈন্যকে রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বৃত্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কাছে অস্ত্র বিক্রির অনুমতি দেওয়ার জন্য নিন্দা জানিয়েছে; কারণ আমদানিকৃত অস্ত্র জনসাধারণের আন্দোলন দমাতেই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাশিয়া সফরে মিয়ানমার জান্তাপ্রধানের বেশ খানিকটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হলেও দেশ দুটি এখন একে অন্যের পরিপূরক হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বাধার কারণে রাশিয়ার উৎপাদিত অস্ত্র মিয়ানমারে বিক্রির মাধ্যমে নতুনভাবে অস্ত্র বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি, অন্যদিকে রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই তাদের স্ব স্ব অপরিহার্য লক্ষ্য বলে মনে করা হয়। রোহিঙ্গা গণহত্যা পরবর্তী মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনীত জাতিসংঘের সব প্রস্তাবে রাশিয়া ভেটোদানের মাধ্যমে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করার কারণে মিয়ানমার চীনের মতো রাশিয়াকেও ‘ঐশ্বরিক দেবতা’ মনে করে। তাই রাশিয়া সফরের খানিকটা অপমানবোধ হয়তো মিন অং লাইংকে এ শিক্ষাই দিয়েছিল যে, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান হওয়ার মাধ্যমেই রাশিয়া ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বার্থগত সম্পর্ক বজায় থাকবে এবং তা ভবিষ্যতেও বিশ্বের সব জায়গায় সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হবে।

তন্ময় চৌধুরী : লেখক ও গবেষক

ctonmoy555@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম