আশেপাশে চারপাশে
বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা কেন তলানিতে
চপল বাশার
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা এখনো তলানিতে রয়েছে। ১৪০টি শহরের ওপর যে জরিপ সম্প্রতি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের রাজধানীর অবস্থান ১৩৭ নম্বরে। একে তলানি ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? আমাদের প্রিয় নগরী ঢাকার এই দুরবস্থা কেন হলো? এর জন্য দায়ী কে বা কারা? বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রতি বছর ১৪০টি শহরের বসবাসযোগ্যতা নিয়ে জরিপ চালায়। চলতি জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ বছরের জরিপের র্যাংকিং প্রকাশ করা হয়েছে এবং তা ফলাও করে প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে বিশ্বের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে। ২০১৮ সালের জরিপে ঢাকা ছিল ১৩৯ নম্বরে, পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে এক ধাপ উপরে উঠে ১৩৮ নম্বরে যায়। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে জরিপ হয়নি।
এ বছরের জরিপে আরেক ধাপ উপরে উঠে এখন আমাদের অবস্থান ১৩৭ নম্বরে। অর্থাৎ বসবাস-অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান চতুর্থ। তিন বছরের জরিপে ঢাকা শহর দুই ধাপ উপরে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু এই উন্নতি নিয়ে আনন্দিত বা আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই। ঢাকার অবস্থান এখনো বাসযোগ্য শহরের তালিকার তলানিতে। বহু বছর ধরে আমরা তালিকার শেষ দশে ছিলাম, এখনো তা-ই আছি।
ইআইইউ ১৪০টি দেশের সাতটি বিষয়ের ওপর জরিপ চালায়। এগুলো হচ্ছে-সংস্কৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ, শিক্ষা, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও জীবনযাপনের মান। এসব বিষয়ের মান নির্ণয়ের পর পয়েন্ট দেওয়া হয়। সর্বাধিক পয়েন্ট পেয়ে এবার প্রথম স্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড শহর এবং সর্বনিু ১৪০ নম্বরে সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর দামেস্ক।
ইআইইউর জরিপে ঢাকা শহর সবসময় তলানিতে কেন, তা এই শহরে যারা থাকেন-সবাই জানেন। শহরের অবস্থা তারা নিজের চোখেই দেখেন ও অনুভব করেন। জরিপে পর্যবেক্ষণের জন্য যে সাতটি বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম চারটি হচ্ছে পরিবেশ, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও জীবনযাপনের মান। এই চারটিতেই ঢাকা শহর নিঃসন্দেহে অনেক কম পয়েন্ট পেয়েছে, যার ফলে ঢাকা রয়েছে তালিকার শেষ দশ বা তলানিতে।
কোনো শহর বসবাসের উপযুক্ত কিনা তা বিবেচনার প্রথম মাপকাঠি পরিবেশ। ঢাকা শহরের পরিবেশ কেমন তা বলতে গেলে প্রথমে দেখতে হবে পরিবেশ আদৌ আছে কিনা। ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই মহানগরীতে জনসংখ্যা এখন ২ কোটি ১৭ লাখ। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৭,৮০০ জন। এ সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ১৯৭১ সালে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ২২ হাজার। একাত্তরের মার্চ পর্যন্ত ঢাকা ছিল একটি প্রাদেশিক রাজধানী। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ার পর ঢাকা শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়, জনসংখ্যাও দ্রুত বাড়তে থাকে।
ষাট ও সত্তরের দশকের ঢাকার পরিবেশকে এখনকার পরিবেশের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। পরিবেশ অনেক উন্নত ছিল, শহরও ছিল সুন্দর। দেশের জনসংখ্যা কম ছিল, ঢাকা শহরে জনসংখ্যার চাপও এমন ছিল না। প্রশাসনের কেন্দ্র ছিল রাজধানী ঢাকা, সরকারের প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ঢাকাকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হতে থাকে। এর প্রভাব পড়ে শহরের জনসংখ্যার ওপর। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে চার শতাংশের বেশি হারে, সেই সঙ্গে প্রসারিত হয়েছে জনবসতি ব্যাপকভাবে। ঢাকা শহরের বাইরে থেকে, বিভিন্ন জেলা ও গ্রামাঞ্চল থেকে রাজধানীতে মানুষ আসতে থাকে সেই ১৯৭২ থেকে।
প্রশাসনিক কারণ ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা, জীবিকা এবং ঢাকায় সহজলভ্য বিভিন্ন সুবিধার আকর্ষণে এখানে মানুষের আগমন বাড়তেই থাকে। এদের একটা বড় অংশ ঢাকায় স্থায়ীভাবে থেকে যায়। অনেকে ঢাকায় বাড়িভাড়া করে থাকে, ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যায়। পঞ্চাশ বছর আগে এ শহরের জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ, এখন ২ কোটি ১৭ লাখ। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ঢাকার বড় সমস্যা এখন অধিক জনসংখ্যা, যা শহরের ধারণক্ষমতার বেশি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে যদি ৪৭,৮০০ মানুষ বসবাস করে, তাহলে পরিবেশ ভালো থাকে কীভাবে? জনসংখ্যাধিক্য সমস্যা নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের ভাবতে হবে, সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে ঢাকা শহরে গড়ে উঠেছে বস্তি, যার সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ হাজার। সরকারি-বেসরকারি জরিপ থেকে জানা যায় বস্তিবাসীর সংখ্যা ৪০ লাখ। এদের সবাই নিু আয়ের মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ফুটপাতের হকার, ভ্রাম্যমাণ হকার, দিনমজুর ও বিভিন্ন নিুআয়ের পেশায় যুক্ত শ্রমিক। এদের অধিকাংশই সপরিবারে বস্তির একটি ঘরে থাকেন। বস্তির পরিবেশ কেমন তা সবাই জানেন। সেখানে সুপেয় পানি, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই, বাতাস চলাচলের সুযোগও নেই। তবে অনেক বস্তিতেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। যারা ক্ষমতার জোরে বস্তি স্থাপন করে ঘর ভাড়া দেয়, তারাই বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের ব্যবস্থা করে। এভাবেই ৪০ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করে ঢাকার বস্তিগুলোতে। অস্বাস্থ্যকর বস্তিগুলো পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ।
এর পরেই বলতে হয় ‘কংক্রিট বস্তি’র কথা। ঢাকা শহরের সর্বত্র যেভাবে এবং যে হারে সুউচ্চ বহুতল ভবন, দালানকোঠা তৈরি হয়েছে গত পঞ্চাশ বছরে কোনো নিয়মনীতি না মেনে, তার ফলে পুরো শহরটাকে কংক্রিটের বস্তি বললে অন্যায় হবে কি? এ প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত আছে। বহুতল ভবন বা পাকা বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মানতে হয়, যাতে পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকে। এজন্য ‘রাজউক’ নামে একটি সংস্থা আছে। রাজউক নতুন ভবন বা বাড়ি তৈরির নকশা অনুমোদন করে, শহরের ভূমির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে, যাতে পরিবেশ নষ্ট না হয়। শুধু নকশা অনুমোদন নয়, নকশা মোতাবেক ভবন তৈরি হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখাও তাদের দায়িত্ব। কিন্তু রাজউক কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে বা করছে? কেউ যদি একটু সময় নিয়ে ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে দেখেন, তাহলে দেখবেন ভবনগুলো গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে। দুই ভবনের মধ্যে যতটুকু ব্যবধান থাকার কথা তা নেই।
আরামবাগ এলাকায় গেলে দেখা যাবে সরু গলির দুপাশে পাশাপাশি নয়তলা ভবন দাঁড়িয়ে আছে একটার পর একটা। ভবনগুলোর মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই বললেই চলে। সরু গলিতে আবার উপগলি আছে বেশ কয়েকটি। সেখানেও নয়তলা ভবন একটার পর একটা। অথচ উপগলিতে রিকশা যাওয়ারও উপায় নেই। এ আরামবাগে একাত্তর সালে এবং তার পরেও সব বাড়ি ছিল একতলা। খোলা জায়গা ছিল অনেক। আরামবাগের মতো বহু এলাকা রয়েছে এ শহরে, যেখানে সুউচ্চ ভবন দাঁড়িয়ে আছে গাদাগাদি করে। সেখানে আকাশও নেই, বাতাসও নেই। এসব ভবন নির্মাণের অনুমতি রাজউক কীভাবে দিয়েছে, নির্মাণের সময়ে বা পরে নজরদারি করেছে কিনা, তার উত্তর রাজউক কর্তৃপক্ষের কাছে পাওয়া যায় না। রাজউকের ‘কল্যাণে’ এখন ঢাকা শহরে খোলা জায়গা নেই, মাঠ নেই, পুকুর নেই।
পরিবেশ প্রসঙ্গে বায়ুদূষণের কথা বলতেই হয়। ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ মাঝে মাঝে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে মনে হয় এখানে অক্সিজেন নেই। বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে। তাদের তথ্যমতে, এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ। পরিবেশমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন একটি বার্তা সংস্থার কাছে স্বীকার করেছেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। এর জন্য তিনি দায়ী করেছেন বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্প থেকে নির্গত ধুলাবালি, মোটরগাড়ি ও বাস-ট্রাকের ধোঁয়া এবং ঢাকা শহরের আশপাশের ইটভাটাকে, যেখান থেকে প্রচুর কালো ধোঁয়া শহরের উপর ভেসে আসে। এসব বন্ধে কী ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ নিয়েছে, তা অবশ্য জানা যায়নি।
বায়ুদূষণের জন্য দায়ী যান্ত্রিক যানবাহনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকারি হিসাবে ঢাকা শহরে ইঞ্জিনচালিত মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদির সংখ্যা ২ লাখ ৭ হাজার ৫০০। এর ৮০ শতাংশ রেজিস্ট্রার্ড। রেজিস্ট্রার্ড বা আনরেজিস্ট্রার্ড যাই হোক না কেন, অধিকাংশ যান্ত্রিক বাহন, বিশেষ করে বাসগুলোর যে ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই তা দেখেই বোঝা যায়। করোনাকাল শুরু হওয়ার আগে মাঝে মাঝে শহরে ট্রাফিক সপ্তাহ পালিত হতো।
সে সময় শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ও মোড়ে মোবাইল কোর্ট বসত, গাড়ি ও যান্ত্রিক বাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট, ড্রাইভারের লাইসেন্স ইত্যাদি কাগজপত্র পরীক্ষা করা হতো। যখন ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হতো, তখনই শহরের রাস্তা থেকে অধিকাংশ বাস উধাও হয়ে যেত। কারণ তাদের কাগজপত্র ঠিক নেই, ফিটনেস সার্টিফিকেট, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। ট্রাফিক সপ্তাহ শেষ হলে ভাঙাচোরা বাসগুলো আবার ফিরে এসে চলাচল করত। ফিটনেসবিহীন বাসগুলোই বায়ুদূষণ বাড়ায়, দুর্ঘটনা ঘটায় অহরহ। এদের নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই।
ঢাকার রাস্তায় যানজট সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো এককালে প্রধান রাস্তাগুলোতে পর্যাপ্ত ট্রাফিক সিগনাল ছিল, যা দিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ট্রাফিক সিগনালগুলো কোথায় উধাও হয়ে গেল? এখন ট্রাফিক পুলিশ হাত দেখিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে। এসব দেখে ঢাকাকে সভ্য শহর বলা যায় কি? শহরের রাস্তায় রিকশাও একটি বড় সমস্যা। রিকশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশন ও পুলিশের। সিটি করপোরেশন ঢাকা শহরের জন্য কোনো এককালে ৮৬ হাজার রিকশাকে লাইসেন্স দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এখন কত রিকশা চলাচল করে তার কোনো হিসাব নেই। কর্তৃপক্ষ বলে, পাঁচ লাখের মতো হবে। পরিবেশবাদীরা বলেন, দশ লাখ তো হবেই। অনিয়ন্ত্রিত রিকশা ট্রাফিক চলাচল বিঘ্নিত করে ব্যাপকভাবে। নিয়ন্ত্রণের চিন্তাভাবনা কর্তৃপক্ষের আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকার রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটা যায় না। ফুটপাতের দু’পাশেই হকার বসে, ফলে পুরো ফুটপাতই তাদের দখলে চলে যায়। মানুষ হাঁটবে কীভাবে? পরিবেশ দূষণের এটাও বড় কারণ। ভাঙাচোরা রাস্তা আর জলাবদ্ধতা এখন শহরের স্বাভাবিক দৃশ্য। বৃষ্টি হলেই বেশিরভাগ রাস্তায় পানি জমে যায়। জলাবদ্ধতা দূর করার দায়িত্ব ওয়াসার, না সিটি করপোরেশনের? নাকি উভয়ের? দায়িত্ব যারই হোক, বিদ্যমান বাস্তবতা হচ্ছে জলাবদ্ধতা ছিল, আছে এবং মনে হয় থাকবে। কারণ পরিস্থিতির উন্নতি চোখে পড়ছে না।
বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার স্থান তলানিতে কেন, সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পরিবেশ ও অবকাঠামো নিয়ে কিছু বলা গেল। স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। শুধু বলতে চাই, আমি এবং আমরা ঢাকা শহরকে ভালোবাসি। আমরা তলানিতে থাকতে চাই না। সুন্দর ঢাকা শহর ফিরে পেতে চাই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো বিষয়টি নিয়ে ভাববে কি?
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক