Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সুরক্ষা প্রদান আইনটি কতটা জনস্বার্থবান্ধব?

Icon

ডা. জাহেদ উর রহমান

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুরক্ষা প্রদান আইনটি কতটা জনস্বার্থবান্ধব?

সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম সংক্রান্ত ঘটনাটি সংবাদমাধ্যমকে বেশ কয়েকদিন মাতিয়ে রেখেছিল। ঘটনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে- জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশকারীদের চৌহদ্দি কতটুকু হবে এবং তাদের আইনি সুরক্ষার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে। নিপীড়নমূলক ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট মতপ্রকাশ এবং মুক্ত গণমাধ্যমের কতটা অন্তরায় সেটি নিয়ে আমরা যতটা আলোচনা করি, সেই তুলনায় তথ্য প্রকাশকারীর আইনি সুরক্ষার আলোচনা কিন্তু অনেক কম।

ব্র্যাডলি (পরবর্তী সময়ে লিঙ্গ পরিবর্তন করে ‘চেলসি’) ম্যানিং, অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেন, জুলিয়ন অ্যাসাঞ্জদের মতো হুইসেল ব্লোয়াররা হিরো না ভিলেন সেই তর্ক শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। আমেরিকার ক্ষমতাসীনরা যখন এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল, ঠিক তখনই এ পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন এ মানুষগুলো।

যে আমেরিকার অতি গোপনীয় নথি প্রকাশ করার সঙ্গে জড়িত এ মানুষগুলো, সেই আমেরিকার নাগরিকরাও কিন্তু এদের ভিলেন বানায়নি। তাদের কাছেও এ ব্যক্তিরা পেয়েছেন বীরের মর্যাদা, যদিও এসব নথি প্রকাশিত হওয়া রাষ্ট্র হিসাবে আমেরিকাকে বড় বিপদে ফেলেছে। ঘটনাটি প্রমাণ করে রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতাসীনরা তথ্যপ্রবাহ নিয়ে যেভাবে ভাবুন না কেন, সাধারণ নাগরিকরা তথ্য তাদের অধিকারের ব্যাপারে এখন খুব সোচ্চার। সেটির জন্য এমনকি প্রচলিত আইনি ব্যত্যয় ঘটলেও তারা তথ্য চান।

বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়া এ তথ্য প্রকাশের ঘটনাগুলোর আগে থেকেই পশ্চিমা উদার গণতান্ত্রিক অনেক দেশে জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশকারী বা হুইসেল ব্লোয়ারদের সুরক্ষার জন্য আইন প্রণীত হয়েছিল। যেমন- ব্রিটেনের ‘পাবলিক ইন্টরেস্ট ডিসক্লোজার অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করা হয়েছিল ১৯৯৮ সালেই। কিন্তু এ কথা বলতেই হয়, উপরোল্লিখিত তিনজনের তোলপাড় করা ঘটনার পর থেকেই এ সংক্রান্ত আইন নিয়ে সারা পৃথিবীতে অনেক বেশি আলোচনা হয়। যার ফলে একটির পর একটি দেশে এ ধরনের আইন প্রণীত হতে শুরু করে।

বাংলাদেশেও সেই বৈশ্বিক প্রবণতায় কিছুটা হলেও প্রভাবিত হয়েছে। অন্তত কাগজে-কলমে এমন একটি আইন বাংলাদেশেও প্রণীত হয়েছে- ‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১’। আইনটি সরকার একেবারে দায় সারার জন্য করেছে। এমন একটি আইন আছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে তো পারা গেছে।

এমন একটি আইনের অস্তিত্বের কথা এ দেশের খুব কম মানুষ জানেন। সরকারের দিক থেকে আইনটির অস্তিত্বের কথা সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের ভালোভাবে জানানোর চেষ্টাই করা হয়নি। অবশ্য এটা মানুষ জানলেও খুব বেশি কার্যকর কিছু হতো বলে আমি মনে করি না। কেন সেটা, সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

সাংবাদিক নেতা ও আইনজীবীসহ অনেককেই বলতে শুনেছি, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের এসব কাজে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইন আছে। তারা ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১’-কে সামনে এনেছেন। আইনটির শিরোনাম শুনলে অনেকেরই হয়তো মনে হবে এমন একটি আইন সত্যিই সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা।

পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে এ আইনটির খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। ৪(২) ধারায় কোন কোন বৈশিষ্ট্য থাকলে তথ্য প্রকাশকারী তথ্য প্রকাশ জনস্বার্থে হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে, তার একটা বর্ণনা আছে।

এ বর্ণনার মধ্যেও অস্পষ্টতা আছে, আলোচনার স্বার্থে ধরে নেওয়া যাক একজন তথ্য প্রকাশকারী সেই শর্তমতো জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ করবেন। তো সেই তথ্য কোথায় প্রকাশ করবেন তিনি? সেটা বলা আছে ৪(১) ধারায়। সেখানে বলা হয়েছে- ‘কোনো তথ্য প্রকাশকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট, যুক্তিযুক্ত বিবেচনায়, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে পারবেন।’

তাহলে এটা খুব স্পষ্ট, তথ্য প্রকাশকারী তথ্য জনস্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্য থেকে প্রকাশিত হচ্ছে সেটা যেমন নিশ্চিত হতে হবে, তেমনি সেটা প্রকাশ করতে হবে ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট’। তাহলে ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ বলতে কাকে বোঝানো হচ্ছে এ আইনে? সেটারও বর্ণনা আইনের ‘সংজ্ঞা’ অংশে দেওয়া আছে।

সেটা এ রকম- ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ অর্থে কোনো সংস্থার প্রধান বা ওই সংস্থার সঙ্গে সংযুক্ত বা অধীনস্থ কোনো অধিদপ্তর, পরিদপ্তর বা দপ্তরের বিভাগীয়, আঞ্চলিক, জেলা, উপজেলা বা ইউনিয়ন কার্যালয়ের প্রধান বা প্রধান নির্বাহী এবং নিুবর্ণিত ব্যক্তি বা পদধারীরাও এর অন্তর্ভুক্ত হবেন, যেমন- (ক) সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে, প্রেসিডেন্ট; (খ) সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে, স্পিকার; (গ) বিচারকর্ম বিভাগের কোনো সদস্যের ক্ষেত্রে, সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার; (ঘ) দুর্নীতির সহিত সংশ্লিষ্ট হইলে, দুর্নীতি দমন কমিশন; (ঙ) সরকারি অর্থের সহিত সংশ্লিষ্ট হইলে, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক; এবং (চ) অবৈধ বা অনৈতিক কার্যের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

কোনো একটি সংস্থা সেটা সরকারি কিংবা বেসরকারি তার কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি তার কর্মরত প্রতিষ্ঠানের কারও কোনো দুর্নীতি কিংবা অন্য কোনো অবৈধ-অনৈতিক কাজের হাদিস জানেন এবং যদি মনে করেন সেটা জনস্বার্থে প্রকাশিত হওয়া দরকার তাহলে তাকে ওপরের তালিকা থেকে বেছে কারও কাছে সেটা জানাতে হবে।

সেটা যদি ঠিকঠাক করেন তাহলে তিনি ধারা ৫-এর ৬টি উপধারায় বর্ণিত সুরক্ষাগুলো পেতে পারবেন। বাংলাদেশের কোনো ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো তথ্য ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’-এর কাছে জানানোর পর সেটা ওই ব্যক্তি জেনে গেলে তথ্য প্রকাশকারী কপালের দুর্ভোগ এ আইন আদৌ কতটুকু ঠেকাতে পারবে সেটা এ দেশের জনগণ জানে। আমার আলোচনা সেটি নয়।

আলোচ্য আইনটি এবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগের কথা বিবেচনা করা যাক। ওই মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা কোনো সাংবাদিককে যদি মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্তার দুর্নীতির খবর পেয়ে যান, তাহলে এ আইন অনুযায়ী সেই তথ্য দিতে হবে; ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব/মন্ত্রীকে। তথ্য প্রকাশকারী চাইলে সেই তথ্য আইন অনুযায়ী দুদককেও দিতে পারবে।

একজন সাংবাদিক সেই তথ্য প্রিন্ট/ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বা সামাজিক মাধ্যমে কিংবা ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ নয় এমন কোথাও প্রকাশ করে দিলে সে ক্ষেত্রে এ আইনের সুরক্ষা তার প্রতি আর কাগজে-কলমেও থাকে না। কারণ তথ্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তিনি ওই আইন?ই ভেঙেছেন। তখন উল্টো তথ্য প্রকাশকারীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ৩২ ধারায় মামলা করে দেওয়া যাবে।

আর সঙ্গে যে আছে শতবর্ষী ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩’। তাহলে জনস্বার্থে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য কি সাংবাদিকদের জানানো যাবে না? সেই ক্ষেত্রে কি তথ্য প্রদানকারী (সোর্স) এবং সাংবাদিকরা কোনো রকম আইনগত সুরক্ষা পাবেন না? বর্তমান পৃথিবীতেই এমন আইনের অস্তিত্ব আছে যেখানে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারা আছে।

অস্ট্রেলিয়াতেও ‘পাবলিক ইন্টরেস্ট ডিসক্লোজার অ্যাক্ট’ আছে এবং সেখানে তথ্য প্রাথমিকভাবে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দেওয়ার কথা আছে। কিন্তু সেই আইনে বলা আছে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তথ্য দেওয়ার পর যদি সেটার তদন্ত করা না হয়, অথবা যদি তদন্ত করে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে সেই তথ্য প্রকাশকারী ওই তথ্য জনস্বার্থে সাংবাদিকদের প্রকাশ করার জন্য দিয়ে দিতে পারেন।

আগেই বলেছি, বাংলাদেশ এ আইনটি আদালতে কাগজে-কলমেই আছে। এটা জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশকে কোনোভাবেই উৎসাহিত করে না; পাবলিক ডোমেইনে তথ্য প্রকাশকে ন্যূনতম সুরক্ষা দেয় না। সুতরাং আমাদের আইনটি অস্ট্রেলিয়ার এ সংক্রান্ত আইনের মতো করে সংশোধিত না করলে এ আইন থাকা অর্থহীন।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো। অস্ট্রেলিয়ার আইনটিতে তথ্য ন্যায়পালের কাছে প্রাথমিকভাবে প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদের তিনটি উপ-অনুচ্ছেদ মিলিয়ে ন্যায়পাল নিয়ে বলা আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সরকারই এই প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করার একেবারে প্রাথমিক পদক্ষেপও নেয়নি।

যে সমাজে তথ্য প্রকাশের অবাধ সুযোগ থাকে সেই সমাজ হয় স্বচ্ছ। আর স্বচ্ছ সমাজেই অনিয়ম-দুর্নীতি হতে পারে অনেক কম। নাগরিক হিসাবে আমাদের স্বার্থ যেন সংরক্ষিত হয়, সে জন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার স্বার্থে সাংবাদিকসহ অন্য সব হুইসেল ব্লোয়ারদের সত্যিকারের অভয় দেওয়ার জন্য ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১’ দ্রুত সংশোধনের জোর চাপ চালিয়ে যাওয়া উচিত।

এ দেশে আইন হওয়া মানেই সেটার সঠিক প্রয়োগ হওয়া নয়। মোটামুটি ভালো মানের একটি তথ্য অধিকার আইন থাকার পরও তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মানুষ এখনো খুব কম সহযোগিতাই পায়, জানি সেটাও। সেটা ভিন্ন লড়াই, সবার আগে আইনটা অন্তত কাগজে-কলমে ঠিকঠাক হওয়া জরুরি।

ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম