Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তৃণমূল জিতেছে, বিজেপিও এগিয়েছে

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২১, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তৃণমূল জিতেছে, বিজেপিও এগিয়েছে

আট ধাপে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর গত ২ মে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তৃতীয়বারের মতো রাজ্যের শাসনভার হাতে নিয়েছে। গত ৫ মে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের কাছে শপথ নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন মমতা ব্যানার্জি।

কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কোন ধরনের শাসক ক্ষমতায় বসবেন তা নির্ধারণ করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার সেদেশের জনগণের। সেদেশের বাইরে থেকে আপনার-আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা বলা যেতে পারে, তবে ফলাফল নির্ধারিত হবে সংশ্লিষ্ট দেশের সাধারণ নাগরিকের মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু কিছু বিষয় থাকে যা অন্যান্য দেশকেও প্রভাবিত করতে পারে অথবা বলতে পারেন, মানবজাতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের কথা যদি বলি তাহলে বলব, আমেরিকার নির্বাচন আর ভারতের নির্বাচন আমাদের কাছে সমান গুরুত্ব বহন করে না। ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। সেদেশের নির্বাচনি ফলাফল প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে আমাদের প্রভাবিত করে। ভারতের মোট রাজ্য ও অঞ্চলের সংখ্যা ২৯। এই ২৯টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি। এ রাজ্যের নাগরিকদের সঙ্গে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক অনেক গভীর।

অনেকে বৈবাহিক সম্পর্কেও জড়িয়ে আছেন। একথা মানতেই হবে, পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি স্টেট বা রাজ্য। প্রতিটি দেশেরই বিদেশনীতি থাকে। কোনো স্টেট চাইলেও ওই দেশের বিদেশনীতির বাইরে এসে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক করতে পারবে না, পারবে না স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে। পশ্চিমবঙ্গের বেলাতেও তাই। পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে ভারত ভাবনার বাইরে এসে আমাদের সঙ্গে পৃথক কোনো সম্পর্ক করতে পারবে না। তারপরও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এবং নির্বাচনি ইস্যু আমাদের কাছে গুরুত্ব বহন করে।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ধারণাটা এমন যে, হিন্দুদের রাষ্ট্র ভারত আর মুসলমানদের পাকিস্তান। ভাষা-সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠন কতটা যৌক্তিক তা যুগ যুগ ধরেই প্রশ্নবোধক। পাকিস্তানের প্রধান হন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর ভারতের জওহরলাল নেহেরু। দুই রাষ্ট্রপ্রধান স্ব স্ব ধর্মীয় আচারে কতটা অভ্যস্ত ছিলেন তা নিয়ে সমালোচকদের প্রশ্ন চিরকালের। কিন্তু বাস্তবে কোনো দিনই পাকিস্তান মুসলমানদের রাষ্ট্র হতে পারেনি এবং ভারত পারেনি কেবল হিন্দুদের রাষ্ট্র হতে। বাস্তবে উভয় দেশেই উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তো আমাদের মুসলমান বলেই গণ্য করেনি, মানুষ হিসাবে তো নয়ই। এর অনিবার্য ফল হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন বাঙালি জাতির জন্ম। তাই ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ এখন তিনটি রাষ্ট্রে বিভক্ত- ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ। তিনটি দেশই স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রের চর্চায় কোন দেশ কতখানি এগিয়েছে সে কথায় যাব না। তবে ৭০ বছর আগেকার ‘ধর্মের বয়ান’ এখনো দেশগুলোর রাজনীতি থেকে উঠে যায়নি কিংবা বিলীন হয়নি। বরং মাঝে মাঝে তা চরম আকারেও প্রকাশ পায়। সদ্য সমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনেও হিন্দু-মুসলিম ইস্যু দোর্দণ্ড প্রতাপে মাঠে চড়ে বেড়িয়েছে।

এবারের নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি নিজের আসনে হারলেও তার দল তৃণমূল কংগ্রেস ২৯২টি (প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে ২ আসনে নির্বাচন হয়নি) আসনের মধ্যে ২১৪টি নিজেদের ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনের তুলনায় ভালো ফল করেছে। সে সময় ২১১টি আসন পেয়েছিল তৃণমূল। ভোটের সংখ্যাও বেড়েছে। ২০১৬ সালে মোট প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৪৫ শতাংশ পেয়েছিল তৃণমূল। এবার তা বেড়ে প্রায় ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দেখার বিষয় হলো, সবচেয়ে প্রতিরোধের মুখে তৃণমূল সবচেয়ে ভালো ফল করেছে।

২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জি প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত একটানা ৩৪ বছর রাজ্যটি শাসন করেছে বামপন্থিরা। রাজনীতির হিসাব অনুযায়ী মমতার লড়াইটা হওয়ার কথা ছিল বামদের সঙ্গেই। কিন্তু তা না হয়ে হয়েছে বিজেপির সঙ্গে। অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস নামের ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় হলেও পশ্চিমবঙ্গেই তার ঘাঁটি। যেহেতু দলটি ক্ষমতায় ১০ বছর কাটিয়েছে, তাই বাম সংগঠনগুলোর আক্রমণের জায়গা ছিল মমতা। একইসঙ্গে হিন্দুত্ববাদী শক্তি বিজেপির আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল মমতা। ফলে বামপন্থি ও বিজেপি দর্শনগতভাবে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও তাদের উভয়েরই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল তৃণমূল, যে কারণে ভোটাররা মমতা আর মোদিতে বিভক্ত হয়ে যায়। ফল যা হলো-বামপন্থিদের অস্তিত্ব বিপন্ন। ২০১৬ সালের নির্বাচনেও সিপিআইএম, ফরওয়ার্ড ব্লক, এসইউসিআইসহ বামপন্থি দলগুলো ৩৫ আসনে জয়লাভ করেছিল। এবার একটি আসনেও জিততে পারেনি। পাঁচ বছর আগে তাদের বরাতে প্রায় ২২ শতাংশ ভোট ছিল, যা ২০২১ সালে এসে ৪ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। এর পুরো সুবিধাটা নিয়েছে বিজেপি। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বেলায় বামপন্থিরা অনেকখানি এগিয়ে। সে বিবেচনায় অসাম্প্রদায়িক শক্তি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে বলতে হবে। মুসলিম নেতা আব্বাস সিদ্দিকীও বামপন্থিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন; কিন্তু আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু তৃণমূল হওয়ায় ভালো ফল পাওয়া যায়নি।

মমতা ব্যানার্জির দল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করে। তারা বারবার বলেছে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নয়, পশ্চিমবঙ্গ সব ধর্মের মানুষের। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যেহেতু হিন্দুত্ববাদী, তাই এক অর্থে মমতার লড়াইটা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেই ছিল। পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের কাছে তাই দুটি অপশন ছিল-হয় হিন্দু জাতীয়তাবাদ, নয়তো ধর্মীয় সম্প্রীতি। ভোটাররা শেষটাতেই রায় দিয়েছেন।

মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তার আচার-আচরণ, বেশভূষা মধ্যবিত্তের পরিচয় বহন করে। যদিও বিধানসভা নির্বাচনে সব পক্ষের রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল অতি নিম্নমানের। সব বিবেচনা শেষে মমতা ব্যানার্জি প্রচুর মধ্যবিত্তের ভোট টানতে পেরেছেন। তাছাড়া গত এক দশকে সাধারণ মানুষের জীবনমান ও অর্থনৈতিক অবস্থা সারা ভারতের তুলনায় খারাপ ছিল না।

মমতা-মোদির চরম প্রতিযোগিতা নারীদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। বিজেপির স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা মমতার উদ্দেশে যে ভাষায় কথা বলেছেন, সেটাকে পশ্চিমবঙ্গের নারীরা নিজেদেরই অপমান বলে মনে করেছেন। তাই নারী ভোটারদের একটি বড় অংশ মমতার সমর্থনে চলে আসে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এনআরসির নামে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে তথাকথিত বহিরাগত হটানোর যে পরিকল্পনা করেছিল, তার বিরুদ্ধে মমতা ছিলেন সোচ্চার। মুখ্যমন্ত্রী থাকাবস্থায়ও তিনি রাজপথে নেমে আন্দোলন করেছেন। তার এ ভূমিকায় অনেকেই আস্থা ফিরে পেয়েছেন। সেটি ভোটের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটার প্রায় ২৭ শতাংশ। তারা কোনো মুসলিম নেতার পেছনেও যাননি, হিন্দু জাতীয়তাবাদে তো নয়ই। তারা ধর্মীয় সম্প্রীতিকেই বেশি পছন্দ করেছেন। এ কারণে তাদের একটি বড় অংশ মমতার নেতৃত্বকে বেছে নিয়েছে। কারণ মমতা বারবার উচ্চারণ করেছেন, এই বাংলা হলো বাঙালির, হিন্দু-মুসলিমসহ সব ধর্মের মানুষের। তার কথাকে মুসলমানরা আস্থায় নিয়েছেন।

বাংলাদেশ-ভারত দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র, এ বাস্তবতার পাশাপাশি আরেকটি সত্য হলো একটি আরেকটির প্রতিবেশী। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই সংস্কৃতির বাইরেও অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেক মিল আছে। ভারি শিল্প ও অবকাঠামোর দিক বিবেচনায় ভারতের অর্থনীতির আকার আমাদের চেয়ে ৯ গুণ বড় হলেও সাধারণ মানুষের জীবনমান খুব একটা পার্থক্য করে না। করোনাপূর্ব ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৯৯ ডলার আর বাংলাদেশে তা ২ হাজার ৬৪ ডলার। হিসাবটাকে দিনে নামিয়ে আনা হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দৈনিক মাথাপিছু আয়ের পার্থক্য দেশীয় মুদ্রায় মাত্র ৮ টাকা। রাজনীতির ক্ষেত্রেও অনেক মিল আছে। ভারত-বাংলাদেশ উভয়ই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে সরকার বদল হয় জনগণের ভোটের মাধ্যমে। তবে ভোটাধিকার প্রয়োগ কোন রাষ্ট্রে কতটুকু হয় সে প্রশ্ন তো আছেই। সাংবিধানিকভাবে দুটি রাষ্ট্রই ধর্মনিরপেক্ষ। যার যার ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে পালন করার সাংবিধানিক অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। সর্বশেষ একটি নেতিবাচক মিল হলো, দুটি রাষ্ট্রের রাজনীতিতেই সাম্প্রদায়িক শক্তির উপস্থিতি আছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা প্রবল।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি জয়ী হয়েছেন ঠিকই; কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ঘটেছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি আসন পেয়েছিল মাত্র ৩টি এবং ভোট পেয়েছিল মোট প্রদত্ত ভোটের মাত্র ১০ শতাংশ। ২০২১ সালের নির্বাচনে দলটির আসন সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭ এবং প্রাপ্ত ভোটের হার দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশে। বাম রাজনীতির ব্যর্থতার পুরো ফায়দা নিয়েছে বিজেপি। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির এই সম্প্রসারণ ভৌগোলিক রাজনীতির জন্য মোটেই সুখকর নয়।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম