Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পথশিশুদের স্কুলে করোনার থাবা

Icon

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পথশিশুদের স্কুলে করোনার থাবা

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার মতে, ১৮ বছরের নিচে যেসব শিশু রাস্তায় দিনাতিপাত করে এবং নিজেদের কোনো স্থায়ী আবাসস্থল নেই, তাদেরই পথশিশু বলে।

বাংলাদেশে পথশিশু হওয়ার পেছনে যেসব কারণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেগুলো হলো-দারিদ্র্য, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ কিংবা মৃত্যু, অসচেতনতা, অর্থলোভী কিছু মাদক ব্যবসায়ীর নিষ্ঠুর নজর ইত্যাদি। সুবিধাবঞ্চিত এসব পথশিশুর অনেকেই এসেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। অবহেলা, অনাদরে, খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন কাটে ফুটপাতে, পার্কে, ট্রেন ও বাসস্টেশনে, লঞ্চঘাটে, সরকারি ভবন কিংবা স্থাপনার খোলা বারান্দা নিচে। বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা, আদর-ভালোবাসা তাদের কপালে কখনো জোটে না।

নিজেদের খেয়াল খুশি অনুযায়ী তারা পথ চলে। তারা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কী; এক কথায় তারা ঠিকানাবিহীন।

পথশিশু, ছিন্নমূল বা সুবিধাবঞ্চিত যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন, শহরে চলার পথে এমন হাজারও শিশু দেখা যায়। সুবিধাবঞ্চিত এসব পথশিশুর অনেকের জন্ম হয়েছে শহরের কোনো রাস্তার পাশে। ছিন্ন, নোংরা বস্ত্র আর হাত-পায়ে ময়লা, কাদা লাগানো এসব শিশু আজ এখানে তো কাল ওখানে। চরাঞ্চল, নদী ভাঙন, বন্যা কিংবা সাইক্লোন-ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহারা মানুষদের একটি বড় অংশ ঠাঁই নেয় শহরের বস্তিগুলোয়। এ পরিবারগুলো যে চরম দারিদ্র্যের শিকার, তা বলাই বাহুল্য।

আর এ দারিদ্র্যের কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই পরিবারের বাড়তি আয়ের জন্য রাস্তায় নেমে আসে তারা। অদক্ষ শ্রমিক, বাস-টেম্পোর হেলপার, ড্রাইভারসহ নানা ধরনের পেশায় যুক্ত হতে বাধ্য হয়। পারিবারিক কলহ কিংবা কর্মস্থলে অমানবিক নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়ে এ শিশুদের একটি অংশ পথশিশুদের খাতায় নাম লেখায়। ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ছিনতাইয়ে জড়িয়ে অনেকে পুলিশের খাতায়ও নাম লেখায়।

প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা আনুমানিক ২১-২৪ লাখ। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে পথশিশুদের ৫১ শতাংশ ‘অশ্লীল কথা বলে’, ২০ শতাংশ ‘শারীরিক’ এবং ১৪.৫ শতাংশ ‘যৌন নির্যাতনের শিকার’ হয়। পথশিশুদের ২৫-৩০ ভাগ মেয়ে; তন্মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার। সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহেন্সমেন্ট প্রোগ্রামের (সিপ) গবেষণা অনুযায়ী, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশের ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না।

৮২ শতাংশ নানা ধরনের পেটের অসুখে এবং ৬১ শতাংশ কোনো না কোনো চর্মরোগে আক্রান্ত। একই গবেষণায় বলা হয়েছে, ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ পথশিশু একটি নির্দিষ্ট স্থানে সর্বোচ্চ ছয় মাস থাকে। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ স্থান পরিবর্তন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে আর ৩৩ শতাংশ পাহারাদারের কারণে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, খোলা আকাশের নিচে ঘুমানোর পরও মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুকে মাসিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা হারে মাস্তানদের প্রদান করতে হয়।

পথশিশুরা শিক্ষার আলো থেকে অনেক দূরে; স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্য নেই। অথচ তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ-তাদের যদি সঠিক শিক্ষা, বিশেষ করে নৈতিক শিক্ষা না দেওয়া হয়; তাহলে বাকি জীবনটাও তাদের দুর্বিষহভাবে কাটাতে হবে। আশার কথা, পথশিশুদের শিক্ষার প্রসার, অধিকার আদায় এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান।

এদের মধ্যে ঢাকা আহসানিয়া মিশন, ‘জুম বাংলাদেশ স্কুল’, বাংলাদেশ স্ট্রিট চিলড্রেন ফাউন্ডেশন, দ্য স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্ক, চিলড্রেন ফেরদৌস, জাগো ফাউন্ডেশন, ‘এক রঙা ঘুড়ি’, বিগ স্কুল, ‘শিখনকেন্দ্র’, ওইসআরিয়ান, সুএমবাকোনা ফাউন্ডেশন, নিবরাস ফাউন্ডেশন ইত্যাদি অন্যতম। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাশ্রম, বিবেকের তাড়না ও মনের আনন্দে ভাসমান শিক্ষার্থীদের অক্ষর জ্ঞান দিয়ে থাকে। যদিও করোনার কারণে বর্তমানে তাদের কার্যক্রম অনেকটাই বন্ধ আছে।

সরকারিভাবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ‘পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রম’ এর আওতায় ১৬৪ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই হয়তো চালু হবে এটি। এছাড়া দেশের ৬৪টি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় শতাধিক শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্পের আওতায় দেড় শতাধিক উপজেলায় ২২ হাজারেরও বেশি আনন্দ স্কুলে মোট ৬ লাখ ২৪ হাজার ১০৪ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি ও অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের অনেক স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে শিক্ষা সহায়ক উপকরণ হিসাবে স্কুল ড্রেস, জুতা ও ব্যাগ কেনার জন্য ৫০০ টাকা করে এবং শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রতি মাসে ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করার ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমানে উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছে প্রাথমিকের প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী। ফলে প্রাথমিকে ভর্তি বেড়েছে, ঝরে পড়াও কমেছে। অথচ করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরা।

এসব শিশু বেশিরভাগ সময় দলবদ্ধভাবে চলাফেরা ও বসবাস করে। ফলে এরা নিজে এবং এদের মাধ্যমে অন্যদেরও করোনায় সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাই করোনার কারণে বন্ধ থাকা খালি স্কুলগুলোয় অস্থায়ীভাবে সুবিধাবঞ্চিত এ শিশুদের রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

তাদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চালু থাকলেও করোনা পরিস্থিতিতে সরকারিভাবে তেমন কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন। তাদের ভাসমান স্কুলগুলোও বন্ধ আছে একই কারণে।

আসলে পথশিশুদের শিক্ষা, খেলাধুলা, পুষ্টি, সামাজিক ও মানসিক নিরাপত্তা এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গত দেড় বছরে ঈদসহ অনেক ধর্মীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠান হয়েছে। এ দেশের একজন নাগরিক হিসাবে এসব দিবসে কারও কাছ থেকে কিছু উপহার পাওয়া তো দূরের কথা; পথশিশু এবং তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবক ও শিক্ষকরা কোথায়-কেমন আছে, তাও জানা নেই কারও। উন্নত দেশগুলোয় প্রত্যেক শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্র কোনো না কোনোভাবে পালন করে।

কিন্তু আমাদের দেশে এখনো এটি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। করোনার এ দুর্দিনে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের ভাসমান স্কুলগুলো যারা পরিচালনা করেছিলেন, তাদের আমরা অনায়াসে খুঁজে বের করতে পারি এবং তাদের মাধ্যমে পথশিশুদের হাতে বই, ব্যাগ ও উপহার সামগ্রী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে পারি।

পথশিশুদের ন্যূনতম স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের মানুষের সাহায্য ও সহানুভূতি দরকার। পথশিশুরা যাতে আর ভাসমান না থাকে, সেই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

 

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম