কিশোর অপরাধ : পরিত্রাণ কোন পথে
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![কিশোর অপরাধ : পরিত্রাণ কোন পথে](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2021/05/29/image-425461-1622241732.jpg)
করোনা অতিমারির প্রথম ও দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়ংকর-শোচনীয় প্রভাবে লন্ডভন্ড পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ ধরিত্রীর প্রায় প্রতিটি দেশই। কোভিড-১৯ অতিমারির চরম দুঃসময়ে কিশোর অপরাধের ভয়াবহ দৃশ্যপট এ অতিমারির চেয়েও দুর্বিষহ পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে চলছে। রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবারসহ সামগ্রিক পরিবেশ-প্রতিবেশকে প্রচণ্ড ক্ষতবিক্ষত করে কিশোর অপরাধের অপ্রতিরোধ্য গতিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি ও মাত্রিকতায় প্রকাশ পাচ্ছে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, কিশোর অপরাধের গতিময়তা হত্যা, ধর্ষণসহ মারাত্মক কুৎসিত অপরাধে কলুষিত। ১১ জানুয়ারি দেশের মাননীয় পুলিশ প্রধানের বক্তব্য ছিল, ‘পুলিশের জন্য এ কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীরাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন।’ পরিবার-সমাজ কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয়-পর্যাপ্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলে এর নেতিবাচক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার চৌহদ্দি নির্ধারণ অসম্ভব হয়ে উঠবে।
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্যমতে, কেন্দ্রে অবস্থানরত ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সি কিশোরদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক সেবন, ক্রয় ও বিক্রয়, অস্ত্র ব্যবহার-ব্যবসা ইত্যাদি জঘন্য অপরাধে জড়াতে তারা বিশেষ মহল কর্তৃক প্রতিনিয়ত প্ররোচিত হচ্ছে।
আমাদের জানা যে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪ কোটি বা প্রায় ৩০-৩২ শতাংশ শিশু-কিশোর। তাদের এক-তৃতীয়াংশের অধিক এক কোটি ৩০ লাখ শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ফলে অতি সহজেই তাদের যে কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা অতি প্রকট।
সূত্রমতে, বরগুনার নয়ন বন্ড তার ‘০০৭’ গ্রুপ নিয়ে জনসম্মুখে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ হত্যার জন্য ১১ কিশোরকে কারাদণ্ড দিয়ে বরগুনার আদালত বলেছেন, ‘সারা দেশে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। গডফাদাররা এ কিশোরদের ব্যবহার করছে।’ এ ধরনের ঘটনা সাভার, নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে। চলমান কঠিন মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি নবতর সংকট হচ্ছে এ কিশোর অপরাধ।
‘কিশোর গ্যাং উপ-সংস্কৃতি’ সমসাময়িক আর্থসামাজিক ব্যবস্থার বিপরীতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ প্রপঞ্চ। এর সঠিক অনুধাবন-গতি-প্রকৃতি-মাত্রিকতা-কারণ ইত্যাদির বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা ছাড়া সংশ্লিষ্ট সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং সমাধানের স্বরূপ উন্মোচন অতিশয় দুরূহ ব্যাপার। দেশের নগর-শহর-জেলা-উপজেলা এবং প্রান্তিক অঞ্চলে এই উপ-সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার ইতোমধ্যে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও জনশ্রুতি অনুসারে, পারিবারিক-সামাজিক অনুশাসনের বিপর্যয়, অনৈতিক-অবৈধ পন্থায় বিভিন্ন দলের পদ-পদবিপ্রাপ্ত জঙ্গি-সন্ত্রাসী-মাদকসেবী-দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকের কুৎসিত প্রভাবের অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচিত। সর্বোচ্চ উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে নিম্নতম পর্যায়ের শিক্ষা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মেধাশূন্য অযোগ্য-অপদার্থ, অর্থ-ক্ষমতা লিপ্সু ব্যক্তিদের জঘন্য অপকৌশল অবলম্বনে লবিং-তদবির-কথিত সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিক পদ-পদায়ন দখল ও রক্ষায় ব্যক্তিস্বার্থে এদের ব্যবহার অমার্জনীয়, পাপাচারতুল্য।
এ অপসংস্কৃতিতে জড়িত কিশোরদের বিপথগামী করে ‘বড়ভাই’ নামধারী ব্যক্তিরা বরাবরই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। নিকট অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে ষোলো বছরের নিচে অপ্রাপ্তবয়স্কদের অসামাজিক ও আইনবিরোধী কার্যকলাপকে কিশোর অপরাধ এবং ষোলো বা তদূর্ধ্ব বয়স্কদের এমন কার্যকলাপকে অপরাধ বলে গণ্য করা হতো। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী, সাত থেকে ষোলো বছর বয়স্ক এসব শিশু-কিশোরকে কিশোর অপরাধী বলা হয়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ‘ল্যানসেট চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট হেলথ’-এর গবেষণালব্ধ প্রবন্ধমতে, ১০ বছর বয়স থেকেই কিশোর জীবনপ্রবাহের যাত্রা শুরু হয়। মূলত কিশোর গ্যাং বা গ্যাং অপসংস্কৃতিতে জড়িতদের বয়স হচ্ছে প্রায় ক্ষেত্রে দশ থেকে সতেরো বছর।
আমরা হয়তো অনেকেই অবহিত আছি, এ অপসংস্কৃতির উৎসমূলে রয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন ও বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধি। সাধারণত নানামুখী জীবন নির্বাহের ধরন, কর্মসংস্থান, অপরিকল্পিত নগরায়ণ-শিল্পায়নের ফলে সৃষ্ট গ্রাম থেকে শহরমুখী গণ-স্থানান্তর, চরম বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশে এ অপসংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি, দ্রুততর সময়ের মধ্যে ক্ষমতা-অর্থসম্পদ-বিত্তশালী হওয়ার প্রলোভন এবং জীবন প্রবৃত্তির বিপরীত-নেতিবাচক তাড়না সভ্যতার সাবলীল বিকাশের অন্তরায়রূপে বিবেচ্য।
এ কারণে উন্নত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি নগরেই ১৮৭০ সালে স্থায়ী পুলিশ বিভাগ স্থাপিত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রাথমিক পর্যায়ে কিশোর অপরাধের সঠিক মূল্যায়ন করার জন্য পুলিশ বিভাগে বিশেষায়িত শাখা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ সময় মহিলা অফিসারদের এসব কর্মকাণ্ড তদারকির ভার দেওয়া হয়।
১৯২৪ সালে বৃহৎ নগরগুলোয় ‘কিশোর ব্যুরো’ স্থাপিত হয়। ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট ক্রাশের ঘটনা এবং বিধ্বস্ত অর্থনীতি এ কিশোর অপরাধকে গ্যাংভিত্তিক অপসংস্কৃতিতে পরিণত করে। আমরা হয়তো এ-ও জানি যে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাজ্যে কিশোর গ্যাংগুলো ভয়ানক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
১৮৯০ সালের দিকে কিছু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি এদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ জনগণের সুরক্ষায় উদ্ভাবনী এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তারই ফলে বিশ্বখ্যাত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাবের প্রতিষ্ঠা এবং সন্ত্রাসী তরুণদের খেলা ও মননশীল বিনোদনের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করার লক্ষ্যে ফুটবল খেলা অধিকতর স্বল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উল্লিখিত এ ক্লাব দুটির মাধ্যমে কিশোর-তরুণদের সমাজবিচ্যুত মনোভাব পালটে দিয়ে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে প্রচণ্ডভাবে উৎসাহিত করা হয়।
২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে উত্তরা ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজে’র সংঘাতের বিষয়টি জনগণের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। সহজ সরল অর্থে এ দুটি কিশোর গ্যাংয়ের মূল কাজ ছিল পার্টি করা, বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে দ্রুততম গতিতে মোটরসাইকেল চালানো, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, যা ধীরে ধীরে তাদের সন্ত্রাস, মাদক, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণসহ সমাজের আইনবিরোধী ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে জড়িত করে।
আমরা হয়তো অবগত আছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধোত্তর ধ্বংসযজ্ঞের প্রভাবে ক্রমবর্ধমান অসমতা ও বৈষম্যে সমাজে ব্যাপক অসংগতির জন্ম নেয়, বিশেষ করে ১৯৫৫ সাল থেকে বিপুলসংখ্যক কিশোর অপরাধী এবং গ্যাংয়ের উত্থান ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা সহজে প্রাপ্তির কারণে কিশোররা বেপরোয়াভাবে তাদের স্বাধীন সত্তার অপব্যবহারে লিপ্ত হয়।
সম্ভবত যুদ্ধোত্তর বিশ্বে প্রথম অপসংস্কৃতি ‘টোডস’। পরবর্তী সময়ে এ ধরনের আরও বহুমাত্রিক কদাচার কিশোর গ্যাংয়ের অপসংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিশোরদের অধিকার যথার্থ সংজ্ঞায়িত করে এসব নষ্টামি থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আইন-কনভেনশন-গাইডলাইন তৈরি করে। ১৯৮৯ সালে ‘শিশু অধিকার নীতিমালা (সিআরসি)’ প্রণয়ন ও ‘আর্টিকেল ২’-এর ব্যাখ্যায় ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা-জাতীয়তা-রাজনৈতিক মতামত, নৃতাত্ত্বিক-সামাজিক পরিচিতি, সম্পদ, প্রতিবন্ধী, জন্ম এবং অন্যান্য মর্যাদার বিষয়টি আমলে নিয়ে কিশোর-তরুণ ও পিতা-মাতা-অভিভাবকদের দায়িত্ব-কর্তব্য-অধিকার বর্ণিত হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল, দরিদ্রতা, স্থানান্তর, ভঙ্গুর পরিবার, পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ ও পরিবেশ, পিতা-মাতার শিথিল নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন অরুচিকর বিনোদন ও কল্পিত নায়ক-খলনায়কের মধ্যে সহিংস বিরোধ দৃশ্যের প্রদর্শন, গৃহবিবাদ, ভূমিহীনতা, মাদক সেবন-বিক্রি, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ক্রয়-বিক্রয়-ব্যবহার ইত্যাদি এ অপসংস্কৃতির কারণ হিসাবে চিহ্নিত।
অপরাধ বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন, অপরাধের শাস্তি যদি অপরাধীর অন্তরে অপরাধ কর্মের জন্য কঠিন যন্ত্রণার উদ্রেক না-করে, তাহলে অপরাধপ্রবণতা পূর্ণ বিকশিত হয়। মনীষী কার্ল মার্কস, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, এমিল ডুর্কেইম, জেলেমি বেনথ্যাম, সিজার লমব্রোসো, এনড্রিকো ফেরি, রাফেলে গ্যারোফেলো, এডউইন এইচ সুদারল্যান্ডসহ খ্যাতিমান সমাজ-মনো-নৃবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে কী ধরনের অপরাধ কীভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে, তার বিশদ বিশ্লেষণ করেছেন।
স্বল্প পরিসরে এসবের বিস্তারিত পর্যালোচনা অনেকটাই দুঃসাধ্য। মোদ্দা কথা হচ্ছে, ধ্বংসের তলানিতে পৌঁছানোর আগেই জনসংখ্যার তুলনায় স্বল্পসংখ্যক এসব কিশোর অপরাধী ও গ্যাং অপসংস্কৃতি নির্মূলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে পর্যাপ্ত সংশোধনের ব্যবস্থা, কাউন্সেলিং-নিরাময় কেন্দ্র, পরিবারের যথোপযুক্ত মনোযোগ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। একইসঙ্গে অপরাধীদের ও তাদের ইন্ধন-উৎসাহদাতাদের কঠোর আইনের আওতায় আনা না-গেলে এ কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতি যে করোনা অতিমারির চেয়েও ভয়ংকর মহামারির রূপ ধারণ করবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ব্যক্তি, সমাজ, পরিবারসহ রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সতর্কতা ও সচেতনতা এবং শিশু-কিশোর সন্তানদের জীবন প্রক্রিয়ার গতিবিধি প্রতিনিয়ত নিগূঢ় তত্ত্বাবধান-পর্যবেক্ষণে রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিবিড় ভালোবাসা, আদর, স্নেহ এবং তাদের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনশীলতা, পরিশীলিত-যৌক্তিক অনুষঙ্গ অনুসরণে দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই এ সমস্যার উত্তরণ ও পরিত্রাণের পথ উদ্ভাবনে সহায়ক হতে পারে-এ প্রত্যাশাটুকু ব্যক্ত করে নিবন্ধের ইতি টানছি।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়