করোনাভাইরাস টেস্ট করাতে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সামনে রোগীদের দীর্ঘ লাইন। ফাইল ছবি
ওয়াশিংটনভিত্তিক জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনাকালীন বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৫৭টি দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
অথবা কাজ থাকলেও আয় হ্রাস পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে বিশ্বে করোনার কারণে প্রতি দুজনের মধ্যে একজনের আয় কমেছে করোনার প্রভাবে। বিশেষ করে নিুআয়ের দেশগুলোতে মানুষ চাকরি হারিয়েছে অথবা তাদের স্বাভাবিক কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অর্ধেক মানুষই বলেছে, করোনার কারণে তাদের চাকরি চলে গেছে অথবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। গ্যালাপ তাদের জরিপে উল্লেখ করেছে, এ ধরনের কর্ম অথবা ব্যবসায় হারানো মানুষের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী ১৭০ কোটি। তারা বিশ্বের ১১৭টি দেশের তিন লাখ মানুষের ওপর এ জরিপ পরিচালনা করে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বব্যাপী করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী কর্মজীবীরা। এরা তুলনামূলকভাবে কম আয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং তাদের পেশা অনানুষ্ঠানিক। বিশ্বব্যাপী দেশভিত্তিক কর্ম হারানোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে থাইল্যান্ড। দেশটির ৭৬ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। করোনাকালীন চাকরি হারানো বা কর্মচ্যুতির দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। দেশটিতে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ করোনার কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছে। বলিভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, কেনিয়া, উগান্ডা, হন্ডুরাস ও ইকুয়েডরের ৭০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন তারা করোনার কারণে ঘরে বসে আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাময়িকভাবে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা ৩৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী প্রতিটি দেশেরই অর্থনীতি করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব, বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়নের যে ধারায় প্রবহমান ছিল তা করোনার কারণে অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশ প্রায় ১০ বছর ধরে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছিল। করোনার প্রভাব শুরু হওয়ার আগের বছর বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণের জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু এরপরই শুরু হয় করোনার নেতিবাচক প্রভাব। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাওয়ার অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
করোনাকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি সেক্টরই নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রপ্তানি আয়, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, রাজস্ব আহরণ, সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে পণ্য রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু তারপরও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তা অনেক দূরে রয়েছে। করোনার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতির দুটি খাতের তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। এর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিটেন্স এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ। অবশ্য বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ স্ফীত হওয়ার সঙ্গে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ৪৫ (৪ হাজার ৫০ কোটি) বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের সংরক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ সার্ক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। একমাত্র ভারত এ ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। কর্তৃপক্ষীয় পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিটেন্সের ওপর নগদ ২ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে বলেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রেরণ করছে। কিন্তু এ দাবি প্রশ্নাতীত নয়। কারণ অনেকেই মনে করছেন, প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিটেন্সের নামে যা প্রেরণ করছেন তার সবই রেমিটেন্স কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ রেমিটেন্সের নামে পাচারকৃত অর্থ দেশে আসছে কিনা সেটি বিশ্লেষণ করার দাবি রাখে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে কাজ হারিয়ে দেশে চলে এসেছেন। তারা দেশে প্রত্যাবর্তনের আগে স্থানীয়ভাবে কর্মস্থলে সঞ্চিত অর্থ একযোগে দেশে নিয়ে এসেছেন। এ ছাড়া স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিরা করোনার কারণে বেশি অর্থ প্রেরণের জন্য চাপ দিচ্ছে প্রবাসীদের ওপর। ফলে তারা আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ দেশে প্রেরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। বরং আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বিনিয়োগবিহীন স্ফীত রিজার্ভ অধিকাংশ সময়ই অর্থনীতির স্থবিরতার লক্ষণ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের অবস্থা বর্তমানে তেমনই। বিনিয়োগ নেই। আমদানি কমে গেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহৃত হতে পারছে না। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা ইতোমধ্যেই দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন তাদের কর্মসংস্থানের জন্য আমরা কি কিছু করতে পেরেছি? যারা বিদেশ থেকে চলে এসেছেন তাদের সবাই বিভিন্ন কাজে কম-বেশি দক্ষতা অর্জন করেছেন। কাজেই তাদের জন্য কর্মসংস্থানের বিকল্প ব্যবস্থা করা হলে তারা নিজেরাও যেমন টিকে থাকার অবলম্বন পেতেন, তেমনি অন্যদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারতেন। করোনাকালীন অবস্থায় সরকার তুলনামূলক সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে যে ঋণ প্রণোদনা দিয়েছে তার বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র শিল্প মালিকরা ব্যবহার করতে পারেননি। কারণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে মোটেও উদার নয়। তারা বড় শিল্পের মালিকদের ঋণ দিতেই বেশি উৎসাহী। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুদিন আগে এসএমই খাতের সংজ্ঞায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে। অতিক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে এসএমই খাতের আওতাভুক্ত করে এ খাতের নতুন নামকরণ করা হয়েছে, ‘কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)।
মন্ত্রিপরিষদের সাম্প্রতিক এক সভায় নারী উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ দানের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ এখনো খাতা-কলমেই আছে, বাস্তবতার মুখ দেখেনি। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি ও পল্লি ঋণের সুদের হার এক শতাংশ কমিয়ে ৮ শতাংশে নির্ধারণ করেছে। কিন্তু যে কারণে টার্গেট গ্রুপ অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেই অসঙ্গতি দূর করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কৃষি ও পল্লি ঋণ সাধারণ কোনো ফসলি ঋণের মতো কৃষি ঋণ নয়। এ ঋণের উদ্দেশ্য হচ্ছে পল্লি এলাকায় কৃষিনির্ভর ছোট ছোট শিল্প উদ্যোগ গড়ে তোলা। গ্রামীণ এলাকার উদ্যোক্তারা সাধারণত এনজিও থেকে উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করে। তাদের এনজিওগুলোর খপ্পর থেকে রক্ষা করাও এ ঋণের উদ্দেশ্য। প্রতি বছর এ খাতে ২৪ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষি ও পল্লি ঋণ নীতিমালায় বিদ্যমান একটি শর্ত এ ঋণের মূল উদ্দেশ্যকে বিঘ্নিত করছে। ঋণদানের শর্তে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি সরাসরি তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের কাছে এ ঋণ প্রদান করে, তাহলে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ (এখন ৮ শতাংশ) হারে সুদ চার্জ করবে। সরাসরি কৃষি ও পল্লি ঋণ উদ্যোক্তা পর্যায়ে সরাসরি বিতরণ করলে উদ্যোক্তাপ্রতি ৫ লাখ টাকা হতে ১০ লাখ টাকা দেওয়া যাবে। কিন্তু ব্যাংকগুলো যদি নিজেরা সরাসরি এ ঋণ বিতরণ না করে এনজিও হোলসেল লিঙ্কেজে ঋণ বিতরণ করে, তাহলেও ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদ আরোপ করতে পারবে। এনজিওগুলো উদ্যোক্তা ঋণ বিতরণকালে মাইক্রো ক্রেডিট অথরিটি (এমআরএ) নির্ধারিত সুদ হার প্রয়োগ করবে। বর্তমানে এমআরএ নির্ধারিত সুদ হার হচ্ছে ২৪ শতাংশ। যে ঋণ তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের ৯ শতাংশ (বর্তমানে ৮ শতাংশ) সুদে পাওয়ার কথা সেই ঋণ তারা এনজিওর মাধ্যমে ২৪ শতাংশ সুদে নিচ্ছে। এতে ব্যাংক এবং এনজিওগুলো লাভবান হলেও টার্গেট গ্রুপ যে কৃষক তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কোনো ব্যাংক যদি কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণে টার্গেট পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তাই ব্যাংকগুলো নিজেরা কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণের পরিবর্তে এনজিওগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করে। এনজিওগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো নির্ধারিত সীমা নেই। তারা চাইলে একটি এনজিওকে ১০ কোটি বা ৫০ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে।
করোনাকালে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫ লাখ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পরিবারপ্রতি আড়াই হাজার টাকা করে নগদ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক এবং মানবিক একটি উদ্যোগ। কিন্তু যে তালিকার ভিত্তিতে এ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তা কি হালনাগাদ করা হয়েছে? অভিযোগ রয়েছে, গত বছরে প্রণীত তালিকার ভিত্তিতেই এ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। গত বছর যে তালিকা প্রণীত হয়েছিল তাও অসম্পূর্ণ। অনেকেই তালিকা থেকে বাদ পড়েছিলেন। গত এক বছরে যারা নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন তাদের কি এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে? একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপে উল্লেখ করা হয়, গত এক বছরের মধ্যে করোনার কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অন্তত ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। এদের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ইত্যাদি। যারা করোনার কারণে চাকরিচ্যুত অথবা পেশাচ্যুত হয়েছেন তারাই সবচেয়ে বেশি অসুবিধার মধ্যে রয়েছেন। আর শুধু আর্থিক সহায়তা দিলে উদ্দিষ্ট মানুষের আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। তারা এ অর্থ খাবার অথবা অন্য কোনো পণ্য ক্রয়ে ব্যয় করতে পারে। কিন্তু যারা ইতোমধ্যে চাকরিচ্যুত বা ব্যবসায় হারিয়েছেন তাদের যদি সামান্য কিছু পুঁজির ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেতেন। উদ্দেশ্যবিহীন আর্থিক সহায়তা একজন মানুষকে পরনির্ভর করে তোলে। তার চেয়ে বরং তাদের জন্য পুঁজির জোগান নিশ্চিত করা গেলে তারা আয়বর্ধক কাজে তা ব্যয় করতে পারত।
এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক