তৃতীয় মত
সুষ্ঠু তদন্তই হোক সব প্রশ্নের জবাব
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সচিবালয়ের দু-একজন বন্ধু আমাকে ক্রমাগত টেলিফোন করে জানাচ্ছেন, রোজিনা ইসলাম এবারেই শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তাদের কথিত ফাইল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েননি, অন্যান্য কয়েকটি মন্ত্রী দপ্তরেও গিয়ে ফাইল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন এবং সেসব দপ্তরে তার ঢোকা নিষিদ্ধ হয়েছে। এ বন্ধুদের মতে রোজিনা ইসলাম সাংবাদিকতার নীতি-নিয়মের বাইরে কাজ করেছেন।
রোজিনা ইসলামের মামলাটি এখন আদালতে রয়েছে। সুতরাং তিনি দোষী কী নির্দোষ তা নির্ধারণ আদালতের এখতিয়ারে। তবে আমি একজন সাংবাদিক, সেজন্য সাংবাদিকতার রীতিনিয়ম সম্পর্কে সম্ভবত কিছু আলোচনা করতে পারি। সম্প্রতি বিবিসির প্রতিবেদক বশিরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তিনি প্রিন্সেস ডায়ানাকে ভুল বুঝিয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। আরেকটি ঘটনা, উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অনেক গোপন রহস্য ক্রমাগত ফাঁস করছিলেন বলে তাকে কারাবন্দি রাখা হয়েছে। আমেরিকা চাচ্ছে তাকে তাদের দেশে পাঠানো হোক বিচারের জন্য, কারণ তিনি আমেরিকার গোপন তথ্যই বেশি ফাঁস করেছেন।
দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই অ্যাসাঞ্জ এবং বশির সাংবাদিকতার নীতিমালা ভঙ্গ করেছেন কিনা সে সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। চূড়ান্ত রায় এখনো জানা যায়নি। এখানে আরও দুটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। নিক্সন-কিসিঞ্জার শাসনামলে ‘ওয়াশিংটন পোস্টের’ রিপোর্টার যেভাবে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, তা সাংবাদিকতার রীতিনীতি মেনে নয়। আমেরিকার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রের মহাশক্তিধর প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ কোনো চাট্টিখানি কথা নয়। নিজের জীবনবাজি রেখে ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টার নিক্সনের কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি নিন্দিত হননি। বরং সারা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছেন। নিক্সনকে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়তে হয়েছে আর ওই রিপোর্টার সেরা সাংবাদিক হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছেন।
আরেকটি ঘটনা একেবারেই সাম্প্রতিক। সৌদি আরবের খ্যাতনামা কলামিস্ট খাশোগি। তিনি বিদেশে বসে ওয়াশিংটন পোস্টে কলাম লিখতেন। তিনি এক সময় সৌদি রাজদরবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি রাজদরবার ও রাজপরিবারের অনেক গোপন কথা জানতেন। তিনি সৌদি বাদশাহদের অন্যায়-অবৈধ কাজের সমালোচনা করতে গিয়ে সেসব তথ্য ফাঁস করতে থাকেন। সৌদি সরকার থেকে হুমকি দেওয়া হয় তিনি এমন সব তথ্য ফাঁস করছেন, যা সৌদি রাষ্ট্র ও সৌদি রাজপরিবারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। খাশোগি যেন এসব না লেখেন। সৌদি রাজপরিবারের এ হুঁশিয়ারি খাশোগি শোনেননি। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, এ হত্যাকাণ্ডে স্বয়ং সৌদি যুবরাজ ক্রাউন প্রিন্স সালমান জড়িত ছিলেন।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও গোয়েন্দাগিরি প্রায় একই ধরনের পেশা। নিয়মনীতি মেনে কাজ করলে গোয়েন্দারা কোনো বড় রহস্যেরই খোলস উদ্ঘাটন করতে পারেতন না। তেমনি সাংবাদিকরাও পারতেন না কোনো বড় তথ্য সংগ্রহ করতে, যা জনগণের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে প্রকাশ হওয়া দরকার। কলকাতার এক রিপোর্টারকে গোটা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কারণ পশ্চিমবঙ্গে তৎকালীন কংগ্রেসি সরকারের বহু দুর্নীতির খবর রাইটার্স বিল্ডিং বা সরকারি সচিবালয়ে গিয়ে তিনি বের করেছিলেন। এ খবর বের করার ব্যাপারে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা তিনি কতটা রক্ষা করেছিলেন সে প্রশ্ন কেউ তুলেনি।
সাংবাদিকতা এবং গোয়েন্দাগিরির পেশা প্রায় একই শ্রেণির তা আগেই বলেছি। গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দারা যদি নিয়মনীতি মেনে চলেন, তাহলে কোনোদিনই তারা সেই গোপন তথ্য জানতে পারবেন না। এজন্যই দেখা যায়, গোয়েন্দারা অনেক সময় নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেন। এমনকি আইনজীবী গোয়েন্দারাও মক্কেলের স্বার্থে অবৈধভাবে প্রতিপক্ষের বাড়িতে ঘরের তালা ভেঙে হলেও ঢুকে তথ্য-প্রমাণ উদ্ধার করেন। এখানে সত্য উদ্ঘাটনই বড় কথা। কীভাবে সত্যটা উদ্ধার করা হয়েছে, তা বড় কথা নয়।
বাংলা সাংবাদিকতার অন্যতম গুরু সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেছেন, ‘সরকার এবং রাষ্ট্র এক নয়। সরকার অস্থায়ী এবং রাষ্ট্র স্থায়ী। সরকারের অনিয়ম-অব্যবস্থা সম্পর্কে চুরি করে সংবাদ সংগ্রহ করা হলেও তা বৈধ। তাতে জনগণের উপকার হয়। তবে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় এমন খবর সংগ্রহ করা ও প্রচার করার ব্যাপারে দেশপ্রেমকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ এই তত্ত্ব অনুসারে ঢাকার সচিবালয়ে ঢুকে রোজিনা ইসলাম যদি ফাইল চুরি করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও অব্যবস্থার খবর সংগ্রহ করে থাকেন, তাহলে কোনো অন্যায় করেননি। সরকারের গোপন তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের দায়িত্বশীল অফিসারদের। স্বাস্থ্য বিভাগের একটি গোপনীয় ফাইল, যার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জড়িত বলা হচ্ছে, সেই ফাইল কীভাবে অরক্ষিত অবস্থায় এক পিএসের টেবিলে পড়ে থাকে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সচিবের কৈফিয়ত তলব করা দরকার। সেইসঙ্গে সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আসার জন্য রোজিনা ইসলামকে গোপন টিপস দিয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ের কে বা কারা তা তদন্ত করে বের করা দরকার।
রোজিনা ইসলাম যদি রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করে থাকেন এবং আদালতের বিচারে তা প্রমাণিত হয়ে তার সাজা হয়, তাহলে আমার দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সরকারের গোপন খবর ফাঁস করাকে যদি রাষ্ট্রের গোপনীয়তা ফাঁস করা হয়েছে বলে প্রচার করে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের চরিত্র হননের অপচেষ্টা চলে, তাহলে দেশের সাংবাদিক মহলের কর্তব্য হবে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ করা।
রোজিনা ইসলামকে অবৈধভাবে আটকে রাখা যেমন উদ্দেশ্যমূলক মনে হয়, তেমনি উদ্দেশ্যমূলক মনে হয় তার বিরুদ্ধে বর্তমান প্রোপাগান্ডা। তিনি যখন বিচারাধীন এবং আদালত স্থির করবেন তিনি দোষী না নির্দোষ, সেই সময় তাকে আরও নানা অপবাদ দিয়ে প্রচারে বাজার ছেয়ে ফেলা হচ্ছে। তাতে আমার সন্দেহ হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ঘিরে দুর্নীতির যে মহাসিন্ডিকেটটি গড়ে উঠেছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার লুটপাট চলছে (যাতে এক শ্রেণির সাংবাদিকও জড়িত জানা যায়), সেই সিন্ডিকেটের স্বার্থে রোজিনা জেনে বা না জেনে আঘাত করেছেন। অথবা এক সিন্ডিকেটের হয়ে অন্য সিন্ডিকেটের স্বার্থহানির কারণ হয়েছেন।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নেই-এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। যা নেই তা হচ্ছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। সমাজের গভীরতম গোপন গহ্বর থেকে সত্য ও তথ্য তুলে আনা। এ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথে বাধা এবং বিপদ প্রচুর আছে। তার প্রমাণ সাংবাদিক সাগর-রুনীর হত্যাকাণ্ড। বছরের পর বছর গড়িয়ে যাচ্ছে। পুলিশ দেশে এত হত্যা-রহস্য ভেদ করছে, আর এটা পারছে না আমার তা বিশ্বাস হচ্ছে না। দেশের মানুষের মতো আমারও বিশ্বাস সাগর-রুনী তাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দ্বারা এমন কোনো তথ্য জানতে পেরেছিলেন, যা দেশের কোনো মাফিয়া গ্রুপ বা সিন্ডিকেটের স্বার্থে বড় রকমের আঘাত করতে চলেছিল। সেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পুলিশ দাঁড়াতে পারছে না। আমার আরও ধারণা, সাগর-রুনীকে যদি হত্যা করা না যেত, তাহলে তাদের চরিত্র হননের জন্য আজকের রোজিনা ইসলামের মতো প্রচার-প্রোপাগান্ডা শুরু করা হতো।
এক মনীষী বলেছেন, ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত হতে না পারি, কিন্তু আমি তোমার মতের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেব।’ আমি ভিন্নমতের দৈনিকের রিপোর্টারের জন্য প্রাণ দিতে চাই না, শুধু বলতে চাই, রোজিনা যেন আদালতে সুবিচার পান এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির সিন্ডিকেটগুলোর মুখোশ যেন জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়।
লন্ডন, ২৩ মে রবিবার, ২০২১