শঙ্খ ঘোষকে অলীক করে দেবে ইতিহাসের সে ক্ষমতা নেই

পবিত্র সরকার
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এমন নয় যে এ ধরনের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকি না, এ বয়স অনেক কিছুর জন্য প্রস্তুত হওয়ার শিক্ষা দেয়। তবু এ মৃত্যু এসে আমাদের ভেঙেচুরে দেয়।
শঙ্খদা (শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১) চলে গেলেন উননব্বই বছরে পা দিয়ে। শরীর জীর্ণ হয়ে এসেছিল, কথা অস্পষ্ট, কিন্তু হেরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা দেখিনি তার আচরণে বা কথাবার্তায়।
বাড়ি গেলে সামনের ঘরে এসে বসেছেন, নড়বড়ে শরীরে, ঋজু হয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, কখনো কখনো সে কথা বুঝতেও পারতাম আমরা সহায়ক স্নেহাশিসের ভাষ্য ছাড়াই। মজা হতো যখন বিদায় নিতে যেতাম। ওই টলোমলো শরীরে উঠে আসবেনই দরজা পর্যন্ত, কারও বাধা শুনবেন না। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকবেন যতক্ষণ না আগন্তুক সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করছে।
কবি তো বটেই, হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে অগ্রগণ্য এক কবি, অনেকের মতে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শ্রেষ্ঠ কবি। জানি না আর কার শ্রেষ্ঠ কবিতা ৫০ বছরে তেইশটি সংস্করণের মুখ দেখেছে? আর এ কবিতা শুধু নান্দনিক অভিজ্ঞতাকে নথিবদ্ধ করে না (কবিতার মুহূর্ত, বা কবির অভিপ্রায় পড়তে বলি), তা চারপাশের মানুষকে, সমাজকে, লড়াইকে মৃত্যুকে ধরে। তার মুখ দুদিকেই।
নিজেকে সে দেখে, বলে, ‘হাহাতপ্ত জ্বালাবাষ্প দিনের শিয়রে কাঁপে হৃদয় আমার। / আকাশ, প্রসন্ন হও। রৌদ্রহর মেঘে মেঘে ঝঞ্ঝাকালো করো দিগঞ্চল, দীর্থ করো / তামসগুণ্ঠন। আমাকে আবৃত করো ছায়াস্তৃত এক খানি ধূসর-বাতাস- / ঢালা অকরুণ আলোর মালায়, / আমাকে গোপন করো তুমি।’ আবার নকশালবাড়ি পার হয়ে এ ছত্রগুলিও তার কবিতায় দেখা দেয়, কথা বলছিল শাদা তিন বুড়ি/সাবেককালের প্রথায় : / সবদিকে এত চুপচাপ কেন? / সেই ছেলেগুলি কোথায়?’ তাই সেই সঙ্গে চারপাশের মানুষকেও সে দেখে।
মানুষের দুঃখ, তার বঞ্চনা, স্বাধীন দেশে তার কত কী পাবার ছিল কিন্ত সেসব তার হাতের মুঠোয় এসে পৌঁছোয়নি, অনেক মৃত্যু অনেক রাষ্ট্রীয় হত্যা ঘটেছে- তাও শঙ্খ ঘোষকে স্বস্তি দেয়নি। কে ভুলতে পারে গত শতকের সত্তরের দশকে, জরুরি অবস্থার সময়ে তার সেই তীব্র ব্যঙ্গের পঙ্ক্তিমালা? কলকাতার রাজপথ কতবার যে তার মিছিলে হাঁটার চিহ্ন ধারণ করেছে তার কি কোনো হিসাব আছে? আর কোন্ কবি এমন সাহস করে নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতা-র ভূমিকায় বলতে পারেন, ‘সত্যি কথা বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার।’
কবি, আর সেই সঙ্গে কবিদের নির্মাতাও বটে। আমি জানি না, জীবনানন্দের পরে আর কোনো বাঙালি কবির কবিতা এত বেশি তরুণ কবিকে কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে কিনা। সবাই হয়তো তাকে অনুকরণ করেনি, তাদের নিজেদের মতো করে লিখেছে, কিন্তু তারা যে নিজেদের মতো করে লিখতে পেরেছে, তার মূলেও শঙ্খ ঘোষ।
কারণ তিনি তাদের সামনে, ভাষায়, ছন্দে, মিলে, স্তবকনির্মাণে, জীবনের প্রতি ভালোবাসার উচ্চারণে এমন এক উত্তমতার চ্যালেঞ্জ তৈরি করে রেখেছেন যে, সবাই নিজের শিল্পকে অবহেলা করার কথা ভাবতেই পারেনি।
তিনি ছিলেন তরুণ কবিদের এক অবলম্বন আর আশ্রয়। সবাই জানে তার বিদ্যাসাগর নিবাসের ফ্ল্যাটে প্রতি রবিবার তরুণ কবিদের একটি আড্ডা বসত সারা সকালজুড়ে। এ আশ্রয় কবিরা অন্য কোথাও পেত কিনা সন্দেহ। এখান থেকে তারা কী রসদ নিয়ে ফিরত তা নিশ্চয়ই তারা নিজেরাই বলবে, আজ বা কাল। কেউ কেউ বলবার আগেই চলে গেছে- ভাস্কর চক্রবর্তী বা জয়দেব বসু যেমন।
২.
এত শান্ত, সামাজিকভাবে স্বল্পভাষী আর নিজেকে আড়াল করা মানুষ, অথচ তার নানা বিচ্ছুরণও দেখেছি কত। তার অসামান্য অধ্যাপনার কথা তার ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতিচারণে পাওয়া য়াব।
তার রবীন্দ্রনাথ বা যা কিছু পড়ানো, তার ছন্দ বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যক্তিগত পদ্ধতি, ছাত্রছাত্রী আর সহকর্মীদের সঙ্গে পিকনিকে বা দূরে কোথাও ‘শিক্ষামূলক’ ভ্রমণে, এই সেদিন পর্যন্ত নানা সভায় তার বক্তৃতায় যে শঙ্খ ঘোষকে আমরা পেয়েছি, তাকে শুনতে আমরা বাধ্য হয়েছি।
কণ্ঠস্বর নম্র কিন্তু বিশ্বাস ও সত্যে দৃঢ়বদ্ধ, কিন্তু তাকে শোনা এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। যেমন ছিল তার কবিতার আবৃত্তি। তার গদ্যশৈলীর মধ্যেও ছিল এক আনন্দিত আমন্ত্রণ, তার যৌবনের কত মুহূর্ত উঠে আসে নানা হৃদ্য আখ্যানে, প্রশ্ন করে করে, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে কত স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যান তিনি তার গদ্যে।
তার রবীন্দ্রতত্ত্বালোচনার কথা তো ছেড়েই দিলাম, এই সময়ের শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ তিনি। কিন্তু তার স্মৃতিচারণার গদ্য যে কী অপরিমেয় রূপে স্বাদু তা যে পড়েছে সেই জানে। তা তার ছোটদের জন্য লেখা উপন্যাস সুপুরিবনের সারিতেও আমাদের বিমুগ্ধ করে রাখে।
আমরা যখন যাদবপুরে ক্লাসের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ক্লাবে গিয়ে আড্ডায় বসতাম, শঙ্খদা, সৌরীন, নবনীতা, সুবীর রায়চৌধুরী, স্বপন মজুমদার, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয় দেব, পিনাকেশ প্রভৃতি, সে ছিল আর-এক বিচ্ছুরণের জায়গা। এ ওকে পাল্লা দেয় উজ্জ্বল মন্তব্যে ও কটাক্ষে, আমাদের দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যেত।
আমার নিজের ভালো লাগত বাংলা ভাষা সম্বন্ধে শঙ্খদার বিপুল আগ্রহ। হয়তো এটা পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিলেন তিনি। ভাষা ও বানান সম্বন্ধে মণীন্দ্রকুমারের আগ্রহের স্পর্শ আমরা পেয়েছি। কিন্তু শঙ্খদার আগ্রহ পণ্ডিতের যেমন, তেমনই শিল্পীর।
নইলে কবিতার অলংকার বিষয়ে ভাষার খেলার মতো একটা বই কে আর লিখতে পারত, কে খেলার মজাটা ধরিয়ে দিত পারত ছোটদের? আর এ সামাজিক মানুষটি অসাধারণ কবি, সমালোচক, রবীন্দ্রতাত্ত্বিক, গদ্যশিল্পী, বন্ধু, আশ্রয়দাতা অগ্রজ হওয়া ছাড়াও কত কী অদ্ভুত কাজ করেছেন।
সরস্বতী সম্মান না কী একটা পেয়েছেন পাঁচ লাখ টাকার, তার পুরোটাই তিনি দিয়ে দিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। ভাবা যায়? সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক দিনের, সেই ভারত-কোষ-এরও আগে থেকে। সাহিত্য পরিষদের দুর্গতি চলছে শুনে বাংলার কোনো শিল্পপতি এগিয়ে আসেনি। শঙ্খ ঘোষ তার লন্ডন-প্রবাসে বন্ধু নিমাই চট্টোপাধ্যায়ের দান কয়েক কোটি টাকা পৌঁছে দিলেন তার ভাণ্ডারে। এও কি ভাবা যায়?
না, সব অলীক হয়ে যায় না। শঙ্খ ঘোষকে অলীক করে দেবে ইতিহাসের সেই ক্ষমতাই নেই।
পবিত্র সরকার : ভারতের খ্যাতনামা লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা