নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
অতিরিক্ত মুনাফাখোরির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ

ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

একই দিনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খবরের কথা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এর একটির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এবং অন্যটির ওপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এলপি গ্যাসের মূল্যের ওপর; আর অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছয়টি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্যের ওপর। বলা বাহুল্য, এলপি গ্যাস এবং ছয়টি ভোগ্যপণ্যের সব কটিই সাধারণ মানুষ ও মধ্যবিত্তের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়।
দেখা যাচ্ছে, ‘এনার্জি কমিশন’ এলপি গ্যাসের দাম বেসরকারি খাতের জন্য করেছে ৯৭৫ টাকা। রান্নায় ব্যবহৃত ১২ কেজি এলপি গ্যাস বেসরকারি খাতের ২০টি কোম্পানি বাজারে বিক্রি করবে ৯৭৫ টাকায়। আর যানবাহনে প্রতি লিটার বিক্রি হবে ৪৭ টাকা ৯২ পয়সায় (দুই পয়সা কোথায় পাওয়া যাবে?)।
এদিকে সরকারি খাতে ১২ দশমিক ৫ কেজি এলপি গ্যাস বিক্রি হবে ৫৯১ টাকায়। অর্থাৎ সরকারি খাতের তুলনায় বেসরকারি খাতে এলপি গ্যাসের মূল্য ৬৫ শতাংশ বেশি। এই হচ্ছে মূল্যের অধিকারের একদিক; আরেকটি দিক হচ্ছে, বেসরকারি খাতের নির্ধারিত মূল্য বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি।
যুগান্তরে এলপি গ্যাসের ওপর যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায়-এলপি গ্যাসের বাজারমূল্য ঢাকায় এক রকম; ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে আরেক রকম। দক্ষিণাঞ্চলে এলপি গ্যাসের বাজারমূল্য কম।
‘রাজধানীতে ১২ কেজি বা সাড়ে ১২ কেজির একটি বোতলের খুচরা মূল্য ১০৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে রয়েছে। তবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপজেলাগুলোতে সাড়ে ৯০০ টাকায়ও মিলছে এলপি গ্যাসের ১২ কেজির বোতল’-এ প্রতিবেদন ধরে বিচার করলে দেখা যাবে, মফস্বলের লোকদের এখন বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে এলপি গ্যাস কিনতে হবে। কারণ?
কারণ এলপি গ্যাসের মূল্য হবে অভিন্ন। সারা দেশে একই। এলপি গ্যাসের মূল্যের ক্ষেত্রের এ চাতুর্য আরও প্রকট হয় কৃষি বিপণন অধিপ্তরের মূল্যস্তর বিবেচনায় নিলে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে-‘বাজারদরের চেয়ে বেশিতে পেঁয়াজের দর নির্ধারণ।’
দেখা যাচ্ছে, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করেছে ৪০ টাকা। অথচ খুচরা বাজারে এ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৬-৩৮ টাকায়। রসিকতা, মহাচাতুর্য নয় কী?
পেঁয়াজ ছাড়া অধিদপ্তর আরও পাঁচ ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করেছে। সেগুলো হচ্ছে-ছোলা, মসুর ডাল, চিনি, খেজুর ও ভোজ্যতেল। এসবে পণ্যের সবগুলোর দামই বাজারমূল্যের গা ঘেঁষে ঘেঁষে করা হয়েছে। যেমন ছোলা। বাজারে এ পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭৫ টাকা কেজিতে।
আর সরকারের অধিদপ্তর এর দাম ঠিক করেছে ৬৩-৬৭ টাকা কেজি। মসুর ডালের বাজার দর কেজিপ্রতি ৬৮-৭০ টাকা। সরকার নির্ধারিত মূল্য হচ্ছে ৬৭-৬৯ টাকা। চিনির বাজার দর ৬৮-৭০ টাকা কেজি। পত্রিকান্তরের খবরানুযায়ী সরকারি দাম হচ্ছে, ৬৭-৬৮ টাকা কেজি। ভোজ্যতেলের এক লিটারের বাজারমূল্য ১৩৫-১৪০ টাকা। সরকারের নির্ধারিত মূল্য হচ্ছে, ১৩৯ টাকা।
প্রতিবেদনের সবগুলো পণ্যের দাম উল্লেখ করলাম এটা বোঝানোর জন্য যে, সরকারি দপ্তরগুলো দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক ভোক্তা, সর্বোপরি সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকদের সঙ্গে কী ফাঁকিবাজি ও প্রতারণাই না করছে!
দেখা যায়, সরকারি দপ্তর ও কমিশনগুলো বাজারে জিনিসপত্রের দাম যখনই বাড়ে, তখনই মূল্য নির্ধারণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং তারা মূল্য নির্ধারণের নামে যা করে, তাতে মধ্যবিত্তের বিড়ম্বনা বাড়ে বৈ কমে না। প্রথমত, কোনো পণ্যই বাজারে সরকারি মূল্যে দোকানদাররা বিক্রি করে না।
এ নিয়ে সব সময় ক্রেতা-দোকানদার বচসা লেগেই আছে। সবচেয়ে বড় কথা, মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চমূল্য স্তরকেই ভিত্তি হিসাবে ধরে। ১০ টাকার পণ্যের দাম ১৫ টাকায় তোলা হলো। পাঁচ টাকা বাড়ানো হলো।
সরকারি দপ্তর কখনো ১০ টাকাকে ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারণ করে না। দোকানদার, পাইকার ও আমদানিকারকরা যে অধিকতর মূল্যে বিক্রি করে, তাকে ভিত্তি করেই মূল্য নির্ধারণ করে। ফলে দেখা যায়, পণ্যের বাজার একবার চড়া হলে তার দাম আর কমে না।
এর দ্বারা ব্যবসায়ীদের মুনাফাখোরির স্বীকৃতি দেওয়া হয় প্রতি বছর। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সরকারের নির্ধারিত মূল্যে বাজারে কখনো পণ্যদ্রব্য বিক্রি হয় না।
এর চেয়ে বরং খোলাবাজারি অপারেশন (ওপেন মার্কেট অপারেশন) অধিকতর কার্যকর। লাইনে দাঁড়িয়ে হলেও নির্ধারিত মূল্যে পণ্য পাওয়া যায়। এ ধরনের অপারেশন বাজারে সরবরাহ বাড়ায়। আর পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলে ব্যবসায়ীরা সরকারি দপ্তরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়।
চালের দাম, চামড়ার দাম, মাংসের দাম ইত্যাদি কয়েকটি উদাহরণ। প্রতি বছর দাম নির্ধারিত হয় আর মূল্য সরকারি অনুমোদনক্রমে এক টাকা ওপরে ওঠে। সরকার আবার মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ভোগান্তি বাড়ে মধ্যবিত্ত ভোক্তা ও সাধারণ মানুষের।
এ মুহূর্তের ঘটনা এলপি গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের প্রশ্নটি দেখা যাচ্ছে, ঝুলে ছিল বহুদিন। বেসরকারি খাত এ সুযোগে দাপিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছিল। দামের ক্ষেত্রে চলছিল এক ধরনের অরাজকতা। যে যা পারে, তাই মূল্য হিসাবে আদায় করছিল। সরকারি গ্যাসবঞ্চিত মধ্যবিত্ত বাধ্য হয়ে বাজার থেকে মালিক নিয়ন্ত্রিত মূল্যে এলপি গ্যাস কিনছিল। সরকার এ ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছিল না।
এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়-এলপি গ্যাসের মূল্য স্থির করার এখতিয়ার ‘বিইআরসির’। এ অবস্থায় ‘কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ হাইকোর্টে একটি রিট করে। দীর্ঘ ৬ বছর পর আদালতের রায় পাওয়া যায়; গণশুনানির মাধ্যমে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণের জন্য মহামান্য আদালত কমিশনকে নির্দেশ দেয়। এর ফলেই বর্তমান মূল্য নির্ধারিত হয়েছে।
কমিশনের যুক্তি হচ্ছে-আন্তর্জাতিক বাজার দর এবং ব্যবসায়ীদের নানা খরচ আমলে নিয়ে এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কমিশনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ভর্তুকি সম্পর্কে। কমিশন বলেছে, ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষমতা কমিশনের নেই। তাহলে ভর্তুকি কে দেবে? অবশ্যই সরকার। দেখা যাচ্ছে, ভর্তুকি তো দূরের কথা; কমিশন এমন সময়ে উঁচু স্তরে, বাজার মূল্যের চেয়ে বেশিতে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করেছে, যখন দেশে এক চরম অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে।
করোনা-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালে কোনো জায়গা নেই। সরকার লকডাউন দিয়েছে। সবকিছু বন্ধ। মানুষের চাকরি নেই, কাজকর্ম নেই। চাকরিচ্যুতি ঘটছে।
এরই মধ্যে এসেছে নববর্ষ, বাংলা নববর্ষ। একই দিনে পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে। মানুষ যখন দুর্দশাপীড়িত; যখন সবাই চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে, তখন বিবেকসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
অথচ তাই হয়েছে। সরকার তো কিছু ভর্তুকি দিয়ে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করতে পারত। যেখানে সরকারি এলপি গ্যাসের মূল্য ৫৯১ টাকা, সেখানে কোন বিবেচনায় বেসরকারি খাতের এলপি গ্যসের মূল্য নির্ধারিত হয় ৯৭৫ টাকায়। এতো দেখা যাচ্ছে মগের মুল্লুকের ব্যাপার!
বেসরকারি খাত মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে নানা যুক্তি দিয়েছে। তাদের খরচের তালিকা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, এসব খরচের চুলচেরা বিশ্লেষণ কি করা হয়েছে? এটা মনে করা কঠিন। গত এক বছর, এমনকি আরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস, এলপি গ্যাসের মূল্য ছিল নিুমুখী।
এ নিুমুখী বাজারের কোনো সুবিধা ক্রেতা সাধারণ পায়নি। বেসরকারি খাত তো দূরের কথা, সরকারও এ ক্ষেত্রে কোনো রেয়াত দেয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম, অথচ অভ্যন্তরীণ বাজারে পেট্রল, ডিজেলের দাম এক পয়সাও কমেনি। এর অর্থ ভর্তুকির প্রয়োজনীয়তা হয়নি। সে টাকায় তো বিরাট একটা ‘ফান্ড’ গড়ে ওঠার কথা। যদি হতো, তা থেকেই এলপি গ্যাসে ভর্তুকি দিয়ে দাম নির্ধারণ করা যেত না কি?
মনে রাখা দরকার, এলপি গ্যাসের ক্রেতা-ভোক্তা হচ্ছে মধ্যবিত্ত-নিুমধ্যবিত্ত; যারা পাইপের মাধ্যমে সরকারি গ্যাস সরবরাহ থেকে বঞ্চিত। এই শ্রেণির লোকেরা সরকারের কোনো সুবিধা পায় না। তারা লাইনে দাঁড়িয়ে চাল কিনতে পারে না, পেঁয়াজ কিনতে পারে না।
তারা সরকারের ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির’ আওতাধীন কোনো সুবিধাও পায় না। অথচ এরাই কিন্তু সঞ্চয়ী। ব্যাংকের আমানতের উৎস তারাই। সঞ্চয়পত্রের ক্রেতা তারাই। এরা সরকারকে নিয়মিত কর দেয়। অথচ সরকার বা কমিশন কেউ তাদের স্বার্থ দেখে না, কখনো না। অথচ এ সময়ে তারা এটা পেতে পারত। তারা খোলাবাজারের অত্যাচারে এমনিতেই ব্যতিব্যস্ত।
বর্তমানে প্রতিটি পণ্যের মূল্য ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছে। চাল দিয়ে এর শুরু। যখনই খবর হলো, সরকারি গুদামে চালের স্টক কম, তখনই ব্যবসায়ী ও চাতাল মালিকরা চালের দাম বাড়াতে শুরু করে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে শাকসবজির দাম, মাছ-মাংসের দাম।
পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে আজ এক মাসেরও অধিক সময় হলো, ব্যবসায়ীরা ভোগ্য পণ্যের দাম বাড়ানো শুরু করে। চাল, ডাল, লবণ, তেল, খেজুর, ছোলা, সয়াবিন, মসুরের ডাল, পেঁয়াজ ও মসলাপাতি ইত্যাদির দাম আজ নজিরবিহীনভাবে চড়া।
অথচ জরিপের পর জরিপ বলছে-মধ্যবিত্তের আয় হ্রাস পেয়েছে এবং পাচ্ছে। মধ্যবিত্ত নিুমধ্যবিত্ত হচ্ছে, নিুমধ্যবিত্ত দরিদ্র হচ্ছে।
তাদের সঞ্চয় শেষ, অনেকে বাড়িঘর বিক্রি করতে চাইছে, অথচ ক্রেতা নেই। তারা ঢাকা শহর ছাড়ছে বাসা ভাড়া দিতে পারে না বলে। তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ; অনলাইনে লেখাপড়া অনেকে বোঝে না বলে। এ ধরনের অসহায় মধ্যবিত্তকে, এলপি গ্যাস গ্রাহককে সরকার একটু ভর্তুকি দিয়ে গ্যাস দিতে পারত না কি?
দেখা যাচ্ছে, ভর্তুকি তো দূরের কথা; সরকারি দামের চেয়ে বেসরকারি এলপি গ্যাসের মূল্য ৬৫ শতাংশ বেশি। এটা কি মধ্যবিত্তের প্রতি অবিচার নয়? তাও আবার পবিত্র রমজান মাসে।
শুনেছি, পৃথিবীর অনেক দেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময়, উৎসবের সময় সরকার এবং বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম কমায়। ক্রেতা-ভোক্তাদের সাহায্যে সবাই এগিয়ে আসে। সরকার-কমিশন কি এ ধরনের দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারত না! পারত না এলপি গ্যাসের দাম অন্তত সরকারি দামের পর্যায়ে রাখতে?
আসলে বেসরকারি খাতের একটি অংশ ‘বেপরোয়া বেসরকারি খাতে’ পরিণত হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত বলে মনে হয়। তারা মধ্যবিত্তের কোনো স্বার্থই দেখতে রাজি নয়। অথচ মধ্যবিত্ত সমাজের চালিকাশক্তি। তারাই সঞ্চয় করে, তারাই উদ্যোক্তা হয়, তারাই উন্নয়নের হাতিয়ার। মধ্যবিত্তের আকার বড় হলে অর্থনীতি উপকৃত হয়। এ ধরনের মধ্যবিত্তকে প্রথমেই বঞ্চিত করা হয় সরকারি গ্যাস থেকে।
অথচ বাড়িতে বাড়িতে যে গ্যাস, তা মোট গ্যাস সরবরাহের কত শতাংশ? একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মোট গ্যাসের প্রায় ৪২ শতাংশ বিদ্যুতের জন্য ব্যবহৃত হয়। গৃহস্থালি গ্যাস মাত্র ১৪ শতাংশ ও শিল্প ব্যবহৃত হয় ১৬ শতাংশ। এভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে, গৃহস্থালি খাতে সরকারি গ্যাসের খুব অল্পই খরচ হয়। অথচ একে একটা বড় ইস্যু করে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে বেসরকারি খাতকে অবাধ গ্যাস বাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
‘সিস্টেম লস’ নামীয় দৈত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে গ্যাস খাতের খরচ সরকার কমাতে পারত। এ অপচয় মোট গ্যাসের ১২-১৩ শতাংশ। টাকার অঙ্কে বছরে তা দাঁড়ায় ৯ হাজার কোটিতে। অথচ এসবের কোনো প্রতিকার না করে মধ্যবিত্তকে শায়েস্তা করার আরও ব্যবস্থা হচ্ছে বাসা-বাড়িতে সংযোগের গ্যাসের মূল্য বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে নির্ধারিত হবে বলে একটি ঘোষণা আসছে। এটি হলে মধবিত্তের সংসার খরচ আসমানে উঠবে। এ মূল্যস্ফীতির বাজারে তা হবে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।
এ নিবন্ধনটি লিখতে লিখতেই পত্রিকায় সংবাদ দেখলাম (১৪.০৪.২১), ‘বাঁধা দামে বিক্রি হচ্ছে না এলপিজি’। একে তো উচ্চস্তরে মূল্য নির্ধারণ, তাও সেই দামে বিক্রি হচ্ছে না! তাহলে প্রশ্ন, সরকার কেন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, এলপিজির দাম নির্ধারণ করে? খুচরা দোকানিরা বলছে, কোম্পানি দাম না কমালে তারা কম দামে বিক্রি করবে কীভাবে? ন্যায্য উত্তর। বড় বড় কোম্পানি দাম কমাবে কবে?
তারা দাবি করছে, এ খাতে তারা নাকি ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। প্রশ্ন, এ টাকার কত অংশ তাদের, কত অংশ ব্যাংকের? সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকে রক্ষিত সাধারণ আমানতকারী, মধ্যবিত্ত আমনতকারীদের টাকা নিয়ে তারা গ্যাস খাতে বিনিয়োগ করেছেন। চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও তো তাদের উচিত, মধ্যবিত্ত গ্রাহকদের স্বার্থ দেখা। কিন্তু স্পষ্টতই তারা তা করছেন না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সরকারি বিভাগের আশকারা, ঔদাসীন্য, নিয়ন্ত্রণহীনতা ও বেসরকারি খাতের গ্যাস ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফাখোরির শিকার হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এ থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কী?
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়