তৃতীয় মত
স্বাধীনতার উৎসবে তাদেরও স্মরণ করা উচিত
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছি। এর চেয়ে বড় গৌরব ও গর্বের আর কিছু নেই। এ ৫০ বছরে এসে আমরা পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখছি আমাদের অর্জন কতটা এবং এ অর্জনের জন্য ত্যাগ ও তপস্যায় কারা স্মরণীয়। সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। করোনাভাইরাসের মারাত্মক সংক্রমণের দরুন এ উৎসব অনুষ্ঠান কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু মৃত্যু ও মহামারি জাতির প্রাণের আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে রুখে দিতে পারেনি।
আমাদের স্বাধীনতা এসেছে রক্ত-পিচ্ছিল পথে। ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান এবং সাড়ে ৩ লাখ বীরাঙ্গনার সম্ভ্রম বলিদানেও আমাদের স্বাধীনতা তৃপ্ত হয়নি। স্বাধীনতার পর রক্ত দিতে হয়েছে স্বয়ং জাতির পিতাকে। তার পরিবারের সদস্যদের। তার সহকর্মী পাঁচ জাতীয় নেতাকে। তারপরও রক্তদানের পালা শেষ হয়নি। সামরিক শাসন, স্বৈরাচারী শাসনে নিস্পিষ্ট হয়েছে মানুষ। রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, মুক্তবুদ্ধির মানুষের হত্যা চলেছিল দীর্ঘদিন। রাজনৈতিক সন্ত্রাসে সাধারণ মানুষ ভুগেছে দীর্ঘকাল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন : ‘মধ্যযুগ এতো রক্ত দেখেছো কখনো?’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাস এবং তার পরবর্তী কাহিনি জানতে পারলে জীবনানন্দ কী লিখতেন তা অনুমান করা কষ্টকর নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন, যারা যুদ্ধে নেতৃত্ব না দিলে, প্রাণ না দিলে এ স্বাধীনতা অর্জিত হতো না, তাদেরও আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করা উচিত।
এবার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সমগ্র জাতি যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করেছে। শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। অবশ্যই জাতির পিতাকে এভাবে স্মরণ করা ও শ্রদ্ধা জানানো উচিত হয়েছে। তিনি ২০ শতকের ইতিহাসের এক অনন্য নায়ক। আমরা গর্বিত তিনি বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন। তাকে এ শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় তার বীর সহযোদ্ধা, যাদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এসেছে, যারা স্বাধীনতার আদর্শ রক্ষায় প্রাণ দিয়েছেন, তাদের স্মৃতিকেও শ্রদ্ধাভরে সমানভাবে স্মরণ করা হলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন সম্পূর্ণ হতো। জয়ন্তী পালনে তাদের যে স্মরণ করা হয়নি তা নয়, তবে যথাযোগ্য শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে তা বলা যাবে না।
কমিউনিস্ট দেশগুলোতে কার্ল মার্কসের ছবি যখন দেখানো হয়, তখন আরও দুজনের ছবি মার্কসের ছবির সঙ্গে থাকে। একজন মার্কসের বন্ধু এঙ্গেলস, অন্যজন প্রথম মার্কসবাদী কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা লেনিন। এ দুজনের ছবি মার্কসের ছবির সঙ্গে থাকায় মার্কসের মহত্ত্ব বা গরিমা কোনোটাই কমেনি; বরং বেড়েছে। ভারতের রাজনীতিতে জওহরলাল নেহেরু ছিলেন গান্ধীজির শিষ্য। এ গুরু-শিষ্যের মধ্যে কখনো কখনো রাজনৈতিক মতভেদ হয়নি, তা-ও নয়। কিন্তু ইতিহাস সেটাকে বড় করে তুলে ধরেনি। তুলে ধরেছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের যৌথ নেতৃত্বকে।
গান্ধীকে জাতির পিতার মর্যাদা দেওয়া হলেও নেতা গান্ধী-নেহেরু নাম দুটি যুক্তভাবে উচ্চারণ করা হয়। তাতে গান্ধীজির শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব তিলমাত্র কমেনি; বরং বেড়েছে। এখন তো গান্ধী-নেহেরুর চিরবৈরী সুভাষচন্দ্র বসুকেও স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর নায়ক হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তাতে গান্ধীজি তার স্থানচ্যুত হননি।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, স্বাধীনতা ও স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, এ কথা এখন ইতিহাসসম্মতভাবে স্বীকৃত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকেও বঙ্গবন্ধু হওয়ার জন্য এক নারীর সাহায্য নিতে হয়েছিল, তিনি বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু নিজেই একদিন আমাদের বলেছেন, ‘তোদের ভাবি না থাকলে আমি আজ বঙ্গবন্ধু হতে পারতাম না’। বঙ্গবন্ধু নিজের মেধা ও নেতৃত্বগুণেই হয়তো বঙ্গবন্ধু হতেন, কিন্তু তার জীবনের মূল লক্ষ্য স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলা প্রতিষ্ঠা হয়তো সম্ভব হতো না, যদি তিনি পাঁচজন একনিষ্ঠ সহকর্মীর অকুণ্ঠ ও আন্তরিক সমর্থন না-পেতেন এবং এক কালজয়ী সাংবাদিকের নির্ভীক লেখনী তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা না-জোগাত।
এই পাঁচ সহকর্মী হলেন: তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং বরিশালের আবদুর রব সেরনিয়াবাত। নির্ভীক কালজয়ী সাংবাদিক ছিলেন ‘দৈনিক ইত্তেফাকের’ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (মুছাফির), যাকে অনেকে বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের ভল্টেয়ার। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে রুশো-ভল্টেয়ার যেমন দুটি অবিভাজ্য নাম, তেমনি বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে মানিক মিয়া একটি অবিভাজ্য নাম।
বঙ্গবন্ধু রয়েছেন সবার মাথার ঊর্ধ্বে। কিন্তু ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এই পাঁচ নেতা এবং এক সম্পাদক তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন না-দিলে বাংলাদেশের ইতিহাস আজ অন্যরকম হতে পারত। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে পুনর্গঠনে হাত দেন, তখন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা একে একে তার পাশ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফার ঘোষণা দিলে এ প্রবীণ নেতারা সক্রিয়ভাবে বঙ্গবন্ধুর নীতি ও নেতৃত্বের বিরোধিতায় মাঠে নামেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর পাঁচ তরুণ সহকর্মীই ছিলেন জেলা পর্যায়ের নেতা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উঠে আসেন এবং শত নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, ছয় দফা, পরে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
মানিক মিয়া ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ প্রবীণ নেতারা চেষ্টা করেছিলেন, তাকে তাদের দলে টেনে রাখতে। মানিক মিয়া ছয় দফা সমর্থন বিপজ্জনক জেনেও এই ছয় দফার পক্ষে জোরালো কলম ধরেন। আইয়ুব-মোনেম সরকার তাকে গ্রেফতার করে। তার প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়, ইত্তেফাকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। দীর্ঘকাল কারাগারে থেকে মানিক মিয়ার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। এ ভাঙা স্বাস্থ্য আর জোড়া লাগেনি। ’৬৯ গণ-অভ্যুত্থানের ফলে তিনি ইত্তেফাক ফিরে পান, কিন্তু নিজে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এটাকে বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামেই তার আত্মদান বলা চলে। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে রুশো ও ভল্টেয়ারের লেখনীকে যেখানে অবিভাজ্য মনে করা হয়, সেখানে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে মানিক মিয়ার লেখনী অবিভাজ্য মনে করা হলে অন্যায় করা হয় না।
আর তখনকার পাঁচ যুবাবয়সি নেতাকে তো বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা, তার সংগ্রামের অকুতোভয় সেনানী বলা চলে। আবদুর রব সেরনিয়াবাত ছিলেন কৃষক নেতা। ভাসানী ন্যাপের বরিশাল জেলার নেতা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অপর চারজন নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীও ছিলেন জেলা পর্যায়ের নেতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হলে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহচর হিসাবে তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উঠে আসেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের হানাদারদের হাতে তিনি গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর এ পাঁচ নেতাই মুক্তাঞ্চলে গিয়ে মুজিবনগরে অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসে হন এ সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন হন প্রধানমন্ত্রী। এ সরকারের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মি গড়ে ওঠে। দেশ হানাদারমুক্ত হয়। এ স্বাধীনতার যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত থেকেও উপস্থিত ছিলেন এ পাঁচ নেতার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু তার এ যোগ্য কয়েকজন সহকর্মী ও সহযোদ্ধা পেয়েছিলেন এবং একটি সংগ্রামী যুব নেতৃত্ব তার সংগ্রামের অগ্রদূত হয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশ অতি অল্প সময়ের মধ্যে সশস্ত্র যুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে এবং এখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে পারছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনে আমরা যেমন ৩০ লাখ শহিদকে শ্রদ্ধা জানাব, তেমনি স্বাধীনতাযুদ্ধের যে পাঁচ মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই এ যুদ্ধ পরিচালনা করে দেশ স্বাধীন করেছেন এবং পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই একই বছরে স্বাধীনতার শত্রুদের হাতে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাদেরও কি আমরা সমান শ্রদ্ধা জানাব না, সমানভাবে স্মরণ করব না? এবারের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমরা মুজিবনগর সরকারের এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের আর সব মহানায়কের উপস্থিতি টের পাইনি। তাদের অতুলনীয় আত্মত্যাগ নিয়ে লেখা গ্রন্থ কোথায়, পাঠ্যপুস্তকে তাদের জীবন ও কর্মের বিবরণ কোথায়? স্বাধীনতা দিবসের উৎসবে তাদের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন কোথায়? কিছু গলি ও অপরিচিত রাস্তায় তাদের নাম যুক্ত করা হলেই কি তাদের স্মৃতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন হয়ে গেল? এ বছর মার্চ মাসে আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যখন মহাসমারোহে পালিত হচ্ছিল, তখন এ প্রশ্নগুলো অনেকের মতো আমার মনেও জেগেছে।
লন্ডন, ৪ এপ্রিল, রোববার, ২০২১