মিঠে কড়া সংলাপ
জনগণের টাকার লুটপাট কবে বন্ধ হবে?
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে এবার আরও বড় আকারের বাজেট পেশ করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই প্রথম ছয় লাখ তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি অঙ্কের টাকা খরচের সংস্থান রেখে বাজেট প্রণয়ন করায় এবারের বাজেট অন্যান্য বছরের তুলনায় আরও বেশি অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা অর্জন করেছে। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনা সংকট মোকাবিলায় অগ্রসরমান আমাদের মতো একটি দেশ ও জাতির জন্য এবারের বাজেট অতীতের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। করোনা সংকট মোকাবিলাসহ প্রায় ১৮ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, রাস্তাঘাট ও রেলপথ উন্নয়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষাসহ ব্যবসা বাণিজ্যে গতি সঞ্চারণ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবারের বাজেটের ভূমিকার দিকে দেশ ও জাতি এখন গভীর আগ্রহ সহকারে তাকিয়ে আছে। কারণ একটি সঠিক বাজেট এ ক্ষেত্রে যেমন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সুফল বয়ে আনতে পারে, ঠিক তেমনি একটি ত্রুটিপূর্ণ বাজেট দেশ ও জাতির ভাগ্য বিপর্যয়ও ঘটাতে পারে! সুতরাং বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে সব সময়ই একটি ঘাটতি বাজেট প্রণয়নের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ সরকারের আয় অপেক্ষা ব্যয়ের পরিমাণ বেশি দেখিয়ে বাজেট প্রস্তুত করা হয়। আর পরবর্তীকালে সরকারকে ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণ ছাড়াও বন্ড, ডিবেঞ্চার ইত্যাদির মাধ্যমে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয়। আবার, যেসব উৎস বা খাত থেকে সরকারের আয়ের হিসাব দেখানো হয়, সেসব ক্ষেত্র থেকেও কাক্সিক্ষত আয় অর্জন সম্ভব হয়ে ওঠে না। আয়কর, ভ্যাট ইত্যাদির মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ধার্য করা হয়, কোনো বছরেই তা অর্জন করা সম্ভব হয় না। তবুও বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে একইভাবে একই ফরমুলায় ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করার নিয়ম এবং নীতি চালু রয়েছে। কোনো বছরেই বাজেটে নতুনত্ব বা কোনো চমক কেউ দেখাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ফলে প্রায় প্রতি বছরই এক একটি গতানুগতিক বাজেট জাতিকে উপহার দেওয়া হয়। আর এ বছরও তার কোনো ব্যতিক্রম দেখা গেল না। এবারে বরং সর্বকালের সবচেয়ে বড় ঘাটতি বাজেট পেশ করা হলো। যাক সে কথা। সামনের দিনগুলোতে অর্থনীতির পণ্ডিতসহ বিজ্ঞ ব্যক্তিরা বাজেট নিয়ে যেসব আলোচনা-সমালোচনা করবেন, সেদিকে চোখ রাখলেই আমরা বিষয়টি আরও ভালোভাবে বুঝতে ও জানতে পারব। আজ আমরা এখানে জনগণের টাকায় প্রণীত বাজেটের অর্থ যাতে নয়ছয় না করা হয়, অর্থাৎ জনগণের অর্থ নষ্ট না করে জনগণের কল্যাণে তা সঠিকভাবে খরচ করা হয়, সে বিষয়েই সবিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই।
আমরা জানি, বাজেটে ব্যয় বরাদ্দের সিংহভাগ অর্থই সারা দেশের রাস্তাঘাট, রেলপথ, কালভার্ট, ব্রিজ, ফ্লাইওভার, ভবন, বাঁধ ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করা হয়। সাধারণভাবে আমরা যাকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বলে থাকি। আর এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ঠিকাদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে। কিন্তু এই ঠিকাদারি ব্যবস্থা যে কী এবং ঠিকাদারি ব্যবসা কাকে বলে ইতোমধ্যে সারা দেশের মানুষই তা জেনে গেছেন। একেকটি বালিশের মূল্যও যে কয়েক হাজার টাকা হতে পারে এবং একটি বালিশ ভূমি থেকে উপর তলায় উঠাতেও যে কয়েক’শ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়ে থাকে, সে বিষয়টিও এখন সবার জানা।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাজেটে যে অর্থ ব্যয় বরাদ্দ দেখিয়ে তা খরচ করা হয়, তার উৎস কী বা তার জোগানদাতা কে বা কারা সে বিষয়টিও আরও ভালো করে ভেবে দেখা প্রয়োজন। কারণ আমাদের দেশের লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেটের অর্থে প্রতি বছর যারা লাভবান হয়ে থাকেন, বা বাজেটে খরচকৃত অর্থ যাদের পকেটে ঢোকে, সাধারণত তারা কিন্তু বাজেটের অর্থের জোগান দেন না। বরং দেশের দিনমজুর, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কোটি কোটি অতি সাধারণ মানুষের ভোগ্যপণ্যসহ অন্যান্য সেবা গ্রহণের ওপর বসানো করের টাকাও বাজেট প্রণয়নে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া যেসব বড় করদাতার কাছ থেকে কর আদায় করা হয়, তারাও দিনরাত পরিশ্রম করে বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে শ্রমিক খাটিয়ে অর্থ উপার্জন করে সরকারকে কর দিয়ে থাকেন। আর সেসব কলকারখানার মালিক এবং শ্রমিকরা বাজেট থেকে কে কতটুকু সুবিধা পান তা আমরা সবাই জানি। বরং পরিশ্রম করে টাকা উপার্জনকারী এই শ্রেণির করদাতাদের পেছনেই আয়কর বিভাগ দিনরাত লেগে থেকে সব সময় তাদের ওপরই চাপ সৃষ্টি করে। যে শ্রেণির ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাজেট থেকে প্রতিবছর বিভিন্নভাবে সুবিধা নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। কারণ তারা এসব অর্থ বিদেশে পাচার করে দিয়ে সেসব স্থানে বাড়ি কেনাসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। আবার বাজেটেও তাদের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
অথচ একজন দিনমজুর, শ্রমিক, রিকশাওয়ালাকে একটি বিড়ি ফুঁকতে বা মোবাইলে এক মিনিট কথা বলতেও বাজেটের টাকা জোগান দিতে হয়। তা ছাড়া একজন কেরানি, গার্মেন্টকর্মী, বেসরকারি অফিসের কর্মচারী, সংবাদকর্মীসহ এসব শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষের ব্যাংক হিসাব থেকে সারচার্জ, লেভি, ভ্যাট, ট্যাক্স ইত্যাদির টাকা কেটে রেখে সেসব অর্থও বাজেটে ঢোকানো হয়। আবার যেসব শ্রমিক বিদেশের মাটিতে দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠান, তপ্ত মরুভূমির আগুনে পুড়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার স্ফীত করেন, তারাও বাজেট থেকে সুবিধা গ্রহণ করেন না। বরং তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রাও নয়ছয় করা হয়, আমদানির নামে বৈদেশিক মুদ্রা লোপাট করা হয়। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালসহ, বাংলাদেশ বিমান ইত্যাদি অন্যান্য সংস্থায় দশ টাকার জিনিসের বিশ টাকা মূল্য দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়। তা ছাড়া আমদানি রপ্তানির নামে ওভার ইনভয়েসিং-আন্ডার ইনভয়েসিং করেও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়। আর এসব কর্মকাণ্ড করে থাকেন এ দেশের বিশেষ এক শ্রেণির এলিট ক্লাস, যাদের বেশিরভাগই হলো রাজনীতি করে খাওয়া ব্যক্তি! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনীতি করে খাওয়া ব্যক্তিরাই বাজেটের টাকা টেন্ডারবাজির মাধ্যমে লুট করে, বিদেশে পাচার করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আর টেন্ডারবাজির ক্ষেত্রে এদেশে সব রাজনৈতিক দলের চরিত্র একইসূত্রে গাঁথা।
এখানে একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিএনপি ঘরানার একজন ঠিকাদারকে জানি ও চিনি, বর্তমানে তিনি অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, এমনকি ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডেও তার সদম্ভ পদচারণা রয়েছে। তো প্রায় দশ বছর আগে যখন দেখলাম যে, বড় বড় সব ঠিকাদারি কাজ তিনি নিজেই বাগিয়ে নিচ্ছেন, তখন একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে তার জবাব শুনে আমার আক্কেল খুলে গেল! তিনি যা বললেন তা হলো, ‘ভাই বোঝেন না কেন, ভাগবাটোয়ারা করে দলীয় ঠিকাদারদের কিছু দিলেও, বড় বড় কাজ বিএনপি ঘরানার ওই ব্যক্তিই পাচ্ছে, কারণ বর্তমান অবস্থায় তার কাছ থেকেই বাটোয়ারা বা ভাগের অংশ নিশ্চিন্তে আদায় করা সম্ভব। দলীয় ঠিকাদার যদি ভাগের অংশ ঠিকমতো না দেয়, সেজন্যই এ ব্যবস্থা।’ সুতরাং টেন্ডারবাজির ক্ষেত্রে যে দলের বাইরের লোকও সুবিধা ভোগ করছেন, সে কথাটিও সত্যি।
আমাদের দেশে ওষুধ ক্রয়ের ক্ষেত্রেও যে এত বড় বড় টেন্ডারবাজি হয়, বিশ বছর আগ পর্যন্ত সে বিষয়ে আমার পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না। প্রায় বিশ বছর আগে একদিন ট্রেনে পাবনা যাওয়ার সময় আমার কেবিনে আরও দু’জন যাত্রী ছিলেন, যারা ঢাকা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলেন। তো তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে একজন আর একজনকে বলছিলেন যে, স্বাস্থ্য বিভাগে তার সত্তর কোটি টাকার বকেয়া বিল পাওনা আছে এবং আগামী সপ্তাহে সেখান থেকে তিনি পঁয়তাল্লিশ কোটি টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে বাড়ি যাচ্ছেন। চাটমোহর স্টেশনে নেমে সেখান থেকে পাবনা পৌঁছার পথে তাদের বলা কথাগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কারণ ওষুধপত্রসহ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সরবরাহের কাজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা কীভাবে ঘুষ বাণিজ্য করেন তাদের কথাবার্তায় সেসব ঘটনারও প্রতিফলন ছিল। অতঃপর সেসব কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু এ করোনাকালে স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতির চিত্রগুলো প্রকাশিত হওয়ায় অতীতে শোনা সে কথাটিও মনে পড়ে গেল। ডাক্তারসহ স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করা ব্যক্তিদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ দেখেশুনে মনে হয়, দুর্নীতির ইঁদুর দৌড়ে এদেশে আর বাদই বা থাকলেন কারা? মহৎ পেশার ব্রত নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব সমুন্নত রাখতে শপথ গ্রহণকারী ডাক্তার সাহেবরাই যদি হাসপাতালে বসে চুরিচামারিতে লিপ্ত হয়ে পড়েন সে ক্ষেত্রে বলার কীই বা আছে? আর বলেই বা লাভ কী? কারণ কথায় আছে না, ‘চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনি!’
কিন্তু তাই বলে যুগ যুগ ধরে তো আর এসব অপকর্ম অব্যাহত থাকতে পারে না। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এভাবে বাজেটের অর্থ তথা গরিবের টাকা লোপাট করে বিদেশে পাচার করা হবে, আবার দেশের মধ্যেও তা সাদা করার সুযোগ করে একশ্রেণির লুটেরা চক্রকে সুযোগ করে দেওয়া হবে, তাদেরকে মাথায় তুলে রাখা হবে, সেটাই বা কেমন কথা! যেসব ফাঁকফোকর এবং ফন্দিফিকিরে লুটেরা চক্র এসব অপকর্ম করে চলেছে, সেসব ফাঁকফোকর ও ফন্দিফিকিরের রাস্তাও তো বন্ধ করা দরকার, নাকি? আর তা যদি না করা হয়, তাহলে বিভিন্ন সংবাদ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যেসব সচিত্র প্রতিবেদন আমরা দেখতে পাচ্ছি- রাস্তাঘাট, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণের নামে যা করা হয় বা হচ্ছে, সেসব কাজকর্মকে টাকা পানিতে ফেলা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে! আর সেক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না এনে বিশাল অঙ্কের বাজেট দিয়েই বা লাভ কী? ঠিকাদারি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না ঘটিয়ে সেই সনাতনী পদ্ধতিতে রাজনীতি করে খাওয়া ব্যক্তিদের ঠিকাদারি করে খেতে দেওয়ার সুযোগ অবারিত রেখে যত বড় অঙ্কের বাজেট দেওয়া হবে, তার তো বড় অঙ্কই লোপাট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। কারণ বেড়ায় ক্ষেত খেলে, ঠেকাবে কে?
এ অবস্থায় বিশাল অঙ্কের বাজেট প্রদানের পাশাপাশি সনাতনী পদ্ধতির ঠিকাদারি ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে ‘রাজনীতি করিয়া খাই’ এই শ্রেণির মানুষের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি বলেই মনে করি। আর সেই সঙ্গে এ কথাটিও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণের সম্পদ লুটেরাদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সুতরাং মুজিববর্ষ উদযাপনের এ সময়ে তার আদর্শ বাস্তবায়নের স্বার্থেই গরিবের অর্থ লুটপাট বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট