Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

এত ধুন্ধুমার কাণ্ডের পরও কেন এমন ফল

Icon

পবিত্র সরকার

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এত ধুন্ধুমার কাণ্ডের পরও কেন এমন ফল

আমি জানি, বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের ফলাফল কী হলো, কেন হলো-এসব জানার জন্য উৎসুক হয়ে থাকেন।

শুধু ভাষার কারণে নয়, নানা দিক থেকেই দুইয়ের স্বার্থ অনেকটা পরস্পর-নিবদ্ধ। আর বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো যথাসাধ্য পাঠকদের কাছে সেই সংবাদ পৌঁছে দেওয়া কর্তব্য বলেই মনে করে।

এর ফলে নির্বাচনের কী ফল হলো, তা যুগান্তরের পাঠকরা দ্রুতই জেনে গিয়েছিলেন, হয়তো কেন হলো, তাও।

আমি পশ্চিম বাংলায় যে পক্ষ জিতেছে তার রাজনীতির বা অন্যান্য নীতি (বা তার অভাবের) সমর্থক নই, তাও বোধহয় অনেকে জানেন। কিন্তু আমার পক্ষেও এ নির্বাচনের ফলাফল একটা আশ্বাস আর স্বস্তি নিয়ে এসেছে এই কারণে যে, একটি হিন্দুত্ববাদী দল কর্তৃক পশ্চিমবঙ্গ দখলের আশঙ্কা আপাতত নির্মূল হয়েছে।

হ্যাঁ, বিজেপি ৭৬ বা ৭৭ আসন পেয়ে এ রাজ্যে নিজের হাজিরা অনেক বাড়িয়েছে; তা দুশ্চিন্তার কথা। কিন্তু ২৯২টি আসনের বিধানসভায় তৃণমূলের ২১৫টি আসন তাকে ক্ষমতা থেকে, আশা করা যায়, অনেকটা দূরে রাখবে। এ সংখ্যা নিয়ে বিধায়ক কেনাবেচার সাহস বিজেপি এখন দেখাবে বলে মনে হয় না।

অথচ এই দল কী মরিয়া আর আপ্রাণ যুদ্ধের সংকল্প নিয়ে নেমেছিল এ রণাঙ্গনে! এর আক্রমণ ছিল বহুমুখী। প্রথমত, বড় বড় কাগজে প্রধানমন্ত্রীর শাদা দাড়িবর্ধিত (রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ? গুজরাটিরা রবীন্দ্রনাথকে খুব ভালোবাসে এটা সত্য) মুখশ্রীসহ প্রতিদিন মস্ত মস্ত বিজ্ঞাপন থাকত-‘এবার বিজেপি’।

তারপর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, আর সভাপতি জে পি নাড্ডা, ধর্ষণরাজ্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথসহ ছোট-বড় অজস্র নেতা-উপনেতা ঝাঁকে ঝাঁকে হেলিকপ্টারে এসে পশ্চিমবঙ্গ চষে ফেলেছেন, কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সভা করেছেন, গ্রামের মাঠে নেমেছেন, মিঠুন চক্রবর্তী এবং আরও কতজনকে নিয়ে ‘রোড শো’ করেছেন, তথাকথিত ‘দলিতের’ বাড়িতে পাত পেড়ে খেয়েছেন (না, ভুলেও কোনো মুসলমান বা খ্রিষ্টানের বাড়িতে খাননি, আর শুনেছি যে চুঁচুড়ায় যে দলিতের বাড়িতে খেয়েছিলেন, তার রান্না করেছিল এক ব্রাহ্মণ), কী করতে বাকি রেখেছেন, তা-ই গবেষণার বিষয়।

হাস্যকরভাবে বাংলা ভাষা বলার ব্যাকুল চেষ্টা করে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ‘সোনার বাংলা’র, ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের। হায়, তাদের সোনার গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, আসাম, ত্রিপুরা ইত্যাদির নমুনা বাঙালি দেখেছে, ডবল ইঞ্জিনও বাঙালিকে উত্তেজিত করেনি। তৃতীয়ত, এর অনেক আগে থেকেই পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, উত্তরবঙ্গ আর দক্ষিণবঙ্গের নানা সীমান্তবর্তী জেলায় আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রাথমিক স্কুল বসিয়ে, নানা প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করে, টাকা বিলিয়ে ভূমি প্রস্তুত করা শুরু করেছিল। ২০১৯-এর সংসদ নির্বাচনে ১৮টি আসন পেয়ে যাওয়ায় বিজেপির স্বপ্ন আরও তীব্র হতে থাকে।

ফলে চতুর্থত, তারা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নামে এবং গরু-ছাগলের হাটে গিয়ে পশু কেনার মতো তৃণমূল দলের (কদাচিৎ বাম দলেরও) নেতা কিনতে শুরু করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ একাধিকবার বিক্রি হয়, অর্থাৎ আজ এ দলের কাছে নিজেকে বেচে আবার পুরোনো দলে ফিরে যায়, কীসের বিনিময়ে কে জানে!

এই এতসব ধুন্ধুমার কাণ্ডের পর এমন ফল হলো কেন? এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (নাকি তার নির্বাচন-নিয়ন্তা প্রশান্ত কিশোর) কয়েকটি চতুর স্লোগান নির্মাণ করেন, যা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব বাঙালি ‘খেয়েছে’ বলা যায়। প্রথম স্লোগান হলো, বিজেপি বাংলায় বহিরাগত, মমতা বাংলার মেয়ে। একে বাংলা, তার ওপরে ‘মেয়ে’। মানুষ এ কথা বিচার করেনি যে, বিজেপি সর্বভারতীয় দল, সব রাজ্যেই তার নির্বাচনে লড়াই করার অধিকার আছে; কিন্তু বাঙালির আত্মসচেতনতা আর অহংকারকে এ স্লোগান খুবই সুড়সুড়ি দেয়।

তার ওপর হিন্দুত্বের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির হিন্দি নিয়ে বাড়াবাড়ি, তাদের বাঙালি নেতাদেরও হিন্দি ধরনের বাংলা বলা (কর্মকর্তার বদলে ‘কারিয়কর্তা’) বাঙালি পছন্দ করেনি। বাঙালি আর অবাঙালি নেতাদের বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে বিজেপির নানা ভুলভাল কথাবার্তা (রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে জন্মেছিলেন, বিদ্যাসাগর ‘সহজ পাঠ’ লিখেছিলেন) বাঙালির হাসির উদ্রেক করেছে। এরপর বিজেপির তাবড় তাবড় নেতা বাঙালি মুসলমানের কাছে ভোট চেয়ে কোনো আবেদনই রাখেননি, সব সময় এমন ভাব দেখিয়েছেন যে, ৩০ শতাংশের মতো পশ্চিম বাংলার বাঙালি মুসলমানের ভোট তাদের দরকারই নেই-এছাড়াই তারা তরতর করে রাজ্যের মসনদ দখল করবেন। এতে তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে (‘নেই-মুসলমান ভারতের’ অলীক স্বপ্ন), তাতে মুসলমানরা আতঙ্কিত হওয়ার কারণ পেলে তাদের দোষ দেওয়া যায় কি? তার ওপর ‘গোমাংস যারা খাবেন, তাদের প্রতিবেশীদের কথা ভাবতে হবে’, ‘জয় শ্রীরাম!’ না বললে পিটুনি, বিরোধী সমালোচকদের কথায় কথায় ‘পাকিস্তান’ চলে যাওয়ার ফতোয়া দেওয়া, ছোরা-তরোয়াল নিয়ে রামনবমীর মিছিল (এ দু’বছর করোনার জন্য একটি স্তিমিত)-সেসবও বিজেপির পক্ষে যায়নি। বিজেপি নেতাদের মুখের ভাষাও ছিল কুৎসিত, তাও তাদের বাঙালির প্রিয়পাত্র করে তোলেনি।

দেখাই যাচ্ছে, পশ্চিম বাংলার হিন্দু-মুসলমান কেউ আর বামপন্থিদের ওপর ভরসা করতে পারেননি, মমতাই তাদের আস্থার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এ ভদ্রমহিলা যে খুব মার্জিত বুদ্ধিজীবীর মতো নেতৃত্ব দেন তা নয়, তিনিও প্রচুর হাস্যকর আর ভুলভাল কথা বলেন, গালাগালেও কম যান না। কিন্তু আশ্চর্য তার ‘এনার্জি’।

আহত পা নিয়ে (বিতর্কিত হোক) তিনি সারা পশ্চিম বাংলা চষে বেড়িয়েছেন এবং তার নিজস্ব ভাষা ও শৈলীতে ওই বহিরাগত আর বাংলার মেয়ে বিষয়টি এবং বিজেপি যে কত বড় বিপদ, তা বাঙালি ভোটারদের বুঝিয়ে ছেড়েছেন। সে জায়গায় বামপন্থি আর কংগ্রেসের মোর্চার কোনো আবেদনই, এমনকি একঝাঁক তরুণ প্রার্থীর উপস্থিতির কোনো ইতিবাচক প্রভাবই বাঙালি ভোটারকে দোলায়নি।

তারা তৃণমূলের কাটমানি, তোলাবাজি, আম্পান-দুর্নীতি-সবকিছুকে ক্ষমা করেছে, নানা ‘শ্রী’ আর ‘উন্নয়নের’ চেহারায় মুগ্ধ হয়েছে, দারিদ্র্য, বেকারি, শিক্ষাক্ষেত্রে অরাজকতা-সব বিবেচনা আপাতত শিকেয় তুলে রেখেছে। ফলে এবারের নির্বাচন, বলতে ইচ্ছা হয়, হয়েছে আবেগের নির্বাচন, যুক্তির নয়। কিন্তু কোন নির্বাচন সম্পূর্ণ যুক্তির হয় তা কে বলবে! গত শতকের ষাটের দশকে জন কেনেডিকে কোনো কোনো মার্কিন মেয়ে নাকি ভোট দিয়েছিল তার চুলের ছাঁট দেখে!

দেখা যাক এবার বিজেপি কোন রণকৌশল নেয়। এই শক্তি নিয়ে নতুন করে বিধায়ক কিনে কোনো লাভ হবে কি না সন্দেহ। বরং এমন হতেই পারে যে, অনেক তৃণমূলত্যাগী হেরে গিয়ে আবার দলে ফিরে আসবে, দলের তলার দিকটা আরও শক্ত হবে। বিধানসভায় বিরোধী শক্তি হিসাবে বিজেপির উপস্থিতি বহুগুণ বেড়েছে, তা এখন আরও নিশ্চিন্ত শাসক দলের গা-জোয়ারি নীতি এবং নানা দুর্নীতিকে কতটা সমালোচনা করবে বা আটকাতে পারবে তা জানি না। কিংবা এও জানি না, পঞ্চায়েতের মতো তারাও ওই দুর্নীতির অংশীদার হওয়ার উল্লাসের স্বাদ নিতে চাইবে কি না।

আর বামপন্থিদের ১৯৪৬-এর পর থেকে এই প্রথম শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। জানি না, বিশ্বায়নের এ বিকিকিনির হাটে তাদের সেই সংকল্পে কতটা শক্তি থাকবে। তরুণরা যদি কিছু করতে পারে। এ লেখকও আর বেশিদিন সময় পাবে না, কী হয় না হয় দেখার।

পবিত্র সরকার : ভারতের খ্যাতনামা লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম