শিক্ষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে
ড. মো. কামরুজ্জামান
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
বিভিন্ন দেশের সরকারি হিসাবমতে, করোনার ছোবলে বিশ্ব থেকে ঝরে পড়েছে ৩৫ লাখ মানুষ। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণামতে, এ সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ লাখ হবে। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব ১৪ মাস ধরে বিভীষিকাময় এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আর এ বিভীষিকা গরিব দেশগুলোর ওপর ভয়াল থাবা বিস্তার করে চলেছে। বিশেষত অনুন্নত দেশগুলো ভয়ংকর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা বাংলাদেশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফলে দেশের অনেকে চাকরি হারিয়েছেন; দারিদ্র্য বেড়ে গেছে। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকেরই অবনমন ঘটেছে। দেশের আমদানি-রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতের ক্ষতির পরিমাণ ৮৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সবে এলডিসি অতিক্রম করেছে। দারিদ্র্য দূর হয়নি; বরং বেড়েছে। বিবিএসের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলে ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ। দেশে আজও অধিকাংশ ভূমিহীনের ঘরের ব্যবস্থা হয়নি। দেশের বেকার সমস্যার সমাধান হয়নি। বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী, সার্বিকভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। আর এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা প্রথম শ্রেণি পেয়েছে, তাদের মধ্যে বেকারত্ব ১৯ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ; বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার।
করোনায় ৭০ শতাংশ মানুষকে নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত বেকার থাকতে হয়েছে। আর কাজে যোগদান করলেও ৬৩ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে তাদের জীবনমানের অবনতি ঘটেছে। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও চাকরি হারিয়েছে প্রতি তিনজনে একজন। করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা একে তো কর্মমুখী নয়; অপরদিকে যা-ও আছে, তা-ও করোনার কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
দেশে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ কোটির ওপরে। মোট জনশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এ বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই শিশু ও কিশোর। এ শিশুরাই হচ্ছে আগামীর বাংলা গড়ার কারিগর। তাদের মধ্যেই লুকায়িত আছে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। করোনাভাইরাসে শিশু আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও তারা এ ভাইরাসের নীরব শিকারে পরিণত হয়েছে। করোনাজনিত দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও ক্ষুধা শিশুর মনোজগতে বাধা সৃষ্টি করেছে। একদিকে পরিবারে খাদ্য সংকটের কারণে তারা অপুষ্টিতে ভুগছে, অন্যদিকে ঘরবন্দি শিশুরা একাকিত্বে ভুগছে। সারা দিন প্রচার মাধ্যমে মৃত্যু নিয়ে আলোচনা, মা-বাবার করোনাজনিত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, পরিবারের আয়-রোজগার নিয়ে অনিশ্চয়তা আর চারদিকে শুধু শঙ্কার আবহ শিশুদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
দরিদ্র পরিবারে চাল নেই, চুলা নেই, আয় নেই, টাকা নেই, ঘরে খাবার নেই, সংসার চালানোর উপায় নেই, দুর্দিনের শেষ নেই-সামনে কী হবে ইত্যাদি দুশ্চিন্তার আলোচনা শিশুদের বিষণ্নতায় ঘিরে ধরেছে। চারদিকে মৃত্যুর মিছিল শিশুর বুদ্ধিবিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে এসব শিশু একাকী নির্জনে বসে ইন্টারনেটে সময় পার করছে। প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন নতুন শিশু ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আর দিনে যুক্ত হচ্ছে ১ লাখ ৭৫ হাজার শিশু। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ২৫ শতাংশই শিশু। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ করোনায় ৬৫ শতাংশ শিশুর মোবাইল ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি আসক্তি বেড়েছে। ২০১৯ সালের গার্ডিয়ান কমনসেন্স-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, আমেরিকার ৬৯ শতাংশ ১২ বছর বয়সি শিশু স্মার্টফোনে অভ্যস্ত। আমেরিকার কমিউনিটি সার্ভে অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৩-১৮ বছর বয়সি ৯৪ শতাংশ শিশুর জন্য বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ ছিল।
বর্তমানে অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার সুবাদে শিশুরা ইন্টারনেট বেশি ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। অনেকে এর প্রতি আসক্তও হয়ে পড়েছে। এনবিসি নিউজের তথ্যানুযায়ী, ৮-১২ বছরের একটি শিশু দিনে মোট ৬ ঘণ্টা মোবাইল বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করছে। করোনায় এর ব্যবহার আরও ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের শিশুরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকার স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের প্রায় ৮০ শতাংশ শিশুই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এসব শিশু মোবাইল ফোনে অগণিত গেমে আসক্ত। ফ্রি ফায়ার, পাবজি, মাইনক্র্যাফট, টাউনশিপ, লুডোকিং, টেম্পেল রান, জিটিএভি, ক্লাশ রয়েল, ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান্স ইত্যাদি গেমরুপি বাজিতে মারাত্মক আসক্ত হয়ে পড়েছে শিশুরা। গেমের পাশাপাশি পর্নোগ্রাফিতেও তারা আসক্ত; যা অভিভাবকমহলে রীতিমতো উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এ আসক্তি মাদকের চেয়েও ভয়ানক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাতে পারে। এ আসক্তি পরিবার ও সমাজে ইতোমধ্যে বিপর্যয় ডেকে আনতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। তারা বাবা-মা ও মুরব্বিদের অবাধ্য হয়ে গেছে। গ্রাম-গঞ্জে চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে নিপতিত হচ্ছে। তাদের সামাজিক দক্ষতা লোপ পাচ্ছে। মানবিক গুণাবলি হ্রাস পাচ্ছে। তারা লেখাপড়ায় মনোযোগ হারাচ্ছে। মেজাজের ভারসাম্য হারাচ্ছে। অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারে শিশুদের চোখের কর্ণিয়া ও রেটিনার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণে শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে আজ শিশুরা পড়ালেখা ভুলে যেতে বসেছে। শিশুদের বাঁচাতে তাই শিক্ষাকে বাঁচানো প্রয়োজন। শিক্ষা আজ রাজনীতির মারপ্যাঁচে বন্দি হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে জাতি কাঙ্ক্ষিত সময়োপযোগী ভূমিকা পাচ্ছে না। তারা ইউজিসিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পোস্ট-পদবি পেতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তিত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে অধ্যাপকরা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের তৈলমর্দনে ব্যস্ত আছেন। এক্ষেত্রে দৈনিক যুগান্তরের একটি প্রতিবেদন লক্ষণীয়। ওই প্রতিবেদনে একজন পিয়নের বরাতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভিসি হওয়ার জন্য তাদের পা ধরতেও বাকি রাখে না। ওই একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-ভিসি, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, প্রভোস্ট, হাউস টিউটর ইত্যাদি পদ পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্ষমতাসীনদের ব্যাগ বয়ে বেড়ান। ক্ষমতাসীন মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের পিএস, এপিএস; এমনকি পিয়নদেরও পদলেহন করেন (যুগান্তর, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯)। অন্যান্য স্তরের শিক্ষকদেরও একই অবস্থা। নেতা হওয়ার নেশায় শিক্ষকরা তাদের মর্যাদাকে পদতলে পিষ্ট করছেন। শিক্ষকদের ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ উদ্ধারের নিরন্তর বাসনার নিষ্ঠুর বলির শিকার আজ ৫ কোটি শিশুর জীবন।
খ্যাতিমান শিক্ষাবিদদের নীরবতা এ শিশুদের জীবন আরও অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনীতির মারপ্যাঁচ থেকে শিক্ষাকে বাঁচাতে তাই শিক্ষাবিদদের এগিয়ে আসা জরুরি। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি পরিহার করতে হবে। শিক্ষাকে বাঁচাতে হবে; শিশুদের বাঁচাতে হবে, তাহলেই দেশ বাঁচবে। শিক্ষকদের মেরুদণ্ড সোজা করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যাংক-বিমা খোলা আছে। হাট-বাজার খোলা আছে। শিল্প-কলকারখানা খোলা আছে। অফিস-আদালত খোলা আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে ঠিকঠাকভাবে। যানবাহন যথারীতি চলাচল করছে। স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হলেও জনগণের কাছে এর গুরুত্ব খুব একটা নেই। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কোনো মানে হয় না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে-
অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহে পাঁচ দিন খোলা থাকে। এ পাঁচ দিনে পাঁচটি বর্ষের ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। সপ্তাহের প্রথম দিনে প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় দিনে দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় দিনে তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ দিনে চতুর্থ বর্ষ ও পঞ্চম দিনে মাস্টার্সের ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। যেসব কলেজে অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স চালু আছে, এসব প্রতিষ্ঠানে এ একই নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে। ডিগ্রি কলেজগুলোতে প্রথম দিন ডিগ্রি ও দ্বিতীয় দিন ইন্টারসেকশনের ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। হাইস্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে পাঁচ দিনে পাঁচ শ্রেণির ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। ঠিক প্রাথমিকেও এ একই নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে। মন্দের ভালো হিসাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মাধ্যমে অন্তত এভাবে শিশুদের বাঁচাতে স্কুলমুখী করা যেতে পারে। বরেণ্য ও প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে আরও সুন্দর এবং সময়োপযোগী পদ্ধতি প্রকাশের দাবি করছি। শিক্ষা, শিশু ও জাতিকে বাঁচাতে তাদের কাছে আশু পদক্ষেপ কামনা করছি। অন্যথায় জাতি এর চেয়েও ভয়াবহ অন্ধকার অমানিশার দিকে ধাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।
ড. মো. কামরুজ্জামান : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
dr.knzaman@gmail.com