যানজটে ক্ষতি কতটা?

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
সাম্প্রতিককালে যানজটে মানবজাতি অনেকটা উদ্বিগ্ন। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি ও অপরিকল্পিত নগরায়ণে যানজট ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। ২০২০ সালে বিশ্বের ১০টি মেগা শহরের ওপর জরিপে দেখা যায় যে, যানজটে ভারতের বেঙ্গালুরুর অবস্থান শীর্ষে। যানজটহীন শহরের তুলনায় ওই শহরে ভ্রমণে প্রায় ৭১ শতাংশ বেশি সময়ের প্রয়োজন। ওই জরিপে যানজটে সেন্ট পিটার্সবার্গের অবস্থান সর্বনিম্নে রয়েছে। যদিও যানজটহীন শহরের তুলনায় এই শহরে ভ্রমণে প্রায় ৪৪ শতাংশ অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন। অন্যদিকে ম্যানিলা, ইস্তাম্বুল, নয়াদিল্লি, ব্যাংকক, পেরু, জাকার্তা, মস্কো, বেগোটা, বোম্বে, পুনে (ভারত) ও কলোম্বিয়া শহরে প্রায় ৫৩ থেকে ৭১ শতাংশ অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন, যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
২০২০ সালের ট্রাফিক ইনডেক্সে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ৬টি মহাদেশে ৫৭টি দেশের ৪১৬টি শহরের মধ্যে যানজটে রাশিয়ার মস্কোর অবস্থান শীর্ষে। ওই শহর ভ্রমণে প্রায় ৫৪ শতাংশ অতিরিক্ত সময় ব্যয় হচ্ছে, যা মানুষের জীবনযাত্রার মান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রায় ১৮ মিলিয়ন লোক বসবাস করছে। জনসংখ্যার ঘনত্বও বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেক বেশি। বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে মৌলিক চাহিদার ওপর চাপও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৌলিক চাহিদা পূরণে গ্রামাঞ্চলের মানুষেরও ঢাকা শহরে আগমন দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। যদিও মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ জায়গার সংকুলান রয়েছে; তবুও ঢাকা শহরকে বিশ্বের ১১তম মেগা শহর হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
যা হোক, বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ ছাড়াও ঢাকা শহরে যানজট বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ট্রাফিক নিয়মের লঙ্ঘন, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও শহরায়ন নির্মাণ, অনিয়ন্ত্রিত গাড়ির গতি, অপরিকল্পিত পার্কিং, মাত্রাতিরিক্ত রিকশা, প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতা, মাত্রাতিরিক্ত ব্যক্তিগত গাড়ি, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণের অভাবে ঢাকা শহরে যানজটের মাত্রা আগের তুলনায় ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। যানজটে বায়ুদূষণের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। এ বায়ুদূষণ মানবজাতির স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের অন্তরায়। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ট্রাফিক প্রেসারে কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, ভোলাটাইল জৈব কার্বন, হাইড্রোকার্বন, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও পার্টিকুলেটস ম্যাটারের মাত্রা লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যাচ্ছে, কোনো রাস্তার ওপর দিয়ে যদি বছরে ১০ হাজার গাড়ি যাতায়াত করে, তাহলে ওই রাস্তার পাশে বসবাসরত মানুষের মধ্যে প্রায় ৬০৯ জন বায়ুদূষণজনিত সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ওই এলাকায় বায়ুদূষণজনিত সমস্যায় মৃত্যুর হার বছরে শূন্য থেকে ১১৮৯ জন পর্যন্ত হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে রাজধানীতে গাড়ির গতি প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে কমে ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে যানজটে গাড়ির গতিসীমা ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। যদি এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, তাহলে দিনে ৫ মিলিয়ন ঘণ্টা কর্মক্ষমতা অপচয় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং অর্থনৈতিকভাবে বছরে প্রায় ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হতে পারে। গবেষকদের মতে, ট্রাফিক প্রেসারে মানুষ শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৮৭ শতাংশ বাস ও মিনিবাস ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন করছে। পরিসংখ্যানগত তথ্যে দেখা যায়, ওই নিয়ম লঙ্ঘনে প্রতিদিন অন্তত ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে গড়ে প্রায় ১৫০ জন শারীরিকভাবে আহত হচ্ছে। দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় যে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৮৪১ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এর বাইরে ৫ হাজার ৪৭৭ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে।
বিশ্বের সব মেগা শহরেই যানজট দৃশ্যমান; কিন্তু ঢাকা শহরের যানজট বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেকটা ব্যতিক্রম। এই শহরে বহু ধরনের ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা দৃশ্যমান রয়েছে। সম্প্রতি সরকার ঢাকা শহরে যানজট নিরসনে বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ রাস্তা সম্প্রসারণ, ফুটপাত নির্মাণ, ফ্লাইওভার ও ওভারব্রিজ নির্মাণ ইত্যাদি। পরিসংখ্যানগত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১ শতাংশ জায়গা ঢাকা শহরে বিদ্যমান। কিন্তু জিডিপিতে ঢাকা শহরের অবদান প্রায় ৩৬ শতাংশ। বিদ্যমান যানজটেও ঢাকা শহরে দেশের মোট কর্মমুখী মানুষের প্রায় ৪৪ শতাংশ কর্মরত রয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন নিবন্ধনকৃত গাড়ি রয়েছে। ওই নিবন্ধনকৃত গাড়ির প্রায় ৭২ শতাংশই ফিটনেসবিহীন। ২০১৬ সালের তথ্যে দিনে ঢাকা শহরে প্রায় ৩০ মিলিয়ন গাড়ির ট্রিপস দেখা যায়। তার মধ্যে ৪৭ শতাংশ বাস, ৩২ শতাংশ রিকশা ও ৯ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে। ওই গাড়িগুলোর প্রায় ৭৬ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তার ওপর নিয়মিত পার্কিং করছে। জরিপে দেখা যায়, রাস্তার মাত্র ৭ শতাংশ জায়গা পাবলিক গাড়ি কর্তৃক ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বছরে প্রায় ২০ হাজার নতুন গাড়ি ঢাকা শহরে যোগ হচ্ছে। নতুন গাড়িগুলোর জন্য পার্কিংয়ের কোনো জায়গা বাড়ছে না। সুতরাং একদিকে ক্রমান্বয়ে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ, অন্যদিকে নতুন গাড়ির আবির্ভাবে ঢাকা শহরে যানজটের মাত্রা লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে। দৃশ্যত ওই গাড়িগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার ওপর পার্কিংয়ে রয়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলেও আইনগত পদক্ষেপের দুর্বলতায় ভবিষ্যতে যানজটের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
যা হোক, সরকার ঢাকা শহরের যানজট দূরীকরণে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। যদিও এসব মেগা প্রকল্পে যানজট সাময়িক কমবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি যানজট সমস্যা দূরীকরণে ঢাকা শহরের বিকেন্দ্রীকরণ অতীব জরুরি। এতে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা আরও বেগবান হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা শহরে ট্রাফিক ব্যাপস্থাপনার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। সরকার ইতোমধ্যে ঢাকা শহরে যানজট কমানোর ব্যাপারে ডিজিটাল ট্রাফিক সিস্টেম চালু করেছে। আশা করা যাচ্ছে, এ সিস্টেম ঢাকা শহরে যানজট কমানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যদি যানজট কমানো যায়, তাহলে মানুষের স্বাস্থ্যগত, অর্থনৈতিক ও পরিবেশের বিপর্যয়ের মাত্রা কমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
mohammad.alam@wsu.edu