তৃতীয় মত
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে কী হতে যাচ্ছে?
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে কী হতে যাচ্ছে?](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2021/03/29/image-406531-1616967858.jpg)
বহুকাল আগে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘কোথাও সান্ত্বনা নেই, পৃথিবীতে শান্তি নেই আজ।’ কথাটি আজকের পৃথিবীর জন্য অধিক প্রযোজ্য। কোভিড-১৯ সারা পৃথিবীর শান্তি হরণ করেছে। প্রাণ হরণের কাজটি এখনো চলছে নিত্য।
এ বিশ্বত্রাস মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশে চলছে রাজনৈতিক অশান্তি, অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও অহম (আসাম রাজ্যে) চলছে গোলযোগপূর্ণ নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গে এ নির্বাচন শুরু হয়েছে গত শনিবার (২৭ মার্চ)। এই নির্বাচনী প্রচারণার উত্তেজনা এখন তুঙ্গে।
পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে তৃণমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম দফায় কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন করে নির্বাচনে জিতেছিল তৃণমূল এবং সরকার গঠন করেছিল। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তখন দৌত্যগিরি করেছিলেন মমতার কংগ্রেস আর ইন্দিরা কংগ্রেসের মধ্যে। এ কোয়ালিশন বেশি দিন টেকেনি।
সিপিএম তথা বামজোটের চৌত্রিশ বছরের রাজত্ব উচ্ছেদ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতময় এমন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, এক সময় মনে হয়েছিল, দিল্লিতে নড়বড়ে কংগ্রেস রাজত্বের উচ্ছেদ ঘটার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই দিল্লির মসনদে বসবেন এবং ‘দ্বিতীয় ইন্দিরা’ হবেন।
সম্ভবত এ সম্ভাবনা দেখেই তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সব প্রথা ভেঙে অন্য দেশের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে সরাসরি কলকাতায় ছুটে এসেছিলেন। অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দ্বিতীয় ইন্দিরা গান্ধী’ হতে পারেননি। ভারতে হঠাৎ ‘মোদি ঝড়’ দেখা দেওয়াতে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মমতার গুরুত্ব স্থায়ী হয়নি।
‘মোদি ঝড়’ শুধু দিল্লির সিংহাসন টলায়নি, ভারতে বহু রাজ্যে বিজেপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পারেনি। মমতার রাজত্বে বিজেপি বহুদিন একটা আঁচড় বসাতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সুপ্রিমো। তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের রাজনীতিতে দাঁড়ায়নি। তৃণমূলের সামনে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট-বিজেপি কোনো দল দাঁড়াতে পারেনি।
কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল হয়েও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি মাথা তুলতে পারেনি। এখন বিজেপি ধীরে ধীরে মাথা তুলছে। ভারতের দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনেও মোদি জিতেছেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং দলের সভাপতি অমিত শাহ দুজনে পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য বিরোধী রাজ্যের ওপর নজর দেন। ত্রিপুরা থেকেও বহুকালের দীর্ঘ সিপিএম শাসন গত রাজ্য নির্বাচনে উচ্ছেদ করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গে বাম যুক্তফ্রন্ট শাসন পচতে শুরু করে তাদের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর। তৃণমূল শাসনে পচন শুরু হয় তাদের এক মেয়াদের শাসনের পরই। তৃণমূল আদর্শে বিশ্বাসী কোনো দল নয়। কংগ্রেস ত্যাগী এবং কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত কিছু নেতা এবং অন্যান্য দলের কাছ থেকেও ক্ষমতার প্রলোভন দেখিয়ে বের করে আনা নেতা ও কর্মী মিলিয়ে তৃণমূল গঠিত। দলের নেত্রী এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও রাজনীতিতে বহু ঘাটের জল খাওয়া নেত্রী।
তিনি কংগ্রেসে ছিলেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বলেন।
আবার বাংলাদেশ থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরে পলাতক বিহারি মুসলমানরা, যারা পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে স্থানীয় মুসলমানদের চেয়েও বেশি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, তাদের তোল্লা দেন। বামফ্রন্ট সরকার এটা করেছিল ভোটের রাজনীতির জন্য। মমতাও সেই একই উদ্দেশ্যে কাজটা করেছিলেন। তার প্রতিফলও তিনি পেয়েছিলেন পরবর্র্তীকালে।
প্রথম দফায় মমতা যখন নির্বাচনে জয়ী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন, তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সম্ভবত আশা করেছিলেন, দিল্লির সঙ্গে ঢাকার বিভিন্ন বিরোধ-মীমাংসার ব্যাপারে নিকট প্রতিবেশী এবং একই ভাষাভাষী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো সহায়তা জোগাবেন।
তার পূর্ববর্তী বাম মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু শেখ হাসিনাকে কন্যার মতো স্নেহ করতেন এবং দিল্লির সঙ্গে গঙ্গার পানি নিয়ে চুক্তি করায় বাংলাদেশকে সাহায্য করেন। শেখ হাসিনার হয়তো আশা ছিল, তিস্তা নদীর সমস্যা মীমাংসায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুরূপভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করবেন।
বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গেও এ আশাবাদ জাগ্রত হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরপরই শেখ হাসিনার অভিনন্দন লাভের জবাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তার বড় দি’ বলে সম্বোধন করেছিলেন এবং সব ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তিনি ভোল পাল্টে ফেলেছিলেন। তখন দিল্লিতে ক্ষমতায় আসীন কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। তিনি তিস্তাসহ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যেসব সমস্যা আছে, তা সমাধানের জন্য ঢাকায় যান এবং তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী অহম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সব মুখ্যমন্ত্রীই এসেছিলেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসতে অসম্মতি জানান।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান, তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশের পাওনা মেটাতে তিনি রাজি নন। তাতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থের ক্ষতি হবে। ড. মনমোহন সিং অপদস্ত হয়ে দিল্লিতে ফিরে যান।
এরপর বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সব বিরোধ মীমাংসার জন্য উদ্যোগ নিলেন। অনেক সমস্যার সমাধানও করলেন। কিন্তু তিস্তা সমস্যা সমাধানে আবারও বাগড়া দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার গোয়ার্তুমির জন্য তিস্তা সমস্যা এখনো ঝুলে আছে। বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলোর একমাত্র অভিযোগ হাসিনা সরকার তিস্তা সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোল পাল্টানোর আরেকটি নজির আছে। তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
কিছু দিনের মধ্যেই দেখা গেল তিনি মুর্শিদাবাদ ও বহরমপুর সীমান্তপথে বাংলাদেশ থেকে আগত জামায়াতিদের ভোটপত্র প্রদান দ্বারা তৃণমূলের পক্ষে ভোটবাক্স তৈরি করছেন। এটা তার আগের বামফ্রন্ট গভর্নমেন্টও করেছে। এ জামায়াতিরা সীমান্ত এলাকার বাউল সম্প্রদায়কে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে অত্যাচার করে এবং স্কুলের বদলে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা দ্বারা সীমান্ত এলাকা ভরে ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন।
তার কারণ, এরা সরকারকে ক্ষমতায় রাখার শক্তিশালী ভোটবাক্স। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এখন স্থানীয় বাঙালি মুসলমানের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান আমল থেকে পাওয়া বিহারি মুসলমানরা অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত। ধনেজনে, ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা জাঁকিয়ে বসেছে এবং নিজেদের পরিচয় দেয় বাঙালি।
আগের বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় বাঙালি মুসলমান পরিচয়ে মন্ত্রিত্বের অধিকাংশ আসন তারা দখল করে রেখেছিল, এখন মমতার মন্ত্রিসভাতেও তাদেরই সংখ্যাধিক্য। এরা প্রচণ্ডভাবে হাসিনা সরকারবিরোধী এবং মমতা সরকারকে বাংলাদেশের পক্ষে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে বাধা দেয়।
ভারতে রাজনৈতিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তনের ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার অনেক সিদ্ধান্ত যে ভুল তা বুঝে অনেকটা শোধরাতে চাচ্ছেন। বাংলাদেশবিরোধী নীতিও ছাড়তে চাইছেন। কিন্তু নীতি পরিবর্তনে তিনি বড় দেরি করে ফেলেছেন। এটা পশ্চিমবঙ্গের অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা।
রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে সিপিএম ও বামফ্রন্টকে ধ্বংস করতে গিয়ে মমতা সেক্যুলারিজমকেও ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। সিপিএম ও কংগ্রেসের সেক্যুলার রাজনীতি প্রায় ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করেছে সাম্প্রদায়িক বিজেপি। ত্রিপুরায় বাম শাসন উচ্ছেদ করার পর বিজেপি এখন পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ জানানোর শক্তি অর্জন করেছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন আবার পুরোনো অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আঁকড়ে ধরেছেন। তাতে সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। তিনি যে জামায়াতপন্থি ভোট এবং বিত্তশালী বিহারি মুসলমানদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করেছেন, সেই সুবিধাবাদী ভোটার ও সমর্থকদের বড় অংশ এখন বিজেপির দিকে চলেছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবচেয়ে বড় অসুবিধায় পড়েছেন নন্দীগ্রাম নিয়ে। এ সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের কৃষক বিদ্রোহে সমর্থন জানিয়ে এবং সেই বিদ্রোহের মাথায় পা রেখে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। কৃষকদের স্বার্থহানি ঘটিয়ে সেখানে বৃহৎ শিল্পপতিদের কারখানা স্থাপনের সুবিধা দিতে গিয়ে, কৃষক হত্যা করে বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে।
আর ওই কৃষক আন্দোলনের মাথায় পা রেখে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সুপ্রিমো হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব ঘটে। সেই নন্দীগ্রামে তৃণমূলের আগের অবস্থা নেই। তৃণমূল সরকারও কৃষকবিরোধী শিল্পপতিদের অনুগ্রহ দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। নন্দীগ্রাম মমতার নিজের নির্বাচনী এলাকা।
সেখানে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে তিনি প্রচণ্ড মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার দল থেকে বহু জাঁদরেল নেতা বেরিয়ে গেছেন। তিনি তাদের শূন্যস্থান পূর্ণ করেছেন টালিউড থেকে নতুন মুখ তারকাদের দলে টেনে।
সব কিছু সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে এখনো ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু তার দল তৃণমূল জনপ্রিয় নয়। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বহু অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা জনপ্রিয় নন। কিন্তু বিজেপি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গত শনিবার থেকে যে নির্বাচন শুরু হয়েছে, তাতে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলবে বলে অনেকেরই ধারণা।
যে দলই জিতুক, সামান্য মার্জিনে জয়ী হবে বলেও অনেকের ধারণা। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দল বলে পরিচিত কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের দলগুলো কি এই নির্বাচনে তলিয়ে যাবে? বিজেপি যদি এই নির্বাচনে জেতে, তাহলে ভারতে এই দুই আদর্শের শেষ ঠিকানাও আর থাকবে না। এক্ষেত্রে ভালো হোক, মন্দ হোক, তৃণমূলই পশ্চিমবঙ্গের অসাম্প্রদায়িক জনগণের শেষ ভরসা। কিন্তু তৃণমূল কি এবার এত বড় ধাক্কা সামলাতে পারবে?
লন্ডন ২৮ মার্চ, রবিবার, ২০২১