তৃতীয় মত
আদর্শবাদী তরুণরা কেন রাজনীতিতে নেই
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
বহুদিন পরে বিএনপি নেতাদের কণ্ঠে দুটি সত্য কথা শোনা গেল। একটি কথা বলেছেন, দলের সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল। আরেকটি কথা বলেছেন, দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। মির্জা ফখরুল বলেছেন, আন্দোলনে তরুণদের যুক্ত করতে না পারা বিএনপির ব্যর্থতা। তিনি বলেছেন, পৃথিবীতে যা কিছু হয়েছে, সবই তরুণদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হয়েছে। এখন তরুণরা কোথায়? দেখছি না। আমাদের ব্যর্থতা সেখানেই। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের ব্যর্থতা এখন পর্যন্ত তরুণদের সামনে আনতে পারিনি। গণতন্ত্র ও অধিকার রক্ষার জন্য তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন আরও স্পষ্ট কথা। তার মতে, দলে এখন সবাই নেতা। কেউ কর্মী হতে চায় না। বিএনপিতে শতকরা ৮০ জন নেতা এবং ২০ জন মাত্র কর্মী আছে। এই দুই নেতার এত বিলম্বে সত্য উপলব্ধি দেখে বিস্মিত হয়েছি। এই সত্যটা যদি তারা আরও আগে বুঝতে পারতেন, তাহলে বিএনপির এই দুর্দশা ঘটত না।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, তার দলে এখন ২০ ভাগ মাত্র কর্মী। আমার ধারণা তা-ও নেই। ছাত্রদল ও যুবদলের নামে কিছু সন্ত্রাসী তাদের দলে আছে। সৎ ও ভালো মানুষ আছে কিনা সন্দেহ। কারণ, বিএনপি যখন গঠিত হয়, তখন কোনো আদর্শকে ভিত্তি করে গঠিত হয়নি। অস্ত্রের বলে ক্ষমতা দখল করে বিভিন্ন দলছুট নেতা ও কর্মী জোগাড় করে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে তার দল গঠন করেছিলেন। বিএনপি যতদিন ক্ষমতায় ছিল ততদিন তাদের লুটপাটের সদস্য কম ছিল না। আজ তারা ক্ষমতায় নেই দীর্ঘসময় ধরে। মধুর চাক থেকে তাই মৌমাছিও পালিয়ে গেছে। দল যদি গঠিত হতো কোনো আদর্শকে সামনে রেখে, সামনে এগোতো জনগণের দাবি নিয়ে, জনগণের সমর্থন নিয়ে সংগঠিত হতো, তাহলে আজ তারেক রহমানকে বিদেশে এবং খালেদা জিয়াকে জেলে পচতে হতো না। জনগণই তাদের মাথার মুকুট করে তাদের মাঝে ফিরিয়ে আনত। মির্জা ফখরুলদের তাই আজ হায় হায় করতে হচ্ছে তারা তরুণদের দলে টানতে পারেননি। তিনি ঠিকই বলেছেন, পৃথিবীতে যা কিছু হয়েছে আদর্শবাদী তরুণদের দ্বারাই হয়েছে। বিএনপি গঠনের সময় রক্তপাত-হত্যা ছাড়া তরুণদের সামনে কী আদর্শ দেখানো হয়েছে যে, তারা দলটিতে যোগ দিতে আগ্রহ বোধ করবেন? আওয়ামী লীগ যে আজ প্রায় শতাব্দীকাল ধরে টিকে আছে, তার কারণ একটি আদর্শবাদের ভিত্তিতে দলটি তৈরি হয়েছিল। সেই আদর্শ হচ্ছে শেখ মুজিবের আদর্শবাদ- অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীন সোনার বাংলা। মূলত এই আদর্শের টানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি তরুণরা আওয়ামী লীগে এসে ভিড় করেছিল।
এখন মির্জা ফখরুল বলুন, তার দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কোন আদর্শের ভিত্তিতে? যে ব্যক্তি বা যারা জাতির পিতা এবং জাতীয় নেতাদের হত্যা করে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাদের কাছে ক্ষমতার মধু ছাড়া কোনো আদর্শবাদ ছিল না। তরুণরা তাদের দিকে আকৃষ্ট হবেন কেন? আওয়ামী লীগ একটার পর একটা আন্দোলন করেছে, জয়ী হয়েছে, ক্ষমতায় বসেছে। বিএনপি সাড়ে তিন বছর রাজপথে একটানা সন্ত্রাস চালিয়েছে, তাতে কোনো আদর্শবাদ ছিল না। আদর্শবাদী তরুণরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হবেন কেন? ফলে আজ কর্মীহীন দলে কেবল নেতা বাড়ছে। এইসব নেতাও হচ্ছেন সুবিধাবাদী। আজ দল ক্ষমতায় নেই, তাই তারা ঘরে বসে ‘শহিদ জিয়ার’ নামে রাজনীতি করতে চাইছেন। যেখানে শহিদ জিয়ারই কোনো রাজনীতি নেই, বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় বসা ছাড়া সেই দল তরুণদের কাছে কী আদর্শবাদ তুলে ধরবে? মির্জা ফখরুল একসময় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। একটি বাম আদর্শবাদী দল। সেই দল ছেড়ে তিনি কী কারণে সম্পূর্ণ উলটাপথের রাজনীতিতে এলেন? তা-ও কি ক্ষমতা এবং পদের লোভে নয়? আজ সময় এসেছে মির্জা ফখরুল, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রমুখদের আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসমীক্ষা করা। স্বাধীনতার শত্রুদের কোল থেকে উঠে এসে দলটিকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে গড়ে তোলা।
আমাদের একটি সুস্থ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। তা হবে জাতীয় সংসদের ভেতরে এবং রাজপথে। তারা জাতির পিতাকে অস্বীকার করবে না, মূল জাতীয় আদর্শগুলোকে ধ্বংস করতে চাইবে না। তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করবে, শেখ হাসিনার বিরোধিতা করবে, কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের মূল আদর্শের বিরোধিতা করবে না। তাহলে দেশের মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে, তরুণদের কাছে বিএনপি একটি আদর্শমূলক রাজনীতি তুলে ধরতে পারবে। তরুণরাও দলটিতে আসবে। জিয়ার তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, তারা আসবেন নতুন যুগের উপযোগী নতুন বাংলাদেশ গড়ার আদর্শের টানে। আওয়ামী লীগ যখনই দেশ শাসনে ব্যর্থ হবে, তখনই এই নতুন বিএনপি জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসবে। আবার যখন তারা জনসমর্থন হারাবেন, তখন পরাজয় মেনে কোনো চক্রান্তের আশ্রয় না নিয়ে ক্ষমতা বিজয়ী দলের হাতে অর্পণ করবেন। তাহলে দেশে সুস্থ দ্বিদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। বিএনপিকে দিশেহারা হয়ে এখানে-সেখানে ঘুরতে হবে না। অতীতের ফসিল নেতাদের ভাড়া করে এনে নির্বাচনে যেতে হবে না।
আরও একটি কথা, বিদেশে থাকা তাদের নেতা তারেক রহমানকে তারা সংযত হতে বলুন। তার কথাবার্তায় দেশের রাজনীতি কলুষিত হচ্ছে। তার উচিত জেলের ভয়ে দেশে ফিরতে না চাইলে দলের নেতৃত্ব অপর কোনো যোগ্য ব্যক্তির হাতে অর্পণ করা। তাহলে দল বাঁচবে। দেশ বাঁচবে। তিনিও বাঁচবেন।
এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কথা। এই দলের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং তার আদর্শের টানে শ’য়ে শ’য়ে তরুণ এই দলে এসেছে। তাদের অনেকে জেলে জীবন কাটিয়েছেন, রাজপথের আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন। সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছেন। আজ আওয়ামী লীগ আরও বড় হয়েছে, কিন্তু তখনকার ত্যাগী, আদর্শবাদী তরুণরা কোথায়? লজ্জায় মাথা হেঁট হয় যখন দেখি, পত্রিকায় পড়ি-সন্ত্রাস, লুটপাট, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি বড় বড় অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের এক শ্রেণির নেতা ও কর্মী। সংগঠন হিসাবে আজ আওয়ামী লীগ একেবারেই দুর্বল। তার শক্তি শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা। এই শক্তির বলে দলটি এখনো ক্ষমতায় আছে। মাইনাস শেখ হাসিনা এই দলটির অবস্থা কী হবে তা ভাবতে পারি না। সরকারেও আমলাতন্ত্রের প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী। আওয়ামী লীগ এবং সরকার দিনদিন জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অনেক উন্নতি করেছে। অর্থনীতি মজবুত করেছে। কিন্তু সামাজিক অবক্ষয় বন্ধ করতে পারেনি। সরকার ধর্মান্ধদের অনেক দেরিতে তাড়া করছে। কিন্তু তারা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। দেশে আরও কয়েক হাজার সরকারি মসজিদ নির্মাণ করে ধর্মান্ধদের তোল্লা দেওয়া হবে। প্রকৃত ধর্মকে সাহায্য দেওয়া হবে না।
সরকারি মেকানিজমের সাহায্যে এবং শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা পুঁজি করে আওয়ামী লীগ হয়তো আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে চাইবে। কিন্তু আমার ধারণা দল সুসংগঠিত না হলে, দলের হাইব্রিড অংশকে দমন করা না হলে, দুর্নীতির রাশ টানা না হলে, আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে কঠিন হতে পারে। এই সতর্কবাণীটি আগেই দিয়ে রাখছি। কেবল উন্নয়নের জপমালা আওড়িয়ে জনগণকে ভোলানো যাবে না। ষাটের দশকে আইয়ুব খান উন্নয়নের দশক পালন করেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, ডেভেলপমেন্ট রাদার দ্যান ডেমোক্রেসি। উন্নয়ন দশক পূর্ণ করার উৎসবের মধ্যেই আইয়ুব সরকারের পতন হয়। ১৯৪৫ সালে চার্চিলের নেতৃত্বে ব্রিটেন হিটলারকে পরাজিত করে। চারদিকে চার্চিলের জয়জয়কার। সেই বছরেই সাধারণ নির্বাচনে চার্চিল পরাজিত হন। জনমতের গতি-প্রকৃতি অনেক সময় অনুমান করা দুঃসাধ্য। আজ যাকে তারা জয়ধ্বনি দেয়, কাল তাকে নর্দমায় ফেলে দেয়। ১৯৪০ সালে ফজলুল হককে শেরে বাংলা খেতাব দিয়ে মানুষ জয়ধ্বনি করেছে। ১৯৪৬ সালে তাকে গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়েছে। এত বড় কংগ্রেস দল, যে দলটি ভারত স্বাধীন করেছে, ষাট বছর ক্ষমতায় রয়েছে, সেই দলের আজ পাত্তা নেই। গান্ধী-নেহেরু নামের তাবিজ দিয়ে দলটি টিকতে পারছে না। আওয়ামী লীগের উচিত পেছন ফিরে তাকিয়ে ইতিহাসের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া। আজ বিএনপিতে তরুণরা নেই, কাল হয়তো তারা আওয়ামী লীগেও থাকবে না। সময় থাকতে আওয়ামী লীগ সাবধান হোক।
লন্ডন, ১৩ জুন রবিবার, ২০২১