মনের মুকুরে তিনি চিরঅম্লান
মো. শহীদ উল্লা খন্দকার
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আগস্ট মাস শোকের মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বর্বর ঘাতকের বুলেটে শহিদ হন পরাধীন জাতির মুক্তির দূত, শোষিত-বঞ্চিত মুক্তিপিপাসু বাঙালির অধিকার আদায়ের আমৃত্যু সংগ্রামী কালোত্তীর্ণ নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওইদিন আরও শহিদ হন বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিবসহ তার ৩ পুত্র, ২ পুত্রবধূ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রিয়জন ও ঘনিষ্ঠ অনেকে।
প্রাণী হিসাবে মানুষ মরণশীল বলে সবারই একটি মৃত্যুদিন থাকে। তবে কোনো কোনো মানুষের দেহাবসানই ঘটে, মৃত্যু হয় না। মুজিব মৃত্যুহীন।
বঙ্গবন্ধু শুধু একজন মহান জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন না, তিনি জাতীয় বীর। মৃত্যুর আগে অথবা কখন কোন পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন, তা মুখ্য নয়। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি, তার আগে প্রধানমন্ত্রী। এসব তার গৌণ পরিচয়। তিনি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি একটি স্বাধীন জাতির স্রষ্টা। তার গঠিত স্বাধীন রাষ্ট্র যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন তার মৃত্যু নেই।
শেখ মুজিব আজীবন লড়াই করেছেন প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে। একজন জাতীয়তাবাদী নেতার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকবেই। উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয় নেতাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়েও থাকে বিরুদ্ধ পক্ষ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিবসে আমাদের ভেবে দেখতে হবে, কেন তিনি জীবন দিলেন। ঘাতকরা কেউই তার ব্যক্তিগত শত্রু ছিল না। তিনিও ছিলেন না কোনো ঘাতকের শত্রু। একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্রীয় আদর্শকে হত্যা করার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। কারণ তিনি ছিলেন সেই আদর্শের প্রবক্তা। তার হত্যাকাণ্ডের যারা ষড়যন্ত্রকারী, তারা জানত, তাকে জীবিত রেখে সেই আদর্শটিকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। সুতরাং তিনি জীবন দিয়েছেন তার আদর্শের জন্য, ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্য নয়।
বাংলার মানুষ মুজিবকে যে কী পরিমাণ ভালোবাসত, সে বিষয়ে একটি সত্য ঘটনা বলছি। ঘটনাটি ১৯৪৯ সালের শেষ সময়কালের। শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়ার পথে বেরিয়ে পড়েছেন। স্টিমার থেকে গোপালগঞ্জে নেমে তারপর নৌকাযোগে মধুমতি নদীপথে বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। তখন ভরা বর্ষার গভীর নিস্তব্ধ রাত। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সঙ্গী কাজী আলতাফ হোসেন (সে সময়ের গোপালগঞ্জ আওয়ামী মুসলিম লীগের কনভেনর) তার সহযাত্রী। পথে যেতে যেতে তাদের আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো-মধুমতির তীরে অবস্থিত মাওলানা শামসুল হক সাহেবের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার সঙ্গে দেখা করা। অনেক দিন কারাভোগের কারণে ক্লান্ত মুজিব নৌকার ভেতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাজী আলতাফ সাহেব জেগে আছেন, আর মাঝি নৌকা বেয়ে চলছে। নৌকা যখন মধুমতির একেবারে বিশাল-বিস্তৃত জায়গায় এসে পৌঁছাল, তখন একটা ছিপ নৌকায় ৪ জন ডাকাত ডাকাতি করার উদ্দেশ্যে দ্রুতবেগে এসে মুজিবের নৌকার পাশে হাজির হলো। কাজী আলতাফ হোসেন জেগে ছিলেন বিধায় তিনি আসন্ন বিপদ সম্পর্কে আঁচ করতে পেরে ততক্ষণে তার ঘড়ি, টাকা-পয়সা ও স্বর্ণের আংটি সবই লুকিয়ে ফেলেছেন নৌকার খোলের ভেতরে।
আর ওদিকে ক্লান্ত মুজিব ঘুমিয়ে আছেন বিভোর হয়ে। ডাকাতরা আগুন আছে কিনা তা মাঝির কাছে জানতে চেয়েই নিমিষের মধ্যে একেবারে নৌকার কাছে এসে উপস্থিত হলো। এসেই তারা নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই মাঝি, নৌকা যাবে কোথায়?।’ মাঝি বলল, ‘টুঙ্গিপাড়া।’ ডাকাতরা আবার প্রশ্ন করল, ‘নৌকায় কে?’ মাঝি উত্তর দিল, ‘শেখ মুজিব’। মাঝি এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ডাকাতরা মাঝিকে বৈঠা দিয়ে পিঠের মধ্যে একটা ভীষণভাবে আঘাত করে বলল, ‘শালা আগে বলতে পারস নাই শেখ সাহেব নৌকায়।’ এ কথা বলে অমনি ডাকাতরা নৌকা ছেড়ে দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে অন্যদিকে চলে গেল।
এ ঘটনার মধ্যেই বুঝতে পারা যায় বাংলার জনতার অন্তরে মুজিবের স্থান কোথায় ছিল। মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত বাংলার মুজিব ছিলেন সবার অন্তরের মণিকোঠায়। মুজিবের নামে সবাই সবকিছু ত্যাগ স্বীকারে ছিলেন সদাপ্রস্তুত। হোক না সে বা তারা চোর, ডাকাত, খুনি, বদমাশ, দেশপ্রেমিক কিংবা সাধারণ মানুষ। মুজিবই যে তাদের একমাত্র দুঃখের সাথী, ভালোবাসার মানুষ এবং মুক্তি পথের দিশারি। তার নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধায় মাথা নত না করে উপায় কী!
আগরতলা মামলার সময় থেকে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলার মানুষের অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। তিনি ছিলেন একজন জাতীয় বীর, যার শারীরিক অনুপস্থিতি কোনো শূন্যতা সৃষ্টি করে না। বাংলার হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস সবচেয়ে সংকটের সময়। সে সময়টি তিনি ছিলেন পাকিস্তানি জান্তার হাতে বন্দি। শত্রুর কারাগারে তার বন্দিত্ব বাংলার মানুষকে বিচলিত ও ব্যথিত করলেও তিনিই ছিলেন স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রধান প্রেরণা। তার সহকর্মী ও সহযোগীরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন, তবে তাদের শক্তির উৎস ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সবচেয়ে বড় সত্য যা তা হলো, তিনি তার বিরুদ্ধবাদীদের ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ বিরুদ্ধবাদীরা মৃত্যুর পরও তার লাশকে ঢেকে দিতে চেয়েছিল শীতল অবহেলার কালো চাদরে। তবে তারা নির্বোধ। তারা জানে না, তার লাশ বিস্তৃত বাংলাদেশজুড়ে। তা কোনো মাপের কাপড়ের পক্ষেই ঢেকে দেওয়া সম্ভব নয়। তার প্রতিপক্ষ জানে না যে, তার মতো জাতীয় বীরের বিনাশ নেই। যুগ থেকে যুগান্তর-তিনি যুগপৎ ভক্তদের দ্বারা পূজিত ও প্রশংসিত। তার মরদেহ মৃত্তিকায় বিলীন হলেও তার কাজ ও স্মৃতি অনাদিকাল থাকবে অম্লান।
১৯৪৭ সাল থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন করাচিকেন্দ্রিক নব্য উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। ১৯৪৮ সালে প্রথম কারারুদ্ধ হন রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে। বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আপস করেননি, তাই তার জীবদ্দশায় তাকে ৪৬৭৫ দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। অথচ পাকিস্তানি শাসকদের লোভনীয় প্রস্তাব মেনে নিয়ে তিনি অনায়াসেই বড় পদ নিয়ে আরাম-আয়েশেই জীবনযাপন করতে পারতেন। প্রকৃতপক্ষে নিজের সারাটা জীবন তিনি উৎসর্গই করে দিয়েছিলেন এ দেশের মানুষের মুক্তি অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। তিনি তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’-এটা কেবল কথার কথা নয়, এটা তিনি সারা জীবনের আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, কর্ম ও নেতৃত্ব দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তার ছিল মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা। মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন, মানুষের ভালোবাসা পেয়েওছিলেন। সারা দেশকে জাগিয়ে তুললেন ছয় দফা দিয়ে; তারপর সব দফা এসে মিলিত হলো একটি মাত্র দফায়-বাংলার স্বাধীনতা। কী অপূর্ব সুন্দরভাবে একদেহ একপ্রাণ হয়ে উঠেছিল পুরো জাতি। নক্ষত্রের আলোর মতো তার উদ্যত তর্জনীর নির্দেশ-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
এ আগস্ট মাস নানা কারণেই শোকবিধুর। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল এ মাসেই। সেই হামলায় আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে শোককে শক্তিতে পরিণত করে আমরা একদিন বিশ্বমঞ্চে বাঙালি জাতি হিসাবে শির উঁচু করে দাঁড়াব। আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বৈশ্বিক রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রাপ্ত অর্জনগুলো প্রমাণ করে-শত আঘাতের, শত চক্রান্তেও এ ছোট ভূখণ্ডের মানুষ মাথা নোয়াবার নয়। গভীর শোকের এ ৪৬তম বার্ষিকীতে একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ না করলেই নয়। টাইমস অব লন্ডনের ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় বলা হয়-‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’ উদ্ধৃতিটি আজ পলে পলে বাঙালি জাতি অনুভব করছে। বঙ্গবন্ধু আজ মিশে আছেন নির্মোহদানে, বাংলার প্রকৃতিতে, আকাশে-বাতাসে, আলো-ছায়ায়, নদী-গিরি-বনে, শস্য-শ্যামলে, বাংলার অবারিত মাঠজুড়ে সবখানে।
তিনি মিশে আছেন লাখো শহিদের রক্তে শিখা অনির্বাণ হয়ে অগ্নিপ্রভাতে। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী অমর। ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করে তিনি বেঁচে আছেন একজন সুদক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, আজন্ম বাস্তববাদী এক আদর্শবাদী অবিসংবাদিত মহানায়ক রূপে। তিনি শাশ্বত, চিরভাস্বর ও অবিসংবাদিত মহানায়ক রূপে বেঁচে আছেন দুনিয়ার সব পরাধীন জনতার মুক্তির মিছিলে। বেঁচে আছেন জগতের সব স্থানে চিরদুঃখী, অনাহারি, স্বাধীনতা-সংগ্রামী, বিপ্লবী জনতার বজ্রকণ্ঠে। এহেন আত্মত্যাগী, মহৎপ্রাণ, জনদরদি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহাবীর সন্তানকে বরণ করে নিতে হয় হৃদয়ে। নিখাদ সত্যে চিরস্থায়ী বাস্তবে। সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ও মহামুক্তির জয়গানে ‘বঙ্গবন্ধু’ উল্লাস ধ্বনিতে। স্বীকার করে নিতে হয় রক্তরাঙা ইতিহাসের পথে পথে আপন অস্তিত্বের মণিকোঠায় বাঙালি জাতির পিতা রূপে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর। এটা কেবল কথার কথা নয়। তিনি জীবন দিয়ে সেটি প্রমাণ করে গেছেন। আজকে যদি আমরা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই, দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে চাই, সেজন্য দরকার হবে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং দরকার হবে দূরদর্শিতা। দরকার হবে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তাই তার সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত তার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ায় আমরা সবাই যে যে অবস্থানে আছি, সেখান থেকে যার যার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেই বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে ও তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
মো. শহীদ উল্লা খন্দকার : সচিব, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়