রাষ্ট্রের ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ বাস্তবায়ন কৌশল
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বের বহু দেশে স্বাধীনতা দিবস এবং সংবিধান প্রবর্তন দিবস ছাড়াও ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ নামে একটি জাতীয় দিবস পালিত হয়। যেমন: ইতালি (জুন ২, ১৯৪৬), ইরাক (জুলাই ১৪, ১৯৫৮), ইরান (এপ্রিল ১, ১৯৭৯) এবং নেপাল (মে ২৮, ২০০৮) অন্যসব জাতীয় দিবস থেকে ভিন্ন ‘অনন্য’ দিবস হিসাবে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ পালন করে।
ইরাকের জন্য দিনটি রাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে ‘প্রজাতন্ত্রে’ রূপলাভের দিন, ইরানের কাছে দিনটি ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রে’ পরিণত হওয়ার দিন; আর নেপালের জন্য এটি ধর্মভিত্তিক ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ থেকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে উত্তরণের দিন। ভারত এবং পাকিস্তান অবশ্য নিজ নিজ দেশের সংবিধান প্রবর্তনের দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে পালন করে।
পাকিস্তান বাহিনীর হঠাৎ অনৈতিক ও নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার হয়ে পূর্ব বাংলা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ নাম নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে; তাই ২৬ মার্চ দেশটির ‘স্বাধীনতা দিবস’। প্রায় নয় মাস রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে এ জাতি ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ভোগ করে আসছে। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের ‘বিজয় দিবস’। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর নবপ্রবর্তিত সংবিধান গৃহীত হয়; তাই ৪ নভেম্বর আমাদের সংবিধান দিবস।
স্বাধীন বাংলাদেশের কি কোনো ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ আছে বা থাকার দরকার পড়ে? আমার চিন্তায় বাংলাদেশের একটি প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রয়োজন আছে। দিবসটি বহাল তবিয়তে বর্তমানও আছে, শুধু সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়ার অপেক্ষায়। সে দিনটি হচ্ছে ১৭ এপ্রিল (১৯৭১)। ইতিহাসের কয়েকটি পেছনের পাতা উলটে দেখা যাক।
দীর্ঘ ২৩ বছরের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট পূর্ব বাংলার জনগণ ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত ছয় দফার প্রতি একাত্ম হয়ে ১৯৬৯ সালে তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি; বরং সংসদ অধিবেশন ডেকেও তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন, তা আগে থেকেই সংগঠিত জাতিকে পবিত্র কোরানের ভাষায় ‘সিসাঢালা প্রাচীরের’ মতো একতাবদ্ধ করে তোলে।
তাই ২৬ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে এ জাতি কারও স্বাধীনতার ঘোষণার অপেক্ষায় থাকেনি; বরং ‘যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা’ শুরু করে। কিন্তু এসব যুদ্ধ মূলত ছিল ‘খণ্ডযুদ্ধ’ (battle); এরূপ খণ্ডযুদ্ধ করে দুর্ধর্ষ পাকবাহিনীর কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব ছিল না।
বঙ্গবন্ধুকে পাকবাহিনী আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়; অর্থাৎ আমরা জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল সংগঠক এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতৃত্বে পাইনি। কিন্তু ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়ী এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বিচক্ষণ ও নিবেদিতপ্রাণ তাজউদ্দীন আহমদ এবং সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ অন্য নেতারা আক্রান্ত দেশ থেকে পাশের দেশ ভারতে গিয়ে একত্র হয়ে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি করেন এবং স্বাধীন দেশ বাস্তবে অর্জনের জন্য অল্পসংখ্যক মন্ত্রী নিয়ে একটি সরকার গঠন করেন। স্বাধীনতার ওই ঘোষণাপত্র ইংরেজিতে রচনা করা হয়েছিল, যাতে তা বিশ্বের কাছে সহজে বোধগম্য হয়। ওই ঘোষণার প্রধান অংশ ছিল নিম্নরূপ:
‘We the elected representatives of the people of Bangladesh, as honour-bound by the mandate
given to us by the people of Bangladesh whose WILL is supreme, duly constituted ourselves
into a Constituent Assembly, and having held mutual consultations, and in order to ensure for
the people of Bangladesh equality, human dignity and social justice, DECLARE and
CONSTITUTE Bangladesh to be sovereign Peoples' Republic and thereby confirm the
declaration of independence already made...’ (সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করছি)।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Proclamation of Independence) এবং তা বাস্তবায়নের জন্য গঠিত সরকার বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান করে। ওই সরকার কলকাতার থিয়েটার রোডে অফিস নিয়ে ‘প্রবাসে’ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনা করে। বস্তুত স্বাধীনতার ওই ঘোষণাপত্র তৈরি করা এবং সরকার গঠন ও শপথগ্রহণ ছিল এক যুগান্তকারী ‘বজ্রনিনাদি’ (Big Bang) ঘটনা।
এ রকম যুগান্তকারী ঘটনার দিনকে শুধু ‘মুজিবনগর দিবস’ হিসাবে পালন করলে এর ‘বজ্রনিনাদি’ চরিত্রকে খাটো করা হয় এবং জাতির প্রধান নেতাদের অবদানও সংকীর্ণতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। এর ফলে আমরা গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী (Democratic Pluralism) চিন্তায় দেশ ও জাতির সংহতি গড়ার সুযোগ হারিয়ে ফেলি।
১. ধরুন, ১০ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচিত হয়নি; কোনো সরকারও গঠিত হয়নি। বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মতো সক্ষম ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য কোনো একক কমান্ডারও নিযুক্ত হননি। তাহলে অসংগঠিতভাবে এখানে-ওখানে খণ্ডযুদ্ধ করে কি আমরা সে বছর বিজয় অর্জন করতে পারতাম?
২. কিংবা সরকার গঠিত হলেও তার কেন্দ্রে তাজউদ্দীন আহমদের পরিবর্তে ৭০-এর নির্বাচনে জয়ী নেতাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ খন্দকার মোশতাক আহমদ থাকতেন বা অপরিণামদর্শী ছাত্রনেতাদের পছন্দের অন্য কেউ থাকতেন, তাহলেও কি দেশটি সে বছর স্বাধীন হতে পারত?
আমার চিন্তায় উপরের যে কোনো ক্ষেত্রে আমাদের বিপুল প্রাণক্ষয় সত্ত্বেও পরাজয় হয়তো আজও চলতে থাকত! সুতরাং, ওই ‘বজ্রনিনাদি’ ঘটনাকে স্বীকৃতি ও যথাযথ মর্যাদা দিয়ে স্বাধীনতার এ সুবর্ণজয়ন্তীতে ১৭ এপ্রিলকে বাংলাদেশের ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ ঘোষণা করা হোক। এতে বাড়তি আরেকটি সুবিধা পাওয়া যাবে: দেশের প্রধান নেতাদের, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের অবদানের প্রাপ্য স্বীকৃতি ও সম্মান দিয়ে তাদের পরিবারকে সত্যিকারভাবে খুশি করা যাবে। এতে জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
বাস্তবায়ন-কৌশল
এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় ‘বাস্তবায়ন পর্ষদ’ গঠন করা দরকার। এ পর্ষদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকতে পারেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তাদের নাম প্রস্তাব করছি কেন? কারণ, এ জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা রচনার মূল ভিত্তি ছিল দুটি: ১. ১৯৪০ সালে এ বাংলার সবচেয়ে শিক্ষিত, বিচক্ষণ ও প্রভাবশালী নেতা (যিনি ১৯১৬-১৮ সালে দুবছর Indian National Congress-এর General Secretary ছিলেন) শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ঘোষিত লাহোর প্রস্তাব এবং ২. অধ্যাপক রেহমান সোবহান কর্তৃক পাকিস্তানের দু-অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ, যা তার রচিত পুস্তক From two economies to two nations-এ বিধৃত।
আর ৯-১০ এপ্রিলের মধ্যবর্তী রাত জেগে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে নিভৃতে পথচলার সাথি, তখনকার তরুণ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। আমি আহ্বান জানাচ্ছি (আমি কি আহ্বায়ক?), প্রস্তাব করছি এবং প্রত্যাশা করছি-উল্লিখিত দুই পুরোধা ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে সুশীল সমাজের আরও উপযুক্ত সদস্যদের নিয়ে পূর্ণ পর্ষদ গঠন করে প্রজাতন্ত্র দিবস বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাবেন।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষা গবেষক (শিক্ষাবিজ্ঞানে ওভারসিস পিএইচডি) এবং প্রাণিবিদ্যার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)
asmolla@ymail.com