Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

অনুভূতিতে হিরোশিমা

Icon

শামীম আহমেদ

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২১, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অনুভূতিতে হিরোশিমা

জাপানে থাকাকালীন একদিন ল্যাবে কথা প্রসঙ্গে প্রফেসর আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাদের দেশের কোনো কোনো দর্শনীয় জায়গা দেখতে আমি আগ্রহী।

পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! কেননা জাপানে পা দেওয়ার পর থেকেই আমার এবং আমার স্ত্রীর মনে সবসময় একটা চিন্তা ঘুরপাক খেত- কবে হিরোশিমা দেখার সুযোগ পাব! আসলে ছোটবেলায় প্রথম যেদিন স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ‘হিরোশিমা কথা’ নামের প্রবন্ধটি পড়েছিলাম, সেদিনই ওই বর্বরোচিত, পাশবিক কাহিনি আমাকে মর্মাহত করেছিল।

এরপর সুযোগ এলো ২০০৪ সালের জুন মাসের প্রথমদিকে। ফুকুওকার একটি কনফারেন্স শেষ করে ট্রেনে চেপে রওনা হলাম হিরোশিমা দিকে।

হিরোশিমা রেলস্টেশনে যখন পৌঁছলাম, তখন প্রায় দুপুর ১টা। স্টেশনে নামার পর থেকেই মনটা কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে উঠল। রোদ ঝলমলে একটি সুন্দর দুপুর, অথচ মনটা কেমন যেন বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন। হোটেলে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে দুপুরের পর যখন ট্যাক্সি করে হিরোশিমা পিস মিউজিয়ামের দিকে রওয়ানা দিলাম, তখন শরীরটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল, আর মনজুড়ে এক ধরনের ভয় ভয় অনুভূতি। মনে হচ্ছিল, আমরা কোনো এক মৃত্যুপুরী দেখতে যাচ্ছি। হিরোশিমা পিস মিউজিয়ামে যখন পৌঁছলাম, তখন বিকাল গড়িয়ে যাচ্ছে। জায়গাটা মনে হয় এমনিতেই বেশ নিরিবিলি, কিছুটা পার্কের মতো অনেক বড় জায়গা, কিন্তু সে তুলনায় লোকজন অনেক কম, বড় বড় গাছপালা, আশপাশের স্থাপনাও অন্য এলাকার তুলনায় কম। ফলে জায়গাটা এতটাই নিরিবিলি লাগছিল যে মনে হচ্ছিল হিরোশিমার আতঙ্ক আর দুঃসহ স্মৃতি এখনো সবার মাঝে রয়ে গেছে।

একটু পেছনের ইতিহাসে যাই। হিরোশিমা জাপানের দক্ষিণ দিকের একটি শহর। চল্লিশের দশকে, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এটি জাপানের একটি শিল্পসমৃদ্ধ শহর ছিল। হিরোশিমার আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত যে ভবনটির ছবি সাধারণত আমরা দেখতে পাই, সেটি ছিল হিরোশিমার শিল্পোন্নয়ন সংক্রান্ত আঞ্চলিক দপ্তর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে জার্মানি আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। জার্মানির পরে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে রাশিয়া। সামরিক সমীকরণের জটিল হিসাব-নিকাশ চলছে। এখন যদি রাশিয়া জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং সেই যুদ্ধে মিত্রবাহিনী জয়লাভ করে, সেক্ষেত্রে বিজয়ের কৃতিত্বের একটা বড় অংশ রাশিয়ার পক্ষে চলে যেতে পারে। কারণ রাশিয়ার কাছে জার্মানি কীভাবে নাজেহাল হয়েছে, ইতোমধ্যে সবাই তা দেখেছে। ফলে সেই যুদ্ধে মিত্রবাহিনী জয়লাভ করলেও এটি যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বনেতৃত্বের ক্ষেত্রে আমেরিকার জন্য অসুবিধা বা অস্বস্তিকর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের আরেকটা দিকও আছে। ইতোমধ্যে জুলাই মাসে আমেরিকা তাদের তৈরি ভয়ংকর মারণাস্ত্রের একটি সফল পরীক্ষা মেক্সিকোর মরুভূমিতে সম্পন্ন করেছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে এ মারণাস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন(!) হয়তো বা শেষ হয়ে যাবে কিংবা এর ভয়ংকর ও বিধ্বংসী কার্যকারিতা বিশ্ববাসীর সামনে চাক্ষুষ উপস্থাপন করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। সুতরাং বিশ্বনেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে, সামরিক শক্তি বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য শিকার হিসাবে তারা বেছে নিল হিরোশিমাকে। ৬ আগস্ট, ১৯৪৫ সাল, সকাল ৮টা ১৫ মিনিট। যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে ভেবেই হয়তো বা সেদিনের সকালের সতর্কীকরণ সাইরেনকে অন্য সাধারণ বিমান হামলার পূর্বাভাস মনে করেছিল হিরোশিমাবাসী। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই হিরোশিমার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের সরাসরি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল পৃথিবীর ইতিহাসে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত সবচেয়ে বড় অপরাধটি- আণবিক বোমার আক্রমণ।

আঘাতের মূলকেন্দ্রের দুই কিলোমিটারে মধ্যে সব ধ্বংস হয়ে গেল। সারাদিন ধরে আগুনের লেলিহান শিখা বিক্ষিপ্তভাবে জ্বলতে লাগল শহরজুড়ে। আঘাতের মূলকেন্দ্রের ২৮০ মিটারের মধ্যে তাপমাত্রা ৫০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেল, এমনকি ৬০০ মিটার দূরের তাপমাত্রাও ছিল প্রায় ২০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রাণ বাঁচাতে পাশের নদীতে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা শুরু করল। কিন্তু খালের মতো ছোট্ট নদীটি হাজার হাজার অসহায় মানুষের বাঁচার আকুতি ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। ‘মানুষের নিষ্ঠুরতার’ কাছে নির্মমভাবে পরাজিত হয় ‘উদার প্রকৃতি’!

ছোট্ট নদীটির সামনে দাঁড়িয়ে সেই ভয়ংকর দৃশ্যটি আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। হাজার হাজার আতঙ্কিত মানুষ একসঙ্গে এই ছোট্ট নদীতে নামার চেষ্টা করছে, তাদের কারও কোলে হয়তো বা ছোট ছোট অবুঝ-নিষ্পাপ শিশুসন্তান রয়েছে, যাদের কারও বয়স হয়তো আমার পুত্র ফারহানের সমান বা আরও কম। প্রচণ্ড তাপে তাদের সবার শরীর ঝলসে গেছে কিংবা ঝলসে যাচ্ছে। শরীরের পোড়া চামড়া খুলে ঝুলে পড়ছে। চারদিকে পোড়া মাংসের বিকট গন্ধ। তাদের বিস্ফোরিত আর ভয়ার্ত চোখ, সেই চোখে শুধু অসহায়ত্বের ছায়া। অমানবিক যন্ত্রণায় তারা চিৎকার করছে, ঠেলাঠেলি করছে; কিন্তু সামান্য একটু স্বস্তি পেতে কেউই আর এ ছোট্ট নদীতে নামার মতো জায়গা পাচ্ছে না! মানুষের নিষ্ঠুরতার কাছে ছোট্ট নদীর অসহায় আত্মসমর্পণ। ভাবছিলাম, যদি এমনটা আমার জীবনে ঘটত! আমার কোলে আমার প্রাণপ্রিয় ফারহানের পোড়া শরীর! ফারহানের ভয়ার্ত চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে একটু সাহায্যের আশায়! আর ভাবতে পারছি না। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে আসছিল, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আমি আর কল্পনা করতে পারছিলাম না। বুঝতে পারলাম, আমার চোখের কোণা ভিজে গেছে। কেন এত নিষ্ঠুরতা? এ নৃশংসতায় প্রায় ছয় হাজার শিশু এতিম হয়ে পড়ে। তাদের কারও কারও ভাগ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনা জুটলেও একটা বড় অংশের শেষ গতি হয় রাস্তায়। শুধু তাই নয়, আক্রমণের ফলাফল এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, পরবর্তী সময়েও কোনো কোনো দেয়ালে মানুষের দেহের শুধুই ছাপ পাওয়া গিয়েছিল, তাদের দেহটা এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে ছাই পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমনকি ঘটনার ২৯ বছর পরও কোনো কোনো আক্রান্তের দেহ থেকে কাঁচের টুকরা বের করা হয়েছে।

আমরা দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ মূর্তির মতো, ইতিহাসের এক ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার অসহায় সাক্ষী হয়ে। এটাই সেই হিরোশিমা, আজ থেকে অনেক বছর আগে এক সুন্দর সকালে এখানেই মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরোচিত ঘটনাটা ঘটেছিল।

চিলড্রেন পিস মনুমেন্টেরর সামনে আমি আর আমার স্ত্রী বসে পড়লাম। একে অন্যের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকলাম। মাঝে মাঝে স্ত্রীর কোলে ছেলেটির দিকে একটু তাকাই। বারবার মনে হচ্ছিল, হিরোশিমার মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা আমার ছেলের জীবনেও ঘটতে পারত। ভাবলাম, সেদিন, ৬ আগস্ট ১৯৪৫, হাজার হাজার অসহায় বাবা-মায়েরা শুধু যে তাদের প্রিয় সন্তানদের মৃত্যু যন্ত্রণার আর্তনাদ দেখেছেন, তা নয়; সেদিন থেকে তারা তাদের বেঁচে যাওয়া সন্তানদের নিয়েও এক অজানা ভয়ংকর ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষার যাত্রা শুরু করেছেন।

প্রতিদিন, প্রতিরাত তাদের দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে- কখন জানি তাদের সন্তানদের মধ্যে আণবিক বোমার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে তাদের মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয় সন্তানদের অসহায়ত্বের সাক্ষী হতে হয়েছে।

অনেক হয়েছে আর নয়, পৃথিবীর সব মারণাস্ত্র ধ্বংস হোক, সব যুদ্ধ, সব দাঙ্গা বন্ধ হোক। বিশ্বজুড়ে নতুন যুদ্ধ শুরু হোক ক্ষুধা আর জরাকে জয় করার জন্য। আজকের এ হিরোশিমা দিবসে এটাই শান্তিকামী বিশ্ববাসীর আবেদন।

শামীম আহমেদ : অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

shamim_cst@ru.ac.bd

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম