বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস
গ্রামে এখনো অচেনা

আবুল কাশেম উজ্জ্বল
প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অনেকে অটিজমকে মানসিক রোগ মনে করলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে মস্তিষ্কের অসম্পূর্ণ বিকাশের কারণে এটি হয়ে থাকে।
এটি মূলত এক ধরনের স্নায়বিক বিকাশজনিত রোগের শ্রেণি, যা সামাজিক বিকলতা, কথা বলার প্রতিবন্ধকতা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক ও একই ধরনের আচরণ দ্বারা চিহ্নিত হয়। অটিজম শব্দটি আমাদের দেশে একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে যতটা পরিচিত, ঠিক ততটাই অপরিচিত সামাজিক ক্ষেত্রে। এমনকি অটিস্টিক শিশু আছে এমন পরিবারও অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টি জানে না।
এ কারণে মানসিক বা স্নায়বিক যে কোনো সমস্যায় ঢালাওভাবে তাদের একটি ‘বিশেষ’ শব্দে চিহ্নিত করা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারও তা মেনে নেয় এবং সেভাবে তাদের প্রতি আচরণ করা হয়। এর ফলে অটিস্টিক শিশুদের বিশেষ চাহিদার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। ফলে তাদের অবস্থার উন্নতি হওয়ার বদলে অবনতি হয় এবং এক সময় সেটা সীমার বাইরে চলে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের অটিজম সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ অটিজম আক্রান্ত। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মধ্যে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তবে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে দেড় লাখের মতো অটিজম আক্রান্ত মানুষ রয়েছে। প্রতি বছর এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও প্রায় ১৫শ শিশু, গড়ে প্রতিদিন চারজনের বেশি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামে প্রতি হাজারে ১.৪ জন, কিন্তু শহরে ২.৫ জন অটিজম আক্রান্ত। মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বেশি। দেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে অটিজম বিস্তারের হার প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৭ জন।
অটিজম বিষয়ে আমাদের দেশে সরকারি উদ্যোগ কম নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার কন্যার অক্লান্ত উদ্যোগের ফলে অটিজমবিষয়ক সরকারি সেবাগুলো সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিশেষ বিদ্যালয়, সমন্বিত শিক্ষা, অটিজম রিসার্চ ও রিসোর্স সেন্টার, অটিজম কর্নারসহ অনেক উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে মানুষ। তবে কিছু বিষয় এখনো বিদ্যমান আছে, যা অটিজম পরিস্থিতির জন্য মোটেও ভালো নয়।
বিশেষ করে গ্রামবাংলায় আজও অটিজম আর অন্যান্য মানসিক ব্যাধির মধ্যে তফাত বোঝার মতো সামাজিক সচেতনতা তৈরি হয়নি বলেই মনে হয়। গ্রামের একজন মা যখন বুঝতে পারেন, তার সন্তানটি অন্য শিশুদের থেকে আলাদা, তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তার জন্য খুব কঠিন হয়ে যায়। কার কাছে যাবেন, কী করবেন, কীভাবে যত্ন নেবেন, শিক্ষা, ভবিষ্যৎ-এ রকম হাজারও অনিশ্চয়তায় তিনি অসহায় হয়ে পড়েন।
সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে অটিজম শনাক্ত করা। এমনিতেই গ্রামে ডাক্তার পাওয়া কঠিন, আর যারা থাকেন তাদের অটিজমের মতো জটিল মানসিক ব্যাধি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ বা জানার পরিধি কতটুকু তা নিয়ে সংশয় আছে। আর প্রকৃত সমস্যাটি বুঝতে না পারলে ভুল চিকিৎসার আশঙ্কা থেকেই যায়, যা শিশুটির জন্য আরও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
অটিস্টিক শিশুর ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতা ও ধৈর্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা শিশুর চিকিৎসা, শিক্ষা, বিকাশ ও উন্নয়নের মুখ্য নির্ধারক হলেও এর সঙ্গে পারিপার্শ্বিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত অবস্থার কথাও বিবেচনায় নিতে হবে। অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসা, শিক্ষাসহ অপরিহার্য চাহিদা পূরণ কেবল ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষই নয়, এর সঙ্গে সহজলভ্যতার বিষয়টিও প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত।
অটিজমবিষয়ক সরকারি-বেসরকারি সেবার সিংহভাগ শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামের মানুষের পক্ষে সে সেবা নেওয়া মোটেও সহজ নয়। স্বাভাবিকভাবেই এ পরিস্থিতি অভিভাবকদের জন্য খুব কষ্টের।
এর সঙ্গে যখন প্রতিবেশী, আত্মীয় ও সমাজের অন্যরা নানা মন্তব্য করেন, তখন তাদের পক্ষে সেই শিশুর প্রতি দায়িত্ব পালন করা আরও কঠিন হয়ে যায়। ফলে সম্মানহানি আর সামাজিক অবহেলার কারণে অনেক অভিভাবক তাদের এমন শিশুর কথা সহজে প্রকাশ করতে চান না।
বরং শিশুটিকে ঘরে রেখে দেন। জেনে বা না জেনে গ্রামের অধিকাংশ পরিবার বিষয়টি ‘তকদির’ বা কবিরাজের হাতে ছেড়ে দেন। এভাবে বেঁচে থাকা শিশুটি ‘পাগল’ তকমা নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো অন্যদের দয়ায় অতিবাহিত করে।
দেশে প্রতিবন্ধিতার হার গ্রামেই বেশি, যদিও অটিজমের ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র দেখা যায়। তবে সঠিক জরিপ এবং অটিজম চিহ্নিত করার প্রয়াস নেওয়া হলে ভিন্ন চিত্র দেখা যেতে পারে। অথচ শহরে বাস করা অটিস্টিক শিশুর অভিভাবকরা চিকিৎসা ছাড়াও তথ্য, পরামর্শ, শিক্ষা ও অন্যান্য সেবা যত সহজে পেতে পারেন, গ্রামের অবস্থা এর বিপরীত। এমনকি শহর এলাকায় বেসরকারি সেবাও আছে, যা গ্রামবাংলায় চিন্তা করা যায় না। এ পরিস্থিতিতে গ্রামে অটিজম বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে অচেনা থাকাটাই স্বাভাবিক।
সরকার এখন ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে সচেষ্ট, যেখানে একাদশ অধ্যায়ে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নীতির অধীনে গ্রামে শহরের সুবিধা সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে অটিজমের বিষয়টিও যথাযথ গুরুত্ব পাবে বলে প্রত্যাশা করি। সেজন্য সবার আগে দরকার গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভুল ধারণা দূর করা এবং জরিপ ও শনাক্তকরণের উদ্যোগ নেওয়া।
পাশাপাশি অটিস্টিক শিশুদের সঠিক পরিচর্যার জন্য অভিভাবকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা বা ভাতার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রতি ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্রে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে এবং অন্তত একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে ইউনিয়নের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঠিক করে সেখানে এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত একজন শিক্ষক রাখা যেতে পারে।
স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা বা সমিতিগুলোকে তথ্য প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে সম্পৃক্ত করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। একইসঙ্গে শহরকেন্দ্রিক সেবাব্যবস্থার সঙ্গে গ্রামের সহজ সংযোগ তৈরি এবং সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করা দরকার।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য গ্রাম ও শহরের ব্যবধান কমানোর কোনো বিকল্প নেই।
আবুল কাশেম উজ্জ্বল : শিক্ষক ও গবেষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়