প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বে রোল মডেল হবে
ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চিকিৎসা শিক্ষায় স্নাতকোত্তর কোর্সে অধ্যয়ন ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার প্রথম তিন তারকা শাহবাগ হোটেলের জায়গায় ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমঅ্যান্ডআর) প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও এ প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতা ছিল না। ডিগ্রি প্রদান করত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আইপিজিএমঅ্যান্ডআর কার্যক্রমসহ অনেক চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের এমবিবিএস ডিগ্রি প্রদান করত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জনগণের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং দেশের চিকিৎসা, শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় সংসদে আইন পাশের মাধ্যমে তৎকালীন আইপিজিএমঅ্যান্ডআরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে উন্নীত করার মধ্য দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম স্বতন্ত্র পাবলিক মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক এমএ কাদেরী।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সার্বিক পুনর্বাসন ও উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামকে তৎকালীন আইপিজিএমঅ্যান্ডআরের উন্নয়নের সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব তৎকালীন আইপিজিএমঅ্যান্ডআরে ভর্তি ছিলেন।
অধ্যাপক ডা. শেখ আশরাফ আলীর তত্ত্বাবধানে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। বেগম মুজিব ভর্তি থাকার সুবাদে সে সময়ে বঙ্গবন্ধু এখানে আগমন করেন। আর এ সুযোগে চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা প্রবর্তন এবং দেশে চিকিৎসা শিক্ষা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির জন্য আইপিজিএমঅ্যান্ডআরকে আরও উন্নত করার এবং বিসিপিএস প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করেন।
দেশের মানুষের রক্তের প্রয়োজনে নিরাপদ রক্ত সরবরাহ ও নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য বঙ্গবন্ধু তৎকালীন আইপিজিএমঅ্যান্ডআরে প্রথম ব্লাড ব্যাংক স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে এ ব্লাড ব্যাংকের উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধুই প্রথম এ দেশের চিকিৎসকদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে তাদের চাকরি দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে তৎকালীন ১৩টি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ এবং নিপসমসহ পাঁচটি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মানোন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছিল না।
চিকিৎসা শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন দেশে একটি স্বতন্ত্র ও গবেষণাসমৃদ্ধ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং সব মেডিক্যাল কলেজের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আসছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের চিকিৎসক সমাজের দীর্ঘদিনের ন্যায্য দাবি যেমন বাস্তবায়ন করেছেন, তেমনই উচ্চতর চিকিৎসা শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী অগ্রযাত্রার সূচনা করেছেন। দেশের প্রথম স্বতন্ত্র পাবলিক মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তার অবদান চিকিৎসক সমাজ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।
এছাড়া তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মরহুম সালাহউদ্দিন ইউসুফ, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. এম আমানুল্লাহ ও স্বাস্থ্য সচিব মোহাম্মদ আলীর অবদানও উল্লেখযোগ্য।
২০০৯ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সেলেন্সে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারডেমসংলগ্ন বেতার ভবনের জমি ও হাসপাতালের উত্তর পাশের ১২ বিঘা জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে ৫২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন। তার প্রত্যক্ষ সহায়তা ও দিকনিদের্শনায় খুব দ্রুত নতুন কেবিন ব্লক সম্প্রসারণ, অনকোলজি ভবন, নতুন বহিঃবিভাগ, আধুনিক আইসিইউ, ওটি কমপ্লেক্স, মেডিক্যাল কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ সম্ভব হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ভাতা প্রদান, চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা প্রবর্তনসহ নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেল গঠন করা হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা, কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা অল্প খরচে করা এবং আলাদা কেবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে সুযোগপ্রাপ্ত বেসরকারি ছাত্রছাত্রীদের মাসিক সম্মানি ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
গত ২৯ মার্চ উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত আমি বেশকিছু বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম হলো আইসিইউ বেড সংখ্যা বাড়ানো এবং বেতার ভবনে নতুন করে করোনা রোগীদের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে : বেতার ভবনকে উন্নত পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগানো এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা, যা ২০২২ সালের ৭ মার্চ উদ্বোধন করা হবে। অন্যান্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে রেফার করা রোগীদের উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান করে জাতীয় পর্যায়ে জনগণের চিকিৎসার প্রত্যাশা পূরণ করা। কোনো রোগীকে যেন বিদেশে না যায় তেমন চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করা। মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে এ-ব্লক, বেতার ভবন এবং কর্মচারীদের আবাসিক ভবন সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ।
নষ্ট হতে যাওয়া, চালু না হওয়া ডরমেটরিকে ছাত্রদের বসবাসের উপযোগী করা। কনভেনশন হল দীর্ঘদিন চালু করতে না পারায় অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর্থিক ক্ষতি যেন পুনরুদ্ধার করা যায় সে ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে কনভেনশন হল চালু করা। বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফদের জন্য অতি দ্রুত হেলথ কার্ড চালু করা। পথ্য বিভাগকে উন্নীতকরণের মাধ্যমে খাবারের মান বৃদ্ধি করা। বি-ব্লক থেকে ডি-ব্লক এবং মসজিদ গেট থেকে ক্যানসার ভবন পর্যন্ত সিলিংয়ের (ছাদ) ব্যবস্থা করে বর্ষার সময় রোগীদের ভোগান্তি দূর করা। এ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের বুকে একটি রোল মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করব-এই হলো উপাচার্য হিসাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমার অঙ্গীকার।
উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান, শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সংযুক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে, এ প্রত্যাশা সবার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক সহযোগিতায় এবং সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা আমাদের কর্মপরিকল্পনায় সফল হবই, ইনশাআল্লাহ।
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়