বাংলাদেশ-চীন মুক্তবাণিজ্য : সমস্যা ও সম্ভাবনা
মকসুদুজ্জমান লস্কর
প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০১৮, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আলোচনা আবার শুরু হচ্ছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে। চীনের প্রেসিডেন্টের সর্বশেষ ঢাকা সফরের পর মুক্তবাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে চীনের একটি প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনার কথা শোনা গিয়েছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মুক্তবাণিজ্য সম্পাদনের বহুমুখী ঝুঁকির কথা ভেবে বাংলাদেশ সরকার খুব সম্ভবত আর অগ্রসর হয়নি।
এর মাঝেই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান পাওয়ার যেমন সম্মান ও সুবিধা আছে, ঠিক তার বিপরীতে কিছু ব্যথাও আছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যথা হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বর্তমানে প্রাপ্ত বিভিন্ন বাণিজ্য সুবিধা কয়েক বছরের মধ্যে প্রত্যাহৃত হবে।
বিশেষ করে উন্নত দেশসমূহ বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে যে শুল্ক হ্রাস সুবিধা দিয়ে থাকে, তা কয়েক বছরের মধ্যে বাতিল হয়ে যাবে। আর তখন শুরু হবে বাজার ধরে রাখার প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট গবেষকরা উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হওয়ার পর বাংলাদেশের রফতানি কমে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন। আর তাই এখন প্রয়োজন বিভিন্ন দেশ ও গোষ্ঠীর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বাণিজ্য সুবিধা আদায় করে রফতানি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যে বর্তমানে বড় ঘাটতি রয়েছে। চীন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে প্রায় ৫০০ পণ্যের ওপর বিনা শুল্কে রফতানির সুবিধা প্রদান করেছে। এর ফলে রফতানির প্রবৃদ্ধির হার কয়েকগুণ বাড়লেও অঙ্কের হিসাবে তা একেবারেই কম। বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসে তাতে তেমন কোনো প্রভাবই পড়েনি।
চীন বিশ্বের ২য় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। কেউ কেউ অবশ্য চীনকে আমেরিকার আগে স্থান দিয়ে থাকেন। সমগ্র বিশ্বে চীনা পণ্যের আগ্রাসন সর্বজনবিদিত। আর তাই বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থা চালু হলে আরও বেশি চীনা পণ্যের বাংলাদেশে প্রবেশের ভয় অমূলক নয়। আর বাংলাদেশের পণ্যের ঝুড়িতে পণ্যের বাহার খুব কম বলে তা রফতানি করে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে, এমন ভাবা যায় না।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মুক্তবাণিজ্যের বিষয়টি বিবেচনা করার আগে আমাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতির আগামী গতি-প্রকৃতি, চীনা অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি ছাড়াও আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়াবলি মাথায় রাখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে চীনের অর্থনীতির তুলনা করা অবান্তর। তবে চীনের বিশাল বাজার তথা প্রায় ১৪০ কোটি লোকের দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সন্ধান করাটা অবান্তর নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মুক্তবাণিজ্যের বিষয়টির সঙ্গে বাংলাদেশের ১৬ কোটি লোকের এবং চীনের ১৪০ কোটি লোকের বাজার তত্ত্বটি বিবেচনায় আনা যায়।
চীনের যেমন বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাজারের দিকে দৃষ্টি রয়েছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি বাংলাদেশকেও চীনের প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার একটা বিশাল বাজারের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান আমদানির এক-চতুর্থাংশ অংশীদারিত্ব রয়েছে চীনের। দেশটি বাংলাদেশের আমদানির সর্ববৃহৎ উৎস।
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ২০০৩ সাল থেকে চীনের বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার শুরু হয়। চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক সম্প্রসারণের প্রচেষ্টার পাশাপাশি এতদঞ্চলে বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়াও শুরু করে। এক হিসাব অনুযায়ী ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সালে চীনের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশসহ মালদ্বীপ, ভুটান ও শ্রীলংকার বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ছয়গুণ বৃদ্ধি পায়।
একই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় প্রায় ৪ গুণ। অর্থাৎ এই অঞ্চলে চীন বিশেষ দৃষ্টি দেয় যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এই ৫টি দেশের চীনের পণ্যের ওপর নির্ভরতা ২০০৩ সালে যেখানে ছিল ১৫ শতাংশ সেটি ৮ বছর পর তথা ২০১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ শতাংশে।
চীন প্রথমদিকে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নে মৈত্রীসুলভ সহযোগিতা করলেও তা পরবর্তী সময়ে লাভজনক বিনিয়োগের দিকে মোড় নেয়। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র ও ৭টি মৈত্রী সেতু নির্মাণের বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্তমান সরকারের আমলে চীনের বড় বড় কোম্পানি বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কার্যাদেশ পাচ্ছে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাবে যে, ১৯৯৭-৯৮ ও ২০১২-২০১৩-এর মাঝে বাংলাদেশে চীনের রফতানি বেড়েছে প্রায় দশ গুণ। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশে চীনের রফতানি ছিল ৫৯২.৪৬ মিলিয়ন ডলার কিন্তু ২০১২-১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬৩০০ মিলিয়ন ডলারে। আবার বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানি বেড়েছে ১০.৫৯ গুণ।
১৯৯৭-৯৮ সালে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৯ মিলিয়ন ডলার। ২০১২-১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৮ মিলিয়ন ডলার। ২০১২-১৩ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের আমদানি-রফতানি অনুপাত হচ্ছে প্রায় ১:১৪। ২০০৮-৯-এ কিন্তু এই অনুপাত ছিল ১:৩৫, যা সর্বোচ্চ। আবার ভিত্তি বছর তথা ১৯৯৭-৯৮ সালে এট ছিল ১:১২। বাংলাদেশে চীনের রফতানি ৫৯২ থেকে ৬৩০০ মিলিয়নে উন্নীত হলেও একই সময়ে চীনের আমদানি বেড়েছে ৪৯ মিলিয়ন ডলার থেকে ৪৫৮ মিলিয়ন ডলারে।
সাধারণভাবে এটা ধরা যায় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হলে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি স্বল্পমেয়াদে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কেননা বাংলাদেশে চীনা পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যদি শুল্কমুক্ত মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চীন থেকে আরও বেশি পণ্য আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়বে, ফলে স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশ থেকে চীনে পণ্য রফতানির চেয়ে চীন থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি বাড়ার সম্ভাবনা বেশি।
বাংলাদেশ তার আমদানির এক-চতুর্থাংশ চীন থেকে সম্পাদন করে বলে আমদানি শুল্ক থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ে কি ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, তা অবশ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়। কেননা চীন থেকে আমদানিকৃত অনেক পণ্যে বাংলাদেশের রাজস্ব নীতি অনুযায়ী শূন্য শুল্প বিদ্যমান। বিশেষ করে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল বন্ডেড ওয়্যার হাউসের মাধ্যমে শূন্য শুল্কে আমদানিকৃত হয়ে থাকে।
তবে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে অন্যরকম ফল আশা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে মজুরির হার কম বলে পণ্য উৎপাদন খরচ কম এবং পণ্যমূল্য কম থাকার কারণে চীনে এ দেশের পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে পারে, তাছাড়া চীনা উদ্যোক্তারা বিনা শুল্কে প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী পণ্য বাংলাদেশে আমদানি করে তা প্রক্রিয়াজাত করে চীনে কিংবা অন্য কোনো দেশে রফতানি করার সুযোগ পাবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভিয়েতনাম বছরে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে থাকে, যার বেশিরভাগই উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য এবং এই প্রযুক্তির বিকাশে চীন ভিয়েতনামকে সহযোগিতা করেছিল। এই উচ্চ প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় কাঁচামালের বেশিরভাগই চীন থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হলে চীনের উদ্যোক্তারা তাদের উচ্চ প্রযুক্তি বাংলাদেশে স্থানান্তর করে আবার চীনে রফতানি করতে উৎসাহিত হবে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এই খাতে একটি দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সহায়তা করবে।
তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও চীনের বাজারে প্রবেশ করার বিষয়ে দ্রুত সক্ষমতা অর্জন করবে এবং সেখানে তাদের উপস্থিতি শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
চীনে বাংলাদেশের পোশাকের বাজারের সম্ভাবনা ব্যাপক। চীনের বস্ত্র ও পোশাকের বাজারকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাজার হিসেবে মনে করা হয়। একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, ২০০০ সালে চীনে যেখানে জনপ্রতি বস্ত্রের ব্যবহার ছিল ৪.১ কেজি সেখানে ২০০৮ সালে তা ২০.৩ কেজিতে পৌঁছে। ২০০১ সালে চীনে যেখানে জনপ্রতি পোশাক ক্রয়ে ব্যয় ছিল শহরাঞ্চলে আরএমবি ৫৩৩.৬৬ এবং গ্রামাঞ্চলে আরএমবি ৯৮.৬৮; কিন্তু ২০০৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাম দাঁড়ায় যথাক্রমে আরএমবি ১২৮৪.২ এবং ২৩২.৫-এ।
মজার বিষয় হচ্ছে, স্বল্পোন্নত দেশসমূহ থেকে চীন ২০০৯ সালে মোট প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলারের বস্ত্র ও পোশাক আমদানি করেছিল, যার মধ্যে বাংলাদেশ ছিল সর্ববৃহৎ রফতানিকারক। বাংলাদেশ থেকে চীন একই সময়ে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলারের বস্ত্র ও পেশাক আমদানি করে। যদিও চীন বাংলাদেশ থেকে এর সিংহভাগই তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আমদানি করেছিল। জারা এবং এইচ এন্ড এমের মতো বিশ্বখ্যাত ক্রেতাগণ এ সব পণ্য বাংলাদেশ থেকে ক্রয় করে চীনে চেইন স্টোরের মাধ্যমে বাজারজাত করেছিল।
চীনের বাজারে প্রবেশের জন্য বেশকিছু দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। আমাদের পোশাক রফতানিকারকরা চেষ্টা করলেই চীনের বাজারে প্রবেশ করার কৌশলসমূহ রপ্ত করতে পারেন। চীনের সদ্য বিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নিকট যেমন নতুন নতুন ডিজাইন আর ফ্যাশনের চাহিদা রয়েছে, ঠিক তেমনি সে দেশের অনুন্নত অঞ্চলের ভোক্তাদের জন্য কম মূল্যের পোশাকের চাহিদাও রয়েছে।
আর এ জন্য বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের ডিজাইন ও ফ্যাশন খাতে গবেষণার জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে চৈনিক ভোক্তাদের রুচি ও চাহিদা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যেতে পারে।
চীনের মতো দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আগে এর ঝুঁকি সম্পর্কে যেমনিভাবে বিশদ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন, ঠিক তেমনিভাবে দক্ষতার সঙ্গে এই চুক্তির আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অত্যন্ত জরুরি। তা ছাড়া ভবিষ্যতের বিষয় চিন্তা করে চীন ছাড়াও ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গেও মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
মকসুদুজ্জমান লস্কর : ব্যাংকার; ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও উন্নয়নবিষয়ক লেখক
laskardhaka@yahoo.com