Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তৃতীয় মত

মুক্তি মিলবে বিজ্ঞানে, অন্য কিছুতে নয়

Icon

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশ: ০২ মে ২০২১, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তি মিলবে বিজ্ঞানে, অন্য কিছুতে নয়

অনেক বড় বড় পণ্ডিতের ভবিষ্যদ্বাণী হলো, মানুষ নিজেই তার ধ্বংস ডেকে আনবে। কথাটা যে সঠিক, তা প্রমাণ করছে সাম্প্রতিক মহাধ্বংসযজ্ঞ করোনা মহামারি। এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়নি করোনার উৎপত্তি কোথা থেকে। চীনের উহান প্রদেশের বাদুড় বা বানরজাতীয় কোনো প্রাণী থেকে, না কোনো গবেষণাগার থেকে। মানুষের দুর্বুদ্ধি থেকে যদি এ বিষাক্ত রোগজীবাণুর বিস্তার ঘটে থাকে, তাহলে বলতে হবে, রোগজীবাণু নিয়ে গবেষণার নামে মানুষ নিজেই তার এ ধ্বংসের বীজ বপন করেছে। আর প্রকৃতি থেকে এ রোগজীবাণু ছড়িয়ে থাকলে বলতে হবে, ম্যালথাসের থিওরিই সঠিক। মানুষের জন্ম অসম্ভবভাবে বৃদ্ধির দরুন প্রকৃতি যখন সেই ভার আর বহন করতে পারে না, তখন প্রকৃতি নিজেই ঝড়, প্লাবন, দুর্ভিক্ষ, মহামারি সৃষ্টি করে মানুষের এ সংখ্যা কমায়। প্রকৃতি তার পিঠের বোঝা হ্রাস করে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে যখন আণবিক বোমা আবির্ভূত হয় এবং প্রতিযোগী শক্তিগুলো যেমন: আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স অবিরাম জলে-স্থলে এ বোমার শক্তি পরীক্ষার জন্য পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছিল, তখনই প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করছিলেন, এ পরীক্ষার ফলে আণবিক বর্জ্য সমুদ্রের জল বিষাক্ত করে ফেলছে। শুধু সমুদ্রের জল নয়, গোটা পৃথিবী ও তার পরিবেশ ও জলবায়ু বিষাক্ত হয়ে গেছে। অবিলম্বে এর প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে মানবজাতি ও মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হবে।

প্রকৃতি-বিজ্ঞানীদের এ সতর্কবাণী থেকে ইউরোপে একতরফা মারণাস্ত্র নির্মাণ বন্ধ করার শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তার আগে রাশিয়া যতদিন আণবিক বোমা বানাতে সক্ষম হয়নি, ততদিন তারা বিশ্ব শান্তির আন্দোলন চালিয়েছে। এমনকি বিশ্ব শান্তির জন্য যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তাদের বিশ্ব শান্তি পুরস্কার পর্যন্ত দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ পুরস্কার পেয়েছেন। সম্ভবত নরওয়ের রাজধানী ওসলোতে বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের শেষদিকে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সম্মেলনে ভিয়েতনামের হো চি মিন এবং বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি পাশাপাশি রাখা হয়েছিল।

রাশিয়া বা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে আণবিক অস্ত্র আসার পর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বিশ্ব শান্তি আন্দোলন ধীরে ধীরে স্থিমিত হয়ে পড়ে। এখন সম্ভবত নামকাওয়াস্তে তার অস্তিত্ব টিকে আছে। এ শান্তি আন্দোলনের পর ইউরোপের একশ্রেণির মানবতাবাদী এলিট বুদ্ধিজীবী দ্বারা পরিচালিত ‘একতরফা মারণাস্ত্র বর্জনের’ আন্দোলন সারা পৃথিবীর বাম রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচি হয়ে উঠেছিল। ব্রিটেনের শক্তিশালী রাজনৈতিক দল লেবার পার্টি এ একতরফা মারণাস্ত্র বর্জনের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল এবং এটাকে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসাবে গ্রহণ করেছিল।

টনি ব্লেয়ার লেবার পার্টির নেতৃত্বে এসে লেবার পার্টিকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেন। ফার-রাইট অংশ টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে নিউ লেবার নামে পরিচিত হয়। টনি ব্লেয়ার লেবার পার্টির নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দলের গঠনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রী ধারা বাদ দেন। দলের প্রতীক লাল গোলাপ বাদ দিয়ে গোলাপি গোলাপ করেন। তিনি দলের যে কর্মসূচি ছিল ‘একতরফা মারণাস্ত্র বর্জন’, তা-ও বাদ দেন।

এভাবে ইউরোপের অনেক সমাজতন্ত্রঘেঁষা বাম রাজনৈতিক দলও এ কর্মসূচি বর্জন করে। পূর্ব ইউরোপে এবং রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের পর মারণাস্ত্র বর্জনের আন্দোলন একেবারেই স্তিমিত হয়ে পড়ে। ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো পৃথিবীর সর্বত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের আগুন দ্বিগুণভাবে বেড়ে ওঠে, মারণাস্ত্রের ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে যায়। আমেরিকার বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম যুদ্ধে বিষাক্ত কেমিক্যাল উইপন্স বা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল। ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধে এ অস্ত্রের বহুগুণ বেশি ব্যবহারের খবর প্রকাশ পায়।

বিশ্ব শান্তির আন্দোলন ও ‘একতরফা মারণাস্ত্র বর্জনের আন্দোলন’ স্তিমিত হয়ে পড়লেও বিজ্ঞানীদের ডাকে বিশ্বের পরিবেশ ও জলবায়ু দূষণকে প্রতিরোধ করার বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে উঠেছে সাম্প্রতিককালে। বিজ্ঞানীরা জানান, আণবিক তেজস্ক্রিয়ায় বিশ্বের শুধু জলবায়ু নয়, ফলমূল, খাদ্য, পানীয় বিষাক্ত হয়ে নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। ক্যানসার, রক্ত ক্যানসারের সংক্রমণ বাড়াচ্ছে। অবিলম্বে বিশ্বের জলবায়ু ও পরিবেশকে দূষণমুক্ত করা না গেলে গোটা বিশ্বের ধ্বংস অনিবার্য। এজন্য ছোট-বড় সব রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বড় ও ধনী রাষ্ট্রগুলোকে ছোট ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর জন্য সাহায্য ও সমর্থন জোগাতে হবে।

এই পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে জাতিসংঘ নেতৃত্ব গ্রহণ করে। পরিবেশকে দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে বহু সম্মেলন হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাব বাস্তবায়নে অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য নয়। এজন্য দায়ী বড় ও ধনী দেশগুলোর, বিশেষ করে আমেরিকার গড়িমসি। বিশ্বের জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষায় ছোট ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর লড়াইয়ে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বিশ্বের পরিবেশ ও জলবায়ুর জন্য যে চরম বিপদ ঘনিয়ে আসছে, সে সম্পর্কে তার স্বভাব অনুযায়ী উপেক্ষা প্রদর্শন করেন, এ সময় বিশ্বের মানবসভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে শেখ হাসিনা সাহসের সঙ্গে নেতৃত্বদানে এগিয়ে যান এবং মাদার অব দ্য আর্থ বা বিশ্বজননী খেতাবে ভূষিত হন।

অতীতের এ পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটলাম এজন্য যে, মানুষই মানবসমাজের ধ্বংসের অবতার-এ সত্যটাকে নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। ভারতের একজন কলামিস্ট লিখেছেন, ‘ধর্মান্ধতা বা হিন্দুত্ববাদ দিয়ে যে মহামারি ঠেকানো যায় না, তা ভারতে আবারও প্রমাণিত হলো। হিন্দুত্ববাদ দিয়ে ভোট পাওয়া যায়; কিন্তু ভোটারদের মৃত্যু যে তাতে ডেকে আনা হয়, এ সত্যটা বিজেপির নেতারা এখনো বুঝে উঠতে হয়তো পারেননি। ভোট পাওয়ার লোভে এ মহামারির সময়েও কুম্ভমেলা করার অনুমতি দেওয়া, গঙ্গা সাগরে লাখ লাখ লোকের স্নান, পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন দেওয়া এবং নির্বাচনি প্রচারাভিযানে লাখ লাখ মানুষকে গাদাগাদি করে একত্র হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া দেশটিতে মহামারির তাণ্ডব এত ভয়াবহভাবে বাড়িয়েছে যে, ইতিহাস চিরকাল এজন্য বিজেপিকে দায়ী করবে।

বাংলাদেশেও এ অবস্থা হতে পারত। কিছুটা যে হয়নি তা নয়। ধর্মবিশ্বাস ভালো। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে ধর্মের নামে কুসংস্কারে অন্ধ বিশ্বাস কী বিপর্যয় ঘটায়, ভারতের সাম্প্রতিক অবস্থা এর প্রমাণ। আমেরিকায়ও এ মহামারিতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ ট্রাম্পের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও একগুঁয়েমি। বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এ ভুল কিছুটা শোধরাচ্ছেন। কিন্তু ভারতের ভুল কে শোধরাবে?

আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এখনো কিছুটা টিকে আছে বলে ধর্মান্ধতাপ্রসূত ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে মহামারি ভারতের মতো ভয়াবহ হয়ে উঠতে গিয়েও অতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারেনি। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্ব এবং দেশের ডাক্তার, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, পুলিশ, র‌্যাব সবার কর্তব্যপরায়ণতাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। আমার তো ভয় ছিল, বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা যেভাবে রাজনীতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে, ভুয়া পীর-মাওলানাদের আধিপত্য যেভাবে বেড়েছে, তাতে করোনা ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশও না আবার ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়।

করোনা শুরু হওয়ার প্রথমদিকে ফেসবুকে এ ভুয়া পীর-মাওলানাদের আধিপত্য লক্ষ করেছি। এই প্রচারণায় ধর্মীয় রাজনীতির উদ্দেশ্যসাধনের গোপন প্রয়াস লক্ষ করেছি। এক ‘মাওলানা’ তার প্রচারণায় জোর কণ্ঠে বলা শুরু করেছিলেন, রোমে বসবাস করেন এমন এক বাংলাদেশি স্বপ্নের করোনার দর্শন পেয়েছেন। করোনা তাকে বলেছে, ইসলামের হেফাজতকারী দেশগুলোয় সে আসবে না। তার যুদ্ধ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ইত্যাদি ধর্মবিশ্বাসী লোকদের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা যদি ইসলামি দলগুলোর বিভিন্ন দাবি মেনে নেন, তাহলে বাংলাদেশের কোনো ভয় নেই।

তখন ফেসবুক খুললেই এ ধরনের প্রচারণার ছড়াছড়ি। এ প্রচারণায় বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা আওয়ামী লীগে কম নেই। বরং বিশ্বাসীদের সংখ্যাই বেশি। তাই ভয় হয়েছিল, হাসিনা সরকার যদি এ প্রচারণার ফাঁদে পড়ে করোনা মহামারি প্রতিরোধে বিজ্ঞানসম্মত পথে না হাঁটে, তাহলে বাংলাদেশে কী ঘটবে। শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতাকে ধন্যবাদ। করোনা প্রতিরোধে তার সরকার অনেক ভুলভ্রান্তি করেছে; কিন্তু কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার দ্বারা চালিত হয়নি। চালিত হলে ভারতের চেয়েও মহাবিপর্যয় বাংলাদেশে ঘটতে পারত।

ধর্ম ও মানবতা-দুইয়েরই জন্ম মানবসমাজকে রক্ষা ও ক্রমাগত অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন মানবসমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির পথ জানা ছিল না, সমাজের কোনো নিয়মশৃঙ্খলা ছিল না, তখন তাকে সভ্য হওয়ার, সমাজবদ্ধ জীব হওয়ার পথ দেখিয়েছে ধর্ম। ধর্ম থেকেই মানবতার উন্মেষ। কিন্তু ক্রমে ধর্ম কুসংস্কারে পরিণত হয়েছে, মানবতার ঊর্ধ্বে স্থান পেয়েছে। বিজ্ঞান এসে মানবতাকে রক্ষা করেছে। কিন্তু কুসংস্কারের আধিপত্য থেকে মানবসমাজ ও তার রাজনীতিকে সর্বত্র মুক্ত করতে পারেনি।

ভারতে, বাংলাদেশে বলতে গেলে সারা এশিয়া-আফ্রিকায় চলছে মানবতাবিরোধী ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের আধিপত্য। অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকায় চলছে পুনরুজ্জীবিত ধনবাদী দানবের রাজত্ব। ধর্মান্ধতা ও ধনবাদ দুই-ই মানবতার শত্রু। একমাত্র বিজ্ঞানই ধনবাদ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মানবতার মিত্র। এজন্য আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক দেশগুলোই সাফল্যের সঙ্গে করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়ছে। কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন দেশগুলো তা পারছে না। রাজনীতিও কোনো দেশে যতদিন ধর্মান্ধতামুক্ত হয়ে মানবতাবাদী হতে না পারবে, ততদিন মানবসমাজ ও মানবসভ্যতার মিত্র হতে পারবে না। একুশ শতকে সব দেশেই ধর্মান্ধ রাজনীতির ও রাজনীতিকদের আবির্ভাব ও আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। তাই ভয় হয় ট্রাম্প, মোদিদের মতো রাজনৈতিক নেতাদের অভ্যুদয় না আবার বিশ্বকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়। পণ্ডিতদের ভবিষ্যদ্বাণী না আবার সঠিক প্রমাণিত হয়।

এই ভয়াবহ দুঃসময়ে মানবসভ্যতা ও মানবতার একমাত্র বন্ধু ও সাহায্যদাতা বিজ্ঞান। করোনার এ মহাধ্বংসযজ্ঞের সময়ে সব দেশের সব মানুষ যেন ধর্মান্ধতার কবলমুক্ত হয়ে বিজ্ঞানমনস্ক হয়, এ প্রার্থনা করি।

লন্ডন, ১ মে শনিবার, ২০২১

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম