বইমেলা, বাঙালির চেতনা ও আবেগ
ড. হারুন রশীদ
প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অনেক প্রতীক্ষার পর শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। করোনা মহামারির কারণে ফেব্রুয়ারির মেলা গড়িয়েছে মার্চে। তবে লোকজনের উৎসাহের কোনো কমতি নেই। ১৮ মার্চ শুরু হওয়া বইমেলার প্রথম দিনেই ছিল ক্রেতা-দর্শকের ভিড়।
নানা প্রতিকূলতার পরও মেলা জমবে-এমনটি বলা যায় নিশ্চিত করেই। এ বছর এমন একটি সময়ে বইমেলা হচ্ছে, যখন মুজিববর্ষ চলছে। স্বাধীনতারও সুবর্ণজয়ন্তী। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেশ-বিদেশের বরেণ্য অতিথিরা এসেছেন বাংলাদেশ সফরে। ফলে মেলা আলাদা একটি মাত্রা পেয়েছে। অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেলায় যেতে হবে। বিশেষ করে মাস্ক পরা অত্যাবশ্যক।
‘মুক্তধারা’র স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা যে মেলার বীজ বপন করেছিলেন, সেটি ফুলে-ফলে এখন এক বিরাট মহীরুহ। আজ এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ও জাতিগত আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত এক জাতীয় মেলা। এর রূপ, রং, চরিত্র আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনার সমার্থক। কেননা বইমেলা প্রাঙ্গণে যারা সমবেত হন তারা শুধু বই কিনতেই আসেন না, আসেন সামাজিক দায় মেটানোর বোধ থেকেও।
একুশের আরেক অর্জন বইমেলা। আর বইমেলা মানে পুরো মাসজুড়েই সৃজনশীল বই প্রকাশনা। লেখক, প্রকাশক, পাঠক সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকেন এ বইমেলার জন্য। পরিসর, ব্যাপ্তি ও আবেগের দিক থেকে এ বইমেলা হয়ে উঠেছে আমাদের প্রাণের উৎসব। বাঙালির তেমন কোনো সাংস্কৃতিক উৎসব নেই। সেদিক থেকে বাঙালির প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসবও এ বইমেলা। বইমেলা জড়িত বাঙালির চেতনা এবং আবেগের সঙ্গে। একুশের চেতনার পথ ধরেই এসেছে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার এবং এরই পথ ধরে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা, অতঃপর স্বাধীন দেশে বইমেলা।
বাঙালির যত আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস-ঐতিহ্য তা সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়েই। বইমেলা সাংস্কৃতিক জাগরণে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ভাষা আন্দোলনের অমর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভাষা সংস্কৃতির প্রতি আবেগ এবং অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক উদার চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে একুশে বইমেলা রূপ নিয়েছে বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে। এখানে শুধু ক্রেতা-বিক্রেতা-পাঠকেরই সমাগম হয় না, মেলা পরিণত হয় লেখক-প্রকাশক-পাঠক, দর্শকসহ বয়স-শ্রেণি নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলায়। সৃজনশীল প্রকাশকরা হাজারও বইয়ের পসরা নিয়ে হাজির হন বইমেলায়। মেলায় আগত দর্শক সমাগম নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে সারা দেশের অগণিত গ্রন্থপিপাসুর নতুন বই হাতে পাওয়ার বিপুল আকাক্সক্ষাকে।
বইমেলায় আসেন লেখকরা, বিশেষত তরুণ-তরুণীরা, কিশোর-কিশোরীরা, ছাত্রছাত্রীরা, আর আসেন মধ্যবিত্ত। তারাই মেলার প্রধান ক্রেতা। জনপ্রিয় ও পাঠকনন্দিত লেখকের বই ছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত আমলা, প্রবাসী বাঙালি কিংবা নবীন লেখকের কাঁপা হাতের প্রথম লেখাটিও ফেব্রুয়ারির বইমেলায় প্রকাশের অপেক্ষায় থাকে। একুশের মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক। এটি প্রকাশনা শিল্প, লেখক-পাঠক কারও জন্যই শুভকর নয়। সারা বছর ধরে বইয়ের প্রবাহ ঠিক রাখতে হলে এ মেলাকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।
পেশাদারি প্রকাশক ছাড়াও অপেশাদারি প্রকাশকরাও মেলা উপলক্ষ্যে বই প্রকাশ করেন। এর ভালো-মন্দ দুই দিকই রয়েছে। অনেকে লেখক হওয়ার বাসনায় গাঁটের পয়সা খরচ করে নিজ উদ্যোগে বই বের করেন। এতে মেলায় বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও সে হারে মান বাড়ছে না। যেনতেনভাবে নতুন বই মেলায় আনার প্রবণতার ফলে মানহীন বই, ভুল বানান, তথ্য ও মুদ্রণত্রুটিযুক্ত বইয়ে বাজার ভরে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে তা প্রকাশনা শিল্প, লেখক, ক্রেতা, পাঠক সবার জন্যই ক্ষতিকর। এজন্য সারা বছরই বইয়ের প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে মেলার সময়ে বই প্রকাশের বাড়তি চাপ থেকে লেখক, প্রকাশক সবাই মুক্ত থাকতে পারবেন। তখন প্রকাশনার প্রতি যথাযথ মনোযোগ এবং যত্নশীল হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হবে। আর একটি বিষয় হচ্ছে, বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয় সে তুলনায় বিক্রি হয় না। যদিও প্রতি বছর মেলায় প্রায় ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয় বলে প্রকাশকরা বলে থাকেন।
প্রতি বছরই ঘুরেফিরে আসে অমর একুশে বইমেলা। একুশের চেতনাসমৃদ্ধ মেলাকে কীভাবে আরও সম্প্রসারণ করা যায়, এর শ্রীবৃদ্ধি করা যায়-এ নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। এর কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সময়ের অভিঘাতে সবকিছু পালটাচ্ছে। মানুষের রুচি ও মূল্যবোধও পালটাচ্ছে। যে কারণে এর সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য বইমেলার চেতনা, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। বইকেন্দ্রিক একটি সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে বইমেলা যেন আরও বেশি অবদান রাখতে পারে, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।
আমাদের পাঠাভ্যাস বাড়ানোর পাশাপাশি বই কেনার অভ্যাসও করতে হবে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’র সেই দম্পতির মতো আমাদের ‘একখানা বই হলেই চলে’-এ মনোভাব পরিহার করতে হবে। সবসময়ের জন্য সেরা পুরস্কার হচ্ছে বই। প্রিয়-অপ্রিয় সবাইকে বই উপহার দিন। বইকেন্দ্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলুন।
মনে রাখতে হবে, প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ ২০০৪ সালে এ বইমেলা থেকে ফেরার পথেই একদল ধর্মান্ধ আততায়ীর হাতে মারাত্মক আহত হন। চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেও জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করেন কিছুদিন পরই। এ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এখনো ক্রিয়াশীল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিতে চাচ্ছে তারা। সৃজনশীল, প্রগতিবাদী, অসাম্প্রদায়িক মানুষ এদের পরম শত্রু। এ কারণেই সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বইমেলা হতে পারে এক বিরাট প্রতিবাদ। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায়ও বইমেলার অবদান কম নয়।
আবারও হুমায়ুন আজাদের স্মরণ নিতে হয়। একটি লেখায় তিনি বলেছেন-‘একজন তরুণ বা তরুণী যখন একটি বই কিনে জ্বলজ্বল করে ওঠে, তখন আমি তাদের চোখে-মুখে অসংখ্য শুকতারা ঝলমল করতে দেখি।’
সত্যি, এ ঝলমলে তারুণ্যই তো পাল্টে দিতে পারে সবকিছু। ইন্টারনেট, ফেসবুক আর মুঠোফোনের মায়াজালের মধ্যেও নানা রঙের আনকোরা প্রচ্ছদে ছাপা নতুন বইয়ের ম-ম গন্ধে কি মাতাল হবে না তারুণ্য? সার্থক করবে না মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কিংবা শহিদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে?
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক
harun_press@yahoo.com