শিক্ষা ‘ব্যয়’ নয়, ‘সামাজিক বিনিয়োগ’

মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গত ৩ জুলাই বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আয়োজনে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের সাম্প্রতিক প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র : ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’র ওপর একটি ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর আগে ১৩ দিনে ১৩টি পর্বে বইটির ওপর আলোচনা হয়। শেষ পর্বে আলোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদ ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর বলেছেন, ‘দেশে বৈষম্যপূর্ণ অর্থনীতি ব্যবস্থা চলছে। এটি মানবসভ্যতার জন্য অবমাননাকর ও হুমকিস্বরূপ। অবিলম্বে বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে আয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব ধরনের আর্থসামাজিক বৈষম্য দূর করা জরুরি।’ ৬৬০ পৃষ্ঠার এ বইটির আদ্যোপান্ত তত্ত্ব-তথ্য-উপাত্তে ঠাসা। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে এমন নিখুঁত আর্থসামাজিক বিশ্লেষণ বিরল। বইটিতে শুধু সমস্যা চিহ্নিত করেই অধ্যাপক বারকাত তার কর্তব্য শেষ করেননি, বরং সমস্যা-সংকট থেকে উত্তরণের উপায়গুলোও বিধৃত করেছেন। এ স্বল্পপরিসরে আমি সমাজ ও রাষ্ট্রের এই বিশাল ক্যানভাস থেকে কেবল শিক্ষাব্যবস্থাকে পৃথক করে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি আছে বললে কম বলা হবে, বরং বলা চলে এর কোনো দর্শনভিত্তিই নেই। কেন শিক্ষা, কার জন্য শিক্ষা, কী ধরনের শিক্ষা- এ রকম কোনো প্রশ্নের উত্তর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই। নীতি-প্রণেতারাও এ নিয়ে তেমন কিছু ভাবেন বলে মনে হয় না। সাধারণভাবে আমরা খালি চোখে যা দেখতে পাই তা হলো, বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থা এদেশে চালু আছে। সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, ইংলিশ ভার্সান ও ইংলিশ মিডিয়াম- এই চার ধারার শিক্ষার্থীরা চারটি ভিন্ন সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠে। কিন্তু একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে যে ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠী প্রয়োজন তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মেটাতে অক্ষম। অবশ্য এ কথা ঠিক, যে কোনো বিভাজিত সমাজ যে কোনো শাসকগোষ্ঠীর জন্য মঙ্গলজনক। সে কারণেই হয়তো শাসকশ্রেণি একটি অভিন্ন পদ্ধতির বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনে অনাগ্রহী। বাজেটের মাস এলেই আমরা শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি তুলি। সাধারণত আমাদের শিক্ষা বাজেট জিডিপির ১ থেকে ১.৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আমরা দাবি করি তা জিডিপির অন্ততপক্ষে ৬ শতাংশ হতে হবে। এরকম দাবি অযৌক্তিক নয়, তবে মনে রাখতে হবে, শিক্ষার দর্শনগত দিকটি পরিষ্কার না করে শুধু অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যাবে না, বরং শিক্ষার নামে অশিক্ষার প্রসার ঘটতে পারে। তবে যদি শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিষ্কার করা যায়, তাহলে ব্যয় বরাদ্দ না বাড়িয়েও সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। সেদিকে লক্ষ্য না রাখলে সরকার শুধু বরাদ্দ বাড়িয়েই বাহবা নেওয়ার চেষ্টা করবে, কাজের কাজ কিছু হবে না।
অধ্যাপক বারকাত গ্রন্থটির ১০ অধ্যায়ের ৫ উপ-অধ্যায়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন। তার ভাষায়, “আমাদের শিক্ষার গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত গলদ। বড় মাপের গলদ। সবচেয়ে বড় গলদটা হলো সব স্তরেই (এবং সর্বত্র) শেখানো হয় ‘কী ভাবতে হবে’ (What to think), শেখানো হয় না ‘কীভাবে ভাবতে হবে’ (Hwo to think)। এ গলদটা সৃষ্টি হয় তখন, যখন শিক্ষা মুক্তচিন্তার পরিবেশ বিনষ্ট করে, যখন মনে করা হয় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের মতোই সহজে অনুশাসনযোগ্য (indoctrinate অর্থে), যখন শিক্ষা ‘সমাজ বৈচিত্র্য’ স্বীকার করে না, যখন শিক্ষা দাবি করে যে সে শ্রেণিনিরপেক্ষ-মতাদর্শনিরপেক্ষ...যখন বিশেষ শাখার শিক্ষা অন্য শাখা-প্রশাখাকে অস্বীকার করে অথবা সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যখন তা হয়ে দাঁড়ায় সংকীর্ণ-গণ্ডিবদ্ধ-কামরামুক্ত (narrow and departmentalized)।’’ এর সঙ্গে যুক্ত হয় এমন ধরনের শিক্ষা, যা জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই অসঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষাদানের প্রতিবাদও হয়েছে। ২০১১ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষার্থীরা এক লিখিত অভিযোগে জানায়, ‘আমরা লক্ষ করছি, অধ্যাপক ম্যানকিউ অর্থনীতি বিজ্ঞানের নামে একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ রক্ষণশীল মতাদর্শ প্রচার করছেন, যা আসলে আমাদের সমাজে সমস্যাসঙ্কুল ও অফলপ্রদ অর্থনৈতিক বৈষম্য চিরস্থায়ী করছে।’ স্নায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষার শুরুটা হয় মাতৃগর্ভ থেকেই। মাতৃগর্ভে স্নায়ুর যথাযথ বিকাশ নিশ্চিত করার ভেতর দিয়েই ঢেলে সাজাতে হবে তাবৎ শিক্ষাব্যবস্থাকে। শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা যা জানব তা অপ্রতুল হলেও যেন বিভ্রান্তিমূলক না হয়। স্টিফেন হকিংয়ের কথাটি মনে রাখা দরকার- ‘জ্ঞানের সবচেয়ে বড় শত্রু অজ্ঞতা নয়; তা হলো জ্ঞানের বিভ্রান্তি।’ আশা করি আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিভ্রান্তির পথ পরিহার করতে সচেষ্ট হবেন।
অধ্যাপক বারকাত বাজারমুখী শিক্ষার ১৯৭৫ থেকে ২০১৯- এই চার দশকের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা আমলে না নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব প্রবণতা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে আছে- মুনাফাভিত্তিক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার, ইংরেজি মাধ্যম ও ভার্সান স্কুল; প্রি-ক্যাডেট, ক্যাডেট, মাদ্রাসা। শিক্ষার সাম্প্রদায়ীকরণ হয়েছে; এই শিক্ষা থেকে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে; শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য প্রকট হয়েছে; অপসংস্কৃতি শ্রবণ-দর্শনে প্রচুর সময়ের অপচয় হয়েছে; সমাজবিচ্ছিন্নতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়েছে; শাসকগোষ্ঠীর নির্লজ্জ তোষণনীতির প্রবণতা বেড়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা বৃদ্ধি আমাদের চিন্তিত করে। তবে চার দশকে যেসব প্রবণতা কমে গেছে তা আমাদের মহাচিন্তিত করবে। শিক্ষকদের নীতি-নৈতিকতা কমে গেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষকসমাজের ভূমিকা নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের ভালোবাসা ও মমত্ববোধ কমে গেছে। সমাজচিন্তক ও সমাজ সংস্কারক হিসাবে শিক্ষকরা এক সময় যে অবদান রেখেছিলেন, তা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। বহুশাস্ত্রীয় জ্ঞানের অবনতি হয়েছে। কমে গেছে বিজ্ঞান-দর্শনের ছাত্রসংখ্যা এবং জ্ঞান-শিক্ষার বৈচিত্র্য অনুধাবনের সক্ষমতা। দেশজ সংস্কৃতিচর্চা নেই বললেই চলে। পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ আমরা হারিয়ে ফেলতে বসেছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রবণতা ও শক্তি কমে গেছে।
সবকিছু বিবেচনায় অধ্যাপক বারকাতের বক্তব্য হলো, ‘‘আমাদের দেশে শিক্ষা এখন পণ্য- কেনাবেচার পণ্য। ‘পাবলিক শিক্ষার’ বিপরীতে এখন ‘প্রাইভেট’ শিক্ষাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবিসহ সাম্রাজ্যবাদী দাতাগোষ্ঠী এসব করতে বাধ্য করছে। ওদের নয়া-উদারবাদী উন্নয়ন মতাদর্শে এসব পূর্বশর্ত যুক্ত আছে। শিক্ষা নিয়ে এমন বাণিজ্যের ফল আর যাই হোক তা মুক্তবুদ্ধির দেশপ্রেমিক ও জ্ঞানসমৃদ্ধ মানুষ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হতে বাধ্য। এক্ষণে আমি যৌক্তিক কারণেই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমাদের মুক্তি চেতনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ শিক্ষা ভাবনার বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে আমরা কোনোভাবেই মুক্তচিন্তার ও মৌলিক চিন্তার দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষ হতে পারব না।’’
যে কোনো ধরনের আলোচনা-সমালোচনায় আমরা দুটি প্রধান সমস্যার সম্মুখীন হই। প্রথমত, সমালোচনার ক্ষেত্রে আমরা শুধু দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করি, সমাধানের কোনো পথ নির্দিষ্ট করি না। দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো, যদিও বা কোনো পথনির্দেশনা থাকে, তাহলে আমরা তা অবলীলায় উপেক্ষা করি কিংবা এড়িয়ে চলি। প্রথম সমস্যাটি সমালোচকের আর দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো নীতি প্রণয়নকারী ও বাস্তবায়নকারীদের। অধ্যাপক বারকাত তার মূল্যবান গ্রন্থটিতে শিক্ষার দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি কোন পথ ধরে এগোলে আমরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব তার একটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন প্রস্তাবনা রেখেছেন। তার প্রধান প্রস্তাবনাটি হলো, ‘সরকারে যে বা যারাই থাকুন না কেন, প্রথমেই নিঃশর্ত স্বীকার করে নিতে হবে যে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানসমৃদ্ধ বিচার বোধসম্পন্ন নৈতিক দৃষ্টিতে উন্নত ও সৌন্দর্যবোধ চেতনায় সমৃদ্ধ পূর্ণাঙ্গ মানুষ সৃষ্টি করা। যে মানুষ ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে মেলবন্ধন সৃষ্টি করতে সহায়ক হবেন; যে মানুষ তার আত্মিক গভীরতার বিকাশের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম; যে মানুষ তার সৃজনপ্রতিভার প্রস্ফুটন ঘটাবেন এবং একই সঙ্গে অন্যদের সৃজনশীল ভাবনা-চিন্তা বিকাশে সহযোগী হবেন, যে মানুষ মানুষে-মানুষে বৈষম্য-অসমতা হ্রাসে উদ্যোগী হবেন, যে মানুষ সমাজ ও প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে নিজের এবং অন্যের জ্ঞানভিত্তিক কল্পনাশক্তির বিকাশ, প্রসারণ ও কর্ষণে প্রভাবক হবেন; যে মানুষ নীতি-নৈতিকতা ও মানবিকতার নিরিখে অন্য সব মানুষের প্রতি সমান আচরণে অভ্যস্ত হবেন; যে মানুষ হবেন প্রগতিচিন্তার সচেতন বাহন; যে মানুষ জ্ঞানকে খণ্ডিত আকারে দেখবেন না, দেখবেন বড় পর্দায়- সমগ্রতার নিরিখে।’ প্রধান এ প্রস্তাবনাকে মাথায় রেখেই আমাদের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা হবে ‘বহুশাস্ত্রীয়’ (multidisciplinary)। বাস্তব জীবনকে কোনো এক শাস্ত্রে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা যাবে না, কারণ জীবন স্থির নয়, গতিময়।
নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের আপসকামী মানসিকতা সব সময়ই নিজেদের একটি গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখে। কোনো ফলদায়ক ও কার্যকর ভাবনার ক্ষেত্রে এই আপসকামিতা অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সব সময়ই বলতে বা বুঝতে অভ্যস্ত- প্রচলিত সমাজ বাস্তবতায় শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব কিনা। এটা আমাদের মানসিক দুর্বলতা এবং নতুনের প্রতি ভয়-শঙ্কা। কিন্তু অন্ধকারের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সাহসী হয়ে ওঠার কোনো বিকল্প নেই। আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করছি। কালের বিচারে ৫০ বছর একটি অতিক্ষুদ্র সময়। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস বিবেচনায় তা অনেকটা পথ। এতটা পথ চলার শেষে এসে আমাদের প্রকৃত মানুষ গড়ার শপথ নিতেই হবে।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়