পদ্মা সেতুর কারণে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ
মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু
প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কোনো সাহায্য ছাড়া ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে সেতু নির্মাণের যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সত্যিই সেটা ছিল দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। স্বপ্নও বলা যায়। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তা করে দেখালেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তকে সরকারের ভেতরের কতিপয় নীতিনির্ধারক মনেপ্রাণে স্বাগত জানাতে পারেননি।
কথিত সুশীলসমাজ ও একশ্রেণির মিডিয়াও স্বাগত জানানোর পরিবর্তে বিরূপ সমালোচনায় লিপ্ত হয়। কিন্তু নেত্রী দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে। তখন নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ ভোল পালটিয়ে পরামর্শদাতা সেজেছিলেন। এ সম্পর্কে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মন্তব্য যারা করেছিলেন, তাদের প্রতি করুণা দেখানো ছাড়া কিছু থাকে না। আমরা এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোবল ও অদম্য সাহসিকতা ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। কারণ দিনশেষে তিনি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এ সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন, যার সুফল আজ পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন।
এ সেতুর কারণে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব নেতৃত্বে ঈর্ষণীয়ভাবে অনন্য উচ্চতায় অবস্থান ধরে রেখেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। শুধু তা-ই নয়, এত কঠিন প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী অন্য সব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সাহস দেখিয়েছেন, দেখাচ্ছেন। ইতোমধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীন ৭০ হাজার পরিবারকে পাকা বাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। দ্বিতীয় ধাপে আরও এক লাখ পরিবারকে ঘর দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
এর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে ভূমিহীন ও গৃহহীন মোট ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা করে তাদের বাড়ি করে দেওয়ার ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। শুধু বাড়িই নয়, প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি এ পরিবারগুলোর কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আপাতত ৩০ হাজার ‘বীর নিবাস’ নির্মাণ করে পর্যায়ক্রমে সব অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাকে পুনর্বাসন করাসহ মাসিক সম্মানি ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
শুধু মফস্বলে গৃহহীনদের গৃহ নয়, নাগরিক জীবনে স্বস্তি দিতে রাজধানীজুড়ে দুর্বার গতিতে চালাচ্ছেন মেট্রো রেলের কাজ। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজধানীবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার গতি কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।
বিদ্যুৎ খাতেও বাংলাদেশ এখন প্রায় শতভাগ পূর্ণ। ২০০৯ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭। এখন সেই সংখ্যা ১৪১। তবে এর চেয়ে বড় সাফল্য হলো বিদ্যুৎ খাতে সেবার বিস্তৃতি। দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষকে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় এনেছে শেখ হাসিনার সরকার। মুজিববর্ষেই সারা দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিশ্চিতের কাজ চলছে। ‘ওয়ান সিটি-টু টাউন’ মডেলে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারাকে যুক্ত করতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি হচ্ছে সাড়ে তিন কিলোমিটারের সুড়ঙ্গপথ। মোট নয় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প দিয়ে বছরে প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চন্দ্রা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পর চন্দ্রা-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশন, বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশন-রংপুর এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। নতুন রেলপথ নির্মাণ, নতুন কোচ ও ইঞ্জিন সংযুক্তি, ই-টিকিটিং এবং নতুন নতুন ট্রেন চালুর ফলে রেলপথ যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে।
অন্যদিকে গড় আয়ুতে আমরা পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছি। মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, প্রস্তুতি চলছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের। উন্নয়নের রোড প্ল্যান ধরে নির্মিত হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেল, এলএনজি টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। ঢাকা-চট্টগ্রামের যোগাযোগচিত্র বদলে দিয়েছে ফ্লাইওভার, ব্রিজ। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গতি যোগ করতে দেশে গড়ে উঠছে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল।
নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন এবং স্বাস্থ্যসেবায়ও বাংলাদেশের অগ্রগতি আজ চোখে পড়ার মতো। ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি আকারে তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হবে। পদ্মা সেতুর মতো এত বড় মেগা প্রকল্প করেও বাংলাদেশের অবিশ্বাস্যভাবে ‘এগিয়ে যাওয়া’ সত্যিই আমাদের উৎসাহ দেয়, আশা জাগায়। একসঙ্গে এত মেগা প্রকল্পের উন্নয়ন এভাবে এগিয়ে নেওয়া শুধু যে আমাদের সক্ষমতা বাড়িয়েছে তা নয়, বরং আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকখানি।
তাই তো বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল, উন্নত দেশের পথে। তাছাড়া পদ্মা সেতু নিছক সেতু নয়, এটা আমাদের উন্নয়ন, গর্ব ও অহংকারের নিদর্শন। আত্মসম্মান, আত্মপরিচয়, সক্ষমতা, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ়প্রত্যয়ের ফসল। গৌরব ও অহংকারের এ সেতুর নাম ‘শেখ হাসিনা সেতু’ করার ঘোষণা চেয়ে সম্প্রতি হাইকোর্টে রিট হয়েছে। বারবার প্রস্তাব উত্থাপন হয়েছে সংসদে, সংসদের বাইরে। তবে প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রী বিনয়ের সঙ্গে হাত ও মাথা নাড়িয়ে না-সূচক উত্তর দিয়েছেন। এটা শেখ হাসিনার উদারতা-মহানুভবতা।
কিন্তু জাতি কি এটা মানতে পারে? কারণ, ভালো কাজ কিংবা উদ্যোক্তাকে পুরস্কৃত করার ইতিহাসও বিশ্বে অহরহ আছে। তাছাড়া এই যে শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে দুর্নীতির কালিমা থেকে দেশকে রক্ষা করলেন এবং সব ষড়যন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রর্দশন করলেন; একসঙ্গে এতগুলো প্রকল্প হাতে নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন-এসব কারণে হলেও পদ্মা সেতুর নামকরণ শেখ হাসিনার নামে করা যৌক্তিক বলে আমি মনে করছি। জাতিও এ বিবেচনা যথার্থ বলেই মনে করে। আমার কাছে এটা সহজেই অনুমেয় যে, নেত্রীর আস্থা, বিশ্বাস, সততা ও দেশপ্রেম তাকে এ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার রসদ জুগিয়েছে।
দেশের এমন উন্নয়ন বাস্তবতায় এবং সব ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে ধৈর্য ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে দেশকে সুন্দর আগামীর দিকে নিয়ে যাচ্ছেন বলেই তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মানের স্মারক হিসাবে জনগণ পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনা সেতু রাখার জোরালো দাবি তুলেছেন। তাতে নেত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি জাতি বিনয়ের সঙ্গে আশা করছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি উন্নয়নের নেত্রী। আপনি রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন বলেই অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ, নিরাপদ বাংলাদেশ। বিশ্বে সুখী দেশের কাতারে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শিল্পী আব্দুল আলিমের গানের কূলকিনারাহীন প্রমত্ত পদ্মায় একদিন ধূসর রঙে রঙিন স্বপ্ন রচিত হবে, এমন কথা কেউ কল্পনাও করেনি।
আপনি সেই স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং এর সফল বাস্তবায়ন করেছেন। দেশবাসী বিশ্বাস করে-আপনি আলোকবর্তিকা হয়ে উদ্যোগ না নিলে এ স্বপ্ন কখনো বাস্তবায়িত হতো না। আর এ কারণেই পদ্মা সেতুর নামকরণ ‘শেখ হাসিনা সেতু’ হলে আপনার প্রতি জনগণের আস্থা ও সম্মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে উদ্ভাসিত হবে এবং জনগণের দায়বদ্ধতা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। তা হবে আপনার এগিয়ে চলার স্মারক।
মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু : মুক্তিযোদ্ধা; সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ