শতফুল ফুটতে দাও
যুদ্ধবিগ্রহের পর এবার কি শান্তি?
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![যুদ্ধবিগ্রহের পর এবার কি শান্তি?](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2021/08/19/image-455410-1629324082.jpg)
১৯৭৮ সালে ‘সাউর বিপ্লবের’ ফলে কমিউনিস্টরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিচয় নির্ধারিত হলো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী আফগানিস্তান।
সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুন এ শাসকদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। এক পর্যায়ে আফগানিস্তানের নতুন শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক হস্তক্ষেপ করে। আফগানিস্তানের জনগণ সোভিয়েত হস্তক্ষেপকে সামরিক আগ্রাসন হিসাবে চিহ্নিত করে।
এর ফলে আফগানিস্তানে এক ধরনের সোভিয়েতবিরোধী জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হয়। মার্কসবাদী শাসকরা ধর্মীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এ সময় ইরানে ইসলামিক বিপ্লব সাফল্য অর্জন করে। ইরান থেকে জঙ্গি ইসলামিক ব্যবস্থা আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠার জন্য গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে।
হিরাট প্রদেশে শিয়া মুসলমানরা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। ফলে সেখানে ইরানি বিপ্লবের চিন্তাভাবনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানের তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকার চিরায়ত ঐতিহ্য এবং ইসলামি জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে।
১৯৭৯ সালে হিরাটে একটি অভ্যুত্থানের সূচনা হয়। এ অভ্যুত্থান ছিল মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষার ঘোষণার প্রতিবাদে। এ ঘোষণার ফলে আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামগুলোতে অভ্যুত্থানের সূচনা হয়। এর ফলে মুজাহিদদের বৃহত্তর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। মার্কিন সিআইএ পাকিস্তানের মাধ্যমে এ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পক্ষে সমর্থন জানায়।
পাকিস্তানে তখন সামরিক শাসক মুহাম্মদ জিয়াউল হকের শাসন চলছিল। জিয়াউল হক বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিকভাবে ইসলামকে উৎসাহিত করতে হবে। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন ধর্মীয় আদর্শ একটি দেশের জন্য শক্তির উৎস। পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকায় মাদ্রাসায় অর্থাৎ ইসলামিক ধর্মীয় স্কুল গড়ে তোলার জন্য তিনি সমর্থন প্রদান করেন।
জিয়াউল হকের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে জিহাদ একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। জিয়াউল হক জিদ ধরলেন, মুজাহিদদের প্রতি সিআইএর সমর্থন পাকিস্তানের মাধ্যমে হতে হবে। এ সমর্থন ও সহযোগিতা দেখভালের কাজ করল পাকিস্তানের আইএসআই।
১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে ক্ষমতার শূন্যতা দেখা দেয়। বিভিন্ন মুজাহিদ গ্রুপ একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ফলে আফগানিস্তান টুকরো টুকরো হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়।
এমতাবস্থার মধ্যে আইএসআই-এর জন্য বিরাট একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। আইএসআই প্রায় অপরিচিত কান্দাহারকেন্দ্রিক একটি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করে। এরাই হলো পরবর্তীকালের তালেবান। পাকিস্তান এদেরকে মিত্র হিসাবে বেছে নিল। লক্ষ ছিল ৯০-এর দশকে এরা সমগ্র আফগানিস্তান দখল করে নেবে।
হেলমন্ত, কান্দাহার এবং উজুরগান অঞ্চলে তালেবানদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। জাতিসত্ত্বা হিসাবে এদের প্রায় সবাই পস্তুন জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত ছিল। আবার এদের মধ্যে দুররানী পস্তুনরা বেশ প্রাধান্যে ছিল। তালেবানরা আফগানদের কাছ থেকে বড় ধরনের সমর্থন পেল। কারণ আফগানরা মুজাহিদদের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ফলে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল।
কান্দাহারগামী একটি পরিবারের পুরুষ ও মেয়ে সন্তানদের ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। এ ধরনের আরও অনেক ঘটনা তখন আফগানিস্তানে ঘটত। মুহাম্মদ ওমর, যিনি পরবর্তীকালে মোল্লা ওমর নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, তিনি এবং তার ছাত্ররা প্রতিজ্ঞা করলেন তারা আফগানিস্তান থেকে এসব অপরাধীকে উচ্ছেদ করবেন। পাকিস্তানের মধ্য দিয়েই আফগানিস্তানের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য চলত। কারণ আফগানিস্তান একটি ভূ-বদ্ধ রাষ্ট্র।
পাকিস্তানভিত্তিক ট্রাক যানবাহনের মাফিয়া হিসাবে যারা পরিচিত ছিল, আফগানিস্তান-ট্রানজিট ট্রেড নামে তারা এবং পাকিস্তান সরকারের মধ্যে তাদের মিত্ররা তালেবানদের অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে। আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক মধ্য এশিয়ার সংযোগ সড়কের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এ সড়কে দস্যুদল বিশাল অঙ্কের চাঁদাবাজি করত।
পাকিস্তান সরকার তালেবানদের এসব চাঁদাবাজদের কাছ থেকে আলোচ্য সড়কটি নিরাপদ করার জন্য অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে। তালেবানদের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা পাকিস্তানে দারুল উলুম হাক্কানিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করত। মোল্লা ওমরও এ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। এ মাদ্রাসার পক্ষ থেকেও তালেবানদের প্রতি সমর্থন প্রদান করা হয়। মাদ্রাসাটি পরিচালনা করতেন জামিয়াতে উলামা-ই-ইসলামের মাওলানা সামিউল হক। তাকে তালেবানের পিতা হিসাবে গণ্য করা হয়।
১৯৭৯তে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ইসলামিক মুজাহিদরা লড়াই শুরু করে দেয়। এখন পর্যন্ত তালেবান অথবা আল কায়দা সিআইএর সমর্থনপুষ্ট হওয়ার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে অনেকেই মনে করেন, সিআইএ এবং আইএসআই আফগানিস্তানের মাটিতে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তালেবানদের সহায়তা দিয়েছে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক আহমদ রশিদ বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের মাধ্যমে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তালেবানদের সমর্থন জুগিয়েছে। কারণ ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে তালেবানদের ইরানবিরোধী, শিয়াবিরোধী এবং পাশ্চাত্যপন্থি মনে করা হতো। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ১৯৯৫ সালে তালেবানরা যখন হিরাট দখল করল তখন ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
তালেবানরা হাজার হাজার মেয়েকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এ সময় রবিন রাফেল, যিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়াভিত্তিক অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট তালেবানদের সঙ্গে কাজ করার জন্য কড়া সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তিনি ইউনিকলের পাইপ লাইন প্রজেক্টের প্রতিও আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সফরের সময় জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি মোল্লা ওমরসহ বেশ ক’জন তালেবান নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন।
তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তালেবানের সঙ্গে কাজ করার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। এ সমর্থন এসেছিল তালেবান কর্তৃক কাবুল দখলের পর। তিনি তালেবানদের সঙ্গে কাজ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তালেবানরা কাবুল দখল করলে তিনি একে একটি পজিটিভ স্টেপ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় তাকে লেডি তালেবান হিসাবে উল্লেখ করা হতো।
তালেবানদের সামরিক তৎপরতা শুরু হয়েছিল ১৯৯৪-এর অক্টোবর-নভেম্বরে। ওই সময় তারা মাইওয়ান্দ থেকে কান্দাহারে মার্চ করেছিল এবং আশপাশের প্রদেশগুলোও দখল করে নেয়। এ অভিযানে তাদের কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়। তারা বর্ডার ক্রসিক দখল করে নেয় এবং যুদ্ধবাজ নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের বিশাল অস্ত্রের ভাণ্ডারও দখল করে নেয়।
তারা পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য সড়কটিও মুক্ত করে। পরবর্তী তিন মাসে এ অপরিচিত শক্তিটি আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ১২টি প্রদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। মুজাহিদ যুদ্ধবাজরা প্রায়ই বিনা যুদ্ধে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করত। ১৯৯৬-এর সেপ্টেম্বরে তারা কাবুল দখল করে।
তালেবান শাসনে শরিয়া আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যাপক সংখ্যক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, নারীদের শিক্ষা ও ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, ভিডিও, গানবাজনা, নৃত্য, বাসগৃহে ছবি দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা, ক্রীড়া অনুষ্ঠানে হাততালি দেওয়া, ঘুড়ি উড়ানো এবং দাড়ি ছেঁটে ছোট করা ইত্যাদি। পুরুষ মানুষদের থুতনি থেকে এক মুঠ পর্যন্ত দাড়ি রাখার বাধ্যবাধকতা চালু করা হলো।
এর পাশাপাশি মাথার চুল ছোট রাখারও নির্দেশ দেওয়া হলো। পুরুষ মানুষদের মাথায় আচ্ছাদন ব্যবহার করতে হতো। ড্রয়িং পেইন্টিং অথবা ফটোর মাধ্যমে জীবন্ত প্রাণীর ছবি রাখাও নিষিদ্ধ করা হলো। এসব নির্দেশ জারি করেছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। ধর্মীয় পুলিশ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। ধর্মীয় পুলিশরা রাষ্ট্রীয় নির্দেশ অমান্য করার অপরাধে! মারধর করত। এ পুলিশদের প্রধান টার্গেট ছিল সেসব পুরুষ, যারা দাড়ি রাখত না এবং সেসব নারী, যারা সঠিকভাবে বোরকা পরত না।
চুরির জন্য হাত কাটা এবং ধর্ষণ ও হত্যার জন্য প্রকাশ্যে শাস্তি কার্যকর করা হতো। বিবাহিত ব্যক্তিরা বিবাহবহির্ভূত যৌন কার্যকলাপে লিপ্ত হলে তাদের পাথর ছুড়ে হত্যা করা হতো। নগরীর স্টেডিয়ামে ব্যাপক মানুষের উপস্থিতিতে এসব দণ্ড কার্যকর করা হতো।
তালেবান বিধিনিষেধের প্রধান টার্গেট ছিল নারীরা। তাদের কাজকর্মে নিয়োজিত হওয়া, এমন কোনো সাজ-পোশাক পরা যার ফলে পুরুষদের মধ্যে উত্তেজনা ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয় সেসব নিষিদ্ধ করা হলো। এমন কি নারীরা যদি ইরানি চাদর ব্যবহার করত, তাও গ্রহণযোগ্য ছিল না। ইরানি চাদর নারীদের চেহারা পুরোপুরি দৃষ্টির আড়াল করত না। নারীরা ট্যাক্সিতে করে কোথাও যেতে হলে সঙ্গে করে নিতে হতো একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে, যাকে মাহরুম বলা হয়।
এ ছাড়া নারীদের পোশাক-আশাক ঝরনা ধারায় ধৌত করতে হতো এবং দর্জিদের দিয়ে তাদের পোশাকের মাপ নেওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নারীদের কর্মসংস্থানের একটি মাত্র পদ খোলা রাখা হয়েছিল। সেটা হলো নারী রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কাজ। নারীদের জন্য কাজকর্ম নিষিদ্ধ করার ফলে অনেক প্রাথমিক স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কাবুলেও এমনই ঘটনা ঘটেছিল।
কারণ কাবুলের স্কুলগুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষক ছিল নারী। নারীরা স্কুলে যেতে না পেরে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছিল। উচ্চশিক্ষা দূরে থাকুক, প্রাথমিক শিক্ষাও সম্ভব ছিল না। এমনকি ঘরে বসেও লেখাপড়া করতে মেয়েশিশুদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। এক কথায় তালেবানদের শরিয়া আইনের ব্যাখ্যা না মানলে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হতো। সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেল।
গান-বাজনাও বন্ধ হয়ে গেল। সাংস্কৃতিক বহু কর্মকাণ্ড, যেগুলো বহু ইশ্বরের পূজা হিসাবে মনে করা হতো সেগুলোও নিষিদ্ধ করা হলো। মিউজিয়াম ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা ইতিহাসের দিক থেকে মূল্যবান সব রকম জিনিস ভেঙে ফেলা হয়েছিল। তালেবানরা আফগানিস্তানের নববর্ষ উৎসবও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। শিয়াদের আশুরাও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, নারীদের উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ২০০১-এর মার্চে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা গৌতম বুদ্ধের দুটি বিশাল মূর্তি ধ্বংস করা হয়েছিল। এ মূর্তিগুলো ৫৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি করা হয়েছিল। ইউনেস্কোসহ পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিল।
শুরুর দিকে মোল্লা ওমর আফগানিস্তানের ঐতিহ্য সংরক্ষণ সমর্থন করেছিলেন এবং জাপানের কাছ থেকে এগুলো সংরক্ষণের জন্য আর্থিক সাহায্যও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে মিউজিয়ামে রাখা মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মূর্তি শরিয়া আইনের দোহাই দিয়ে ধ্বংস করা হয়। পাকিস্তান সরকার তালেবান নেতৃত্বকে ইতিহাসের নিদর্শন ধ্বংস না করার জন্য তালেবানদের প্রতি অনুরোধ জানায়।
এমনকি সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তালেবানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভিত্তিক মূর্তি ধ্বংস করার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে। তালেবানরা হাজারা গোষ্ঠীর ওপর নির্মম নিপীড়ন চালায়। তারা বলে, গত বছর তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছ এবং আমাদের হত্যা করেছ। তোমাদের সব বাড়ি থেকে আমাদের গুলি করা হয়। আমরা এখন এখানে এসে গেছি এবং তোমাদের দেখে নেব। হাজারারা মুসলমান নয় এবং আমরা তাদের হত্যা করব। তোমরা মুসলমান হয়ে যাও অথবা আফগানিস্তান ত্যাগ করো। তোমরা যেখানে যাও না কেন, আমরা তোমাদের ধরে ফেলব।
২০০১ সালের ৯/১১-এর ঘটনার ফলে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে। তালেবানরা পরাজিত হয় অথবা পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করে। ২০০৩-এর মে ও জুন মাসে তালেবান কর্মকর্তারা ঘোষণা করেন যে, তারা সংঘবদ্ধ হয়েছে এবং মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করবে। ২০০৪ সালে আত্মগোপনে থাকা তালেবান নেতা মুহাম্মদ ওমর আমেরিকা ও তার ক্রীড়নকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন এবং আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব উদ্ধার করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন।
তালেবানরা প্রায় ২০ বছর ধরে আমেরিকা ও তার ক্রীড়নকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছে। ২০২০-এর ২৯ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এ চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্য বিদায় নেবে এবং তালেবানরা অঙ্গীকার করে যে, তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আল কায়দাকে কোনো রকম কর্মকাণ্ড চালাতে দেওয়া হবে না এবং তালেবান ও আফগান সরকার আলাপ-আলোচনা করবে।
এ চুক্তির প্রতি চীন, রাশিয়া এবং পাকিস্তান সমর্থন ব্যক্ত করে। তবে আফগান সরকারকে এ ব্যাপারে জড়িত করা হয়নি। ২০২০-এর সেপ্টেম্বরে ৫০০০ তালেবান বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। আফগান সরকার ‘দোহা’ চুক্তির অংশ হিসাবে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২০২১ সালের প্রথম দিকে পেন্টাগন ও আফগান নেতৃত্ব বিশ্বাস ব্যক্ত করে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে কাবুলকে সমর্থন করে যাবে।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিদেশের মাটিতে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়ার পলিসি অব্যাহত রাখেন। আফগানিস্তানের ঘানি সরকার মার্কিন জনশক্তি ও সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে থাকে। বাইডেন প্রশাসন ২০২১-এর এপ্রিলে ঘোষণা করে যে, প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত সময়সূচির চেয়েও অধিকতর সময়ে সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে।
মার্কিন সরকার আশা করেছিল সৈন্য প্রত্যাহার ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১-এর মধ্যে সম্পন্ন হবে। ৮ জুলাই বাইডেন সময়সীমা ৩১ আগস্টে পরিবর্তন করে। তালেবান এবং তার মিত্র সামরিক গ্রুপগুলো ব্যাপক অভিযান শুরু করে। সময়টা ছিল গত মে মাসের ১ তারিখ। একের পর এক পরাজয়ের ফলে আফগানিস্তানের পুতুল সরকারের সৈন্য বাহিনী ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাবুলে সৈন্যদের ২টি ইউনিট মধ্য আগস্ট পর্যন্ত কার্যকর থাকে। তালেবান বাহিনী রাজধানী কাবুলকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং ১৫ আগস্ট ২০২১ তালেবানদের হাতে কাবুলের পতন ঘটে।
প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি কাবুল পতনের কয়েক ঘণ্টা আগে দেশ ত্যাগ করেন। প্রথমে তিনি তাজিকিস্তান যান। সেখানে ঠাঁই না পাওয়াতে তিনি ওমানে চলে যান। কাবুল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ সঙ্গে করে নিয়ে যান। মার্কিন সরকার কিছু সংখ্যক আফগান নাগরিককে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করে। কিন্তু বাংলাদেশ সেই অনুরোধ গ্রহণ করতে না পারার কথা জানিয়ে দেয়।
তবে কাবুলে এখনো সাবেক মার্কিন ক্রীড়নক হামিদ কারজাই অবস্থান করছেন। আফগানিস্তানে অন্তর্বর্তীকালে সরকার দেশ চালাবে। নতুন আফগান সরকারকে চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান অচিরেই স্বীকৃতি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এশিয়ার মাটিতে ভিয়েতনামের পর আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় পরাজয় হলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বছরের পর বছর যুদ্ধ চালানো আর সম্ভব নয়।
পৃথিবীর অন্যত্র যুদ্ধ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা করার তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তবে সমস্যা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের মতানুসারে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স দ্বারা পরিচালিত হয়। এরা যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে। যুদ্ধ না হলে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রয় করা যাবে না। তাই এ মহলের চেষ্টা থাকবে অজুহাত তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের পথে যেতে বাধ্য করা। আফগানিস্তানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি পরোক্ষভাবে হলেও মিলেছে।
এ স্বীকৃতি হলো তালেবানদের জন্য। দোহা আলোচনায় আশরাফ ঘানি সরকারের প্রতিনিধি ছিল না। তালেবান প্রতিনিধি ও মার্কিন প্রতিনিধিরা আলোচনা করে চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। ক্ষমতা হারিয়ে তালেবানদের প্রায় ২০ বছর বিদ্রোহাত্মক সামরিক তৎপরতা চালাতে হয়েছে। তালেবানদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও বীরত্বের প্রশংসা করতে হয়। এর ফলে অনেক মার্কিন ন্যাটো সৈন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছে। দেখা যাক, তালেবানরা কীভাবে দেশ চালায়। অতীতের মতো চণ্ডনীতি অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।
আশা করি, অতীতের তুলনায় তারা আরও অনেক বেশি পরিপক্ব হয়েছে। আফগানিস্তান পর্বতঘেরা একটি দেশ হলেও আফগানিস্তানের ভূ-গর্ভে রয়েছে অনেক মূল্যবান ধাতু। এ ছাড়া রয়েছে রেয়ার আর্থ। এ রেয়ার আর্থ কম্পিউটার চিপ্স তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ভারত আফগানিস্তানে পুতুল সরকারগুলোর সময়ে অনেক অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। এ মুহূর্তে যতটুকু দৃশ্যমান তাতে মনে হয়, আফগানিস্তানে ভারতের কূটনীতি চরম আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।
তবে তালেবানরা এ অঞ্চলের বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতকে বিরক্ত করার মতো কোনো কাজ করবে না, এমনটি ভাবা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগ সক্রিয় রয়েছে। তালেবানরাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী অবস্থানে থেকে একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছে। সম্পর্ক জাল যেখানে যতটুকু আছে তার ভিত্তিতেই তালেবানদের বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করতে হবে।
আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে চীনের বিনিয়োগ প্রাধান্য পাবে। যদি আফগানিস্তানের পরিপূর্ণ শান্তি ফিরে আসে, তাহলে মধ্য এশিয়া থেকে তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তানে আসবে। এ পাইপলাইনের জন্য আফগানিস্তান ভালো অঙ্কের মাশুল আদায় করতে পারে। যুদ্ধবিগ্রহ অনেক হয়েছে। এবার আফগানিস্তানের প্রয়োজন শান্তি ও স্থিতিশীলতা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ