Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

করোনার তৃতীয় ঢেউ ঠেকাতে চাই কঠোরতম ব্যবস্থা

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ২০ মে ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

করোনার তৃতীয় ঢেউ ঠেকাতে চাই কঠোরতম ব্যবস্থা

করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ কি বাংলাদেশে আসবে? যদি আসে তা কতটা মারাত্মক হবে? কতদিন থাকবে তৃতীয় ঢেউ? আজ এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে। বিশেষ করে যারা সচেতন, তারা উদ্বিগ্ন, চিন্তিত। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও যে বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, তা তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে সহজেই বোধগম্য।

সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছিল এ বছরের মার্চ থেকে এবং সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন ঘোষণা করে সারা দেশে। এ ঘোষণা অনুযায়ী জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ সরকারি কার্যালয় ও প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব অফিস-আদালত-দোকানপাট-বিপণিবিতান বন্ধ রাখা হয়। বন্ধ থাকে গণপরিবহণ তথা ট্রেন, লঞ্চ, বাস।

জরুরি প্রয়োজন ছাড়া প্রাইভেট কার চলাচলও নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। রিকশা, অটোরিকশা, রিকশাভ্যান, ব্যক্তিগত গাড়ি অবাধে চলেছে রাজধানী ও অন্যান্য শহরে-সৃষ্টি করেছে যানজট। একপর্যায়ে শহরে লোকাল বাস চলাচলের অনুমতিও দেওয়া হয়। এ লকডাউনের পরও করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে।

পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার করোনা সামাল দিতে ১৪ এপ্রিল থেকে আট দিনের জন্য ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ বা কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেয়। বলা হয়, এ সময় সবকিছু বন্ধ থাকবে, শুধু ব্যাংক খোলা থাকবে সীমিত সময়ের জন্য এবং গার্মেন্টসহ শিল্প-কারখানায় কাজ চলবে। ১১ এপ্রিল এ ঘোষণা দেওয়া হয় এবং তারপর দেখা যায় অভূতপূর্ব দৃশ্য।

যেহেতু আট দিন সবকিছু বন্ধ থাকবে, তাই ঢাকা শহর থেকে লাখ লাখ মানুষ ছুটে গ্রামের বাড়ির দিকে ছুটি কাটাতে। ট্রেন-লঞ্চ-বাস বন্ধ, সেজন্য ঘরমুখী মানুষ রিকশা, অটোরিকশা, পিকআপ, ছোট ট্রাক, ছোট গাড়ি ভাড়া করে যাত্রা করে ফেরিঘাটের দিকে। লকডাউনের উদ্দেশ্য জনসমাগম কমানো, যাতে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু ফল হলো বিপরিত। এর পর লকডাউনের সময়সীমা আরও বাড়ানো হলো, সেই সঙ্গে দোকানপাট, শপিং মলও খোলার অনুমতি দেওয়া হলো। দোকানদার ও ক্রেতাদের বলা হলো তারা যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, অর্থাৎ সবাই যেন মাস্ক পরেন ও দূরত্ব বজায় রাখেন।

ঈদ ঘনিয়ে আসতেই দোকানপাট-শপিং মলে ক্রেতার ভিড় বাড়তে থাকে। ছোট দোকান, বড় দোকান, বিপণিবিতান-সবখানে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। কোথায় মাস্ক, কোথায় দূরত্ব! কে কার কথা শোনে। সরকারি কর্তৃপক্ষ ও সচেতন মানুষের মধ্যেই শুধু করোনা নিয়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক। সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনাভীতি দেখা যায়নি। অধিকাংশই মাস্ক পরেননি, পরলেও নাক বা ঠোঁটের নিচে নামিয়ে রেখেছেন। বিক্রেতারা কিন্তু খুবই খুশি- এবার ব্যবসা ভালো হয়েছে।

ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই শুরু হয় ঘরমুখী মানুষের ঢল, যা ঈদের আগের দিন পর্যন্ত প্রবলভাবে বজায় ছিল। আমরা এ দৃশ্য টিভির সংবাদ বুলেটিনে দেখেছি, সংবাদপত্রের সচিত্র প্রতিবেদনেও পড়েছি। ট্রেন, লঞ্চ, দূরপাল্লার বাস যেহেতু বন্ধ, অতএব সড়কপথেই সবাই যাত্রা করেছেন-অনেকেই সপরিবারে। নদী পার হতে ফেরিঘাটের যে দৃশ্য দেখা গেল, তা-ও অভূতপূর্ব। ভিড়ের চাপে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে, অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই স্পিডবোট ডুবেও প্রাণহানি ঘটেছে। একেকটি ফেরিতে ৩/৪ হাজার পর্যন্ত মানুষ উঠেছেন, ফেরি যে ডুবে যায়নি, এটাই ভাগ্যের কথা।

এবারের ঈদে কত মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন? কোনো একটি সংস্থা ঈদের চারদিন আগে হিসাব করে বলেছে, তখনই ২৮ লাখ লোক ঢাকা ছেড়ে গেছেন। তাহলে ঈদের দিন পর্যন্ত কতজন গেছেন? আমার ধারণা অন্তত ৫০ লাখ। কারণ, করোনাকালের আগে স্বাভাবিক অবস্থায়, যখন সব ধরনের গণপরিবহণ চালু থাকত, তখনই ঈদের সময় ৫০ লাখের অনেক বেশি মানুষ ঢাকার বাইরে চলে যেতেন। এটা বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেই জানা গেছে।

এদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহারের ভিত্তিতে হিসাব করে বলেছে, এক কোটির বেশি লোক ঢাকা ছেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার অবশ্য গণমাধ্যমকে বলেন, সিম ব্যবহারের সংখ্যা দিয়ে সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না, কারণ এক ব্যক্তির একাধিক সিম থাকতে পারে। তবে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

ঢাকা মহানগরী ও আশপাশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ যে সবচেয়ে বেশি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখন কথা হচ্ছে, এই যে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকা মহানগরীর বাইরে বিভিন্ন স্থানে গেলেন স্বাস্থ্যবিধির পরোয়া না করে, তাদের মধ্যে অনেকেই তো করোনাভাইরাস বহন করেছেন এবং তা ছড়াতে ছড়াতে গেছেন। যেখানে গেছেন সেখানেও এই প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে আসবেন। তারা যখন আবার দলে দলে ঢাকায় ফিরবেন, তখন করোনা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি হবে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি লক্ষ করা গেছে। করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যাও ছিল নিুগামী। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছেন, এপ্রিলের ৫ তারিখ থেকে যে টানা লকডাউন চলছে তা কাজে দিয়েছে, তাই সংক্রমণ কমেছে। উন্নতির এই ধারা অব্যাহত রাখতে লকডাউনের সময়সীমা ২৩ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

সরকারের উদ্দেশ্য সফল হোক, করোনা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসুক-এই কামনা করেই বলছি, আরেকটি বিপদের আশঙ্কায় সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (রূপান্তরিত ধরন) বাংলাদেশেও শনাক্ত হয়েছে। এ ধরনের ভাইরাস খুবই মারাত্মক, খুবই দ্রুত ছড়ায়। এটা ভারতে কী বিপর্যয় ঘটিয়ে চলেছে, তা আমরা রোজই টিভিতে, সংবাদপত্রে দেখতে পাচ্ছি।

করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যে অসচেতন, তার প্রমাণ তো আমরা পেলাম সাম্প্রতিককালেই। এর পর যদি করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আসে, তাহলে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ ঠেকানো যাবে কি? তৃতীয় ঢেউ ঠেকাতে হলে অবিলম্বে সর্বাত্মক প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যে কোনো মূল্যে। এজন্য কঠোরতম স্বাস্থ্যবিধি আরোপ ও ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম