Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার এবং ফার্মাকোভিজিল্যান্স

Icon

ডা. সুপ্রিয় পাল

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২১, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার এবং ফার্মাকোভিজিল্যান্স

মনে করুন, আপনার প্রচণ্ড কাশি, জ্বর ও গলাব্যথা হয়েছে। ডাক্তারকে দেখানোর পর তিনি আপনাকে একটি অ্যান্টিবায়োটিকসহ ৪টি ওষুধ খাওয়ার ব্যবস্থাপত্র দিলেন। ৩-৪ দিন ওষুধ খেলেন, সবই ভালো আসছে। কিন্তু চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধটি খাওয়ার পর আপনার প্রচণ্ড চুলকানি শুরু হলো। সঙ্গে আপনার মুখ ও শরীর ফুলে গেল। প্রচণ্ড ছটফট শুরু করায় আপনাকে দ্রুত একটি হাসপাতালে নেওয়া হলো এবং উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়ার পর আপনি সুস্থবোধ করলেন। এরপর হয়তো আপনি ওই ডাক্তারের কাছে পরামর্শ নিলেন এবং উপরের ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। ডাক্তার আপনাকে ভবিষ্যতে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধটি পুনরায় খেতে সম্পূর্ণ নিষেধ করলেন এবং পরিবর্তন করে নতুন আরেকটি অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন, যা খেয়ে আপনার আর কোনো সমস্যা হলো না এবং আপনি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। ঘটনাটি অস্বাভাবিক বা স্বাভাবিক যাই মনে হোক না কেন, এ ধরনের মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক সময়ই হাসপাতালে ভর্তির কারণ বা মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বর্তমানে বিশ্বের বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রির একটি অন্যতম কাজ হলো ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলো পর্যবেক্ষণ করা এবং ওষুধের নিরাপদ ব্যবহারে সচেতনতা গড়ে তোলা। এ প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ফার্মাকোভিজিল্যান্স বা ড্রাগ সেইফটি এবং এটি বর্তমানে প্রতিটি বড় ওষুধ কোম্পানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা।

ইতিহাসের দিকে গেলে দেখা যায়, ফার্মাকোভিজিল্যান্স প্রক্রিয়াটির উদ্ভব প্রায় ১৭০ বছর আগে। কিন্তু তখনো এই শব্দটি সম্পর্কে কারও তেমন একটা ধারণা ছিল না। আধুনিক ফার্মাকোভিজিল্যান্সের যাত্রা শুরু ১৯৬১ সালের পর। ১৯৫৭ সালে থ্যালিডোমাইড নামক একটি ওষুধ প্রথম জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের বাজারে আসে। সে সময়ে তা গর্ভবতী মহিলাদের উদ্বিগ্নতা, বমি হওয়া, সকালবেলা বমি বমি ভাব বা মর্নিং সিকনেস এবং ঘুমের ওষুধ হিসাবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ফলে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত এটি অত্যন্ত সমাদৃত ওষুধ হিসাবে প্রায় ৪৭টি দেশে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬১ সালে অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক উইলিয়াম ম্যাকব্রাইড বিখ্যাত ল্যানসেট জার্নালের প্রধান সম্পাদককে একটি চিঠি দিয়ে প্রথম ব্যাখ্যা করেন যে, থ্যালিডোমাইডের কারণে অনেক বিকলাঙ্গ শিশু জন্মগ্রহণের ঘটনা ঘটেছে; যা পরে ল্যানসেটে প্রকাশিতও হয়। এত শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঘটনা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর ওষুধ প্রশাসনগুলো নড়েচড়ে বসে। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে ফার্মাকোভিজিল্যান্সের অগ্রযাত্রা শুরু।

গ্রিক শব্দ Pharmakon বা ওষুধ এবং ল্যাটিন শব্দ Vigilar বা নজরদারি করা- এ দুটো শব্দের সমন্বয়ে ফার্মাকোভিজিল্যান্স শব্দটি গঠিত, যার অর্থ হচ্ছে ওষুধের ওপর নজরদারি করা। ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও কাজের সঙ্গে অর্থগত যথেষ্ট মিল রয়েছে। একটি ওষুধ বিভিন্ন ধাপ পার করে বাজারে আসে। এ ধাপগুলোতে পর্যায়ক্রমে ওষুধের গুণাগুণ, প্রাণীদেহে কার্যকারিতা, মানবদেহে কার্যকারিতা, রিস্ক-বেনিফিট রেশিও বা অনুপাত, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি দেখা যায়। সবকিছুর পরে যদি বেনিফিট বেশি হয়, তবেই তা বাজারজাতের উপযোগিতা প্রাপ্ত হয়। মূলত এ বাজারজাতের পরই শুরু হয় ওষুধের ওপর নজর রাখার দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব বাজারজাতকারী সব ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর। ফার্মাকোভিজিল্যান্স সম্পর্কে জানার জন্য কিছু বেসিক টার্ম জানা আবশ্যক- ১. এডভার্স ড্রাগ রি-অ্যাকশন : চিকিৎসক প্রদত্ত নির্ধারিত মাত্রায় ও নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধ খাওয়ার পরে যেসব বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে যেমন- পেনিসিলিন জাতীয় ওষুধ নির্ধারিত মাত্রায় সেবনের পরেও শরীরে চুলকানি বা র‌্যাশ হতে পারে। ২. এডভার্স ড্রাগ ইভেন্ট : যে কোনো মাত্রায় যে কোনো সময়ে যদি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে যেমন- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ১টি পেনিসিলিনের পরিবর্তে জেনেবুঝে বা ভুল করে অধিক পরিমাণ খেয়ে ফেলার পরে যদি কোনো প্রতিক্রিয়া হয়। ৩. সিরিয়াস এডভার্স ইভেন্ট : একটি ওষুধ খাওয়ার পরে যদি নিুোক্ত সমস্যাগুলো হয়, তবে তা মারাত্মক বা সিরিয়াস এডভার্স ড্রাগ ইভেন্ট বলে গণ্য হবে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, একটি নির্দিষ্ট জেনেরিক উপাদানের ওষুধ অনেক কোম্পানিই বিভিন্ন ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করে থাকে। কোনো একটি কোম্পানির বানানো ওই ওষুধটি সেবনের পরে যদি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঘটনা ঘটে (যেমন- শরীরে চুলকানি হওয়া, চোখ-মুখ ফুলে যাওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি), তা কখনোই ওই কোম্পানির কোনো ভুল বা দোষ নয়। এটি ওই উপাদানের ওষুধের জন্যই ঘটে যাওয়া একটি অস্বাভাবিক বা স্বাভাবিক ঘটনা। ওষুধের প্যাকেটের ভেতরে সাদা কাগজে বা লিফলেটে এই প্রতিক্রিয়াগুলো লাল অক্ষরে লেখা থাকে। ওই লিফলেটে উল্লেখিত প্রতিক্রিয়াগুলোর যে কোনো একটি ঘটলে তাকে বলে প্রত্যাশিত বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং লেখার বাইরে কোনো বিষয়ে প্রতিক্রিয়া হলে তাকে বলে অপ্রত্যাশিত বিরূপ প্রতিক্রিয়া।

এসব বিরূপ প্রতিক্রিয়া তথ্য আকারে ওষুধ কোম্পানিগুলো সংগ্রহ করে। বিভিন্ন যাচাই-বাছাইয়ের পরে এই তথ্যগুলো দেশের ওষুধ প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দেয় কোম্পানিগুলো। তথ্যগুলো আবার যাচাই-বাছাইয়ের পরে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সেগুলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ওষুধ পর্যবেক্ষণকারী উপসংস্থা ‘উপসালা মনিটরিং সেন্টার’-এ পাঠিয়ে দেয়। এভাবে যখন কোনো একটি নির্দিষ্ট উপাদানের ওষুধের জন্য বারবার বিভিন্ন রিপোর্ট আসতে থাকে, তখনই সেই ওষুধের বেনিফিট ও রিস্ক নিয়ে আবার পর্যালোচনা করা হয়। এর মাধ্যমেই ওই উপাদানের ওষুধটি বাজারে রাখা যাবে কিনা, ওষুধটির ফরমুলেশনে কোনো পরিবর্তন আনা প্রয়োজন কিনা, ওষুধের লিফলেটে নতুন কোনো সতর্কতা লেখা দরকার কিনা ইত্যাদি সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে পরে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে করে পরে জনসাধারণের যেন ওষুধের কারণে আর কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

নিমেসুলাইড জ্বর ও সাধারণ ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামলের চেয়েও অধিক কার্যকরী বলে প্রমাণিত ছিল। কিন্তু অল্প মাত্রাতেই লিভারের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার মতো রিপোর্ট আসতে শুরু করে এ ওষুধের বিরুদ্ধে। ফলে ২০০২-এর পর ধীরে ধীরে সব দেশ এ ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এভাবেই ফার্মাকোভিজিল্যান্স কাজ করে। থ্যালিডোমাইড ১৯৬১ সালের পর আবার ২০০৮ সালে বাজারে ফিরে আসে। কিন্তু এবার অন্য আরেকটি রোগ মাল্টিপল মায়োলেমা জাতীয় ক্যান্সারের চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করার জন্য নির্দেশিত হয় আর প্রতিনির্দেশনা হিসাবে লাল অক্ষরে লেখা থাকে, গর্ভকালীন সেবন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এটিও ফার্মাকোভিজিল্যান্সের কাজ।

সর্বোপরি, আধুনিক যুগে ফার্মাকোভিজিল্যান্স ওষুধশিল্পের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা এবং সব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির একটি অপরিহার্য অংশ। এর মাধ্যমে যেমন সারা বিশ্বে ওষুধের নিরাপদ ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, তেমনি প্রত্যেক রোগী বা সাধারণ মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে তা কাজে লাগছে। যদি কারোর কোনো ওষুধের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পূর্ব ইতিহাস থাকে, তবে তাকে সেই ওষুধ পরে কখনোই দেওয়া যাবে না। যদি কোনো রোগীর ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগ বা সেবনের ফলে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটে, তবে অতিদ্রুত পরবর্তী চিকিৎসা নেওয়া উচিত এবং ওই ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বরাবর দ্রুত ঘটনাটি রিপোর্ট করা উচিত। এতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত ওষুধ প্রশাসনকে অবহিত করতে পারবে।

এভাবে দেশের সব মানুষের ফার্মাকোভিজিল্যান্স প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা উচিত এবং কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা খারাপ প্রভাব দেখা মাত্রই সংশ্লিষ্ট ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে জানানো উচিত; যেন পরে তা অন্য আরেকজন মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। জানানোর প্রক্রিয়াটি হতে পারে অনেকভাবে; যেমন- রোগী প্রথমে চিকিৎসককে এবং চিকিৎসক পরে ওষুধ কোম্পানিকে জানাবে কিংবা সরাসরি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিকেই অবহিত করা যেতে পারে অথবা ওই ওষুধ কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে পুরো ঘটনা উল্লেখ করে সরাসরি ইমেইল করা অথবা ওয়েবসাইটে প্রদত্ত ফোন নম্বরে সরাসরি ফোন করে জানানো যেতে পারে। যে কোনো একটি উপায়ে অবহিত করলেই হলো।

এ ছাড়াও সরাসরি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকেও জানানো যায়। https://www.dgda.gov.bd/index.php/adrm/adrm-entry-form এ ওয়েবসাইটে গিয়ে সরাসরি তথ্য পূরণ করে যে কেউ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনলাইনে রিপোর্ট করতে পারবেন। এ ছাড়াও https://www.dgda.gov.bd/ index.php/adrm/adr-reporting-form এ ওয়েবসাইটে গিয়ে রিপোর্টিং ফরম প্রিন্ট করে সেটি হাতে-কলমে পূরণ করেও যে কোনো ব্যক্তি সরাসরি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর বরাবর ডাকযোগে পাঠাতে পারবেন। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সবার উচিত ফার্মাকোভিজিল্যান্স প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে নিরাপদ ওষুধ ব্যবহারের নিশ্চয়তা এবং সুস্থ স্বাভাবিক জীবন।

ডা. সুপ্রিয় পাল : ট্রেইনি রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম