Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পঞ্চাশ বছরের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্ব

Icon

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পঞ্চাশ বছরের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্ব

স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের জন্য ওআইসির (ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা) সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করাটা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ স্বাধীনতা উত্তরকালে পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবেই ওআইসির একটা বড় সম্পর্ক ছিল। বরাবরই ওআইসির একাধিক সদস্য প্রশ্ন তুলত যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ভারতের কারসাজি এবং পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জোরপূর্বক আলাদা করা হয়েছে... ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ধরনের কথাবার্তা উত্থাপনের ফলে ওআইসির অনেক সদস্যরাষ্ট্র, বিশেষ করে আরব দেশের অনেক সদস্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত থাকে।

এতে করে ওআইসির সদস্যপদ লাভ করা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাংলাদেশের ওআইসির সদস্যপদ পাওয়া এবং এর সমর্থনটা সে সময় অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল। কারণ ওই সমর্থন না থাকলে বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টি কঠিন বাধার মুখে পড়ার আশঙ্কা ছিল। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য কঠিন এক বাস্তবতা। কারণ ওআইসির সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর ভোটের একটা বিষয় ছিল। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে ওআইসির সম্পর্কের বিষয়টিও সামনে এসে যায়। কাজেই ওআইসির সদস্য হওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ কঠিন এক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়।

তবে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। কারণ বাংলাদেশের বিশাল ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠী ওআইসির সদস্য হওয়ার পথকে সুগম করে দেয়। ওই সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসাবে ইন্দোনেশিয়ার পরই ছিল বাংলাদেশের অবস্থান। বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসাবে ইন্দোনেশিয়া ছিল প্রথম কাতারে। এর পরই ছিল বাংলাদেশ। যদিও এখন পাকিস্তানের জনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে, কারণ তাদের ফ্যামিলি প্ল্যানিং ওইভাবে কার্যকর হয়নি।

বাংলাদেশে মুসলমান জনসংখ্যার আধিক্য এবং এ দেশের মানুষের বড় অংশ ধর্মপ্রাণ হওয়ার বিষয়টি ওআইসিসহ অনেকেরই নজরে আসে। ফলে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন- এরা মিলে বাংলাদেশকে ওআইসির সদস্য করার ব্যাপারে একটা উদ্যোগ নিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ ব্যাপারে একটা বড় শর্ত ছিল।

যেহেতু ওআইসির শীর্ষ সম্মেলন (১৯৭৪ সালে) লাহোরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যেতে পারি যদি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পকিস্তানের স্বীকৃতি ছাড়া আমি ওআইসিতে যাব না।’ বঙ্গবন্ধুর এ দৃঢ়তায় একটা বড় পরিবর্তন ঘটল, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। ওআইসির সদস্যরাও ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুকে ওআইসি সম্মেলনে নিতে পারল। তিনি লাহোরে পা ফেলার আগেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল।

এই স্বীকৃতির ফলে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন এলো। অনেকেই বলে থাকেন, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে কথাবার্তা না বলে বঙ্গবন্ধুর এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সমীচীন ছিল না। কাউকে তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ নিজেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিষয়টি অনেককেই অবাক করে। তবে যাই হোক না কেন, পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং ওআইসির সদস্যপদ লাভের বিষয়টি এ উপমহাদেশে একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। কেননা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দেওয়া একটা বড় বিষয় ছিল। এর ফলে বাংলাদেশের ওআইসির সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকল না।

এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সাফল্যের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। ওআইসির সদস্য হওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। যার ফলে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে সুবিধা লাভ করতে থাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য এটা খুবই প্রয়োজন ছিল। প্রথম যে সুবিধা সেটা হলো মুসলিম দেশ হিসাবে জ্বালানি তেল ক্রয়ে ছাড় পাওয়া। দ্বিতীয়টি ছিল জনশক্তি রপ্তানি। ওআইসির সদস্যদের মধ্যে কয়েকটি দেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ এতে কোনো সন্দেহ নেই। সৌদি আরব তার মধ্যে অন্যতম। বিশ্বে জ্বালানি তেলের জোগানদাতা হিসাবে সৌদি আরবের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে।

আমরা মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো যখন তেল কিনি তখন তা একটা ছাড়কৃত দামে পাই, যেটা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির বাংলাদেশ যদি চড়া দামে জ্বালানি তেল ক্রয় করত, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে একটা বিরাট লোকসানের মুখে পড়তে হতো বাংলাদেশকে। মুসলিম দেশ হিসাবে ছাড়কৃত দামে তেল পাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সুগম করে দেয়। কেননা জ্বালানি তেলের সঙ্গে অনেক কিছুই সম্পর্কযুক্ত।

আমাদের বড় আরেকটি সুবিধা হলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি। এটা যদিও কিছু সময় পরে শুরু হয়েছে, তবুও এ বিষয়টি বাংলাদেশকে উঠে দাঁড়াতে অনেকটা সাহায্য করেছে। কারণ বৈদেশিক রেমিট্যান্স একটি দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।

আশির দশকের শুরুতে যখন গ্লোবালাইজেশন চালু হলো, তখন বড় আকারে অভিবাসী শ্রমিকরা যেতে পারল মধ্যপ্রাচ্যে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের বিশাল জনশক্তি কাজ করে যাচ্ছে। করোনাকালীন এ মহাদুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশ বেশ মোটা অঙ্কের রেমিট্যান্স অর্জন করেছে, যা দেশের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক এবং দেশের অর্থনীতিতে ভালো একটি অবদান রাখতে পেরেছে।

সুতরাং স্বাধীনতা উত্তরকালে ওআইসির সদস্যপদ লাভ বাংলাদেশের জন্য যে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হলো। সাধারণ অধিবেশনে আমাদের পদমর্যাদাও বেড়ে গেল। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের পরিচিতি বিশ্বদরবারে আরও বেশি করে প্রকাশ পেল।

২.

বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশই একটা অস্থির সময় পার করছে। কারণ এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যুদ্ধ চলছে। যেহেতু আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সব সময়ই সংবেদনশীল, সেহেতু আমাদের কারও পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো কোনো বিষয় নেই। কারণ ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- আমরা এ নীতিতেই চলছি। যার ফলে শত্রু-মিত্র সবার সঙ্গেই বাংলাদেশ সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে। আমাদের কোনো শত্রু নেই, তাই যুদ্ধের কোনো আশঙ্কাও নেই। আমাদের সঙ্গে সৌদি আরব, কাতার, ইরাক, ইরান, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক ভালো। শুধু মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গেই নয়, বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক ভালো।

আমরা কখনো কোনো সংঘর্ষে কারও পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেইনি। সেদিক থেকে বলতে গেলে মুসলিম বিশ্বের সবার সঙ্গেই বড় আকারে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে। তুরস্কের সঙ্গে সৌদি আরবের বিবাদ আছে। সৌদির সঙ্গে ইরানের বিবাদ আছে। কিন্তু আমরা ওই বিবাদের মধ্যে কখনো ঢুকিনি এবং কখনো ঢোকার চেষ্টাও করিনি। আমাদের বাংলাদেশের ব্যাপারে এ কারণে মুসলিম বিশ্বের একটা আগ্রহ আছে। কারণ তারা ভালো করেই জানে মুসলিম বিশ্বের একাধিক দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সব সময়ই সম্পর্ক রেখেছে এবং এর সুবিধাও মাঝে মাঝে কাজে দিয়েছে।

সত্তর অথবা নব্বইয়ের দশকে যখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছিল, তখন একাধিক মুসলিম দেশ মিয়ানমারের ওপর একটা বড় আকারে চাপ প্রয়োগ করতে পেরেছিল। বিশেষ করে সৌদি আরব, এক সময় তুরস্ক। সে হিসাবে এখনো বিশেষ করে শরণার্থী রাখার বিষয়ে মুসলিম বিশ্বের একটা সহযোগিতা আছে।

মুসলিম বিশ্বের একাধিক দেশের অস্থিরতার কারণ হলো, জনগণের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্কের ঘাটতি। জনগণের যে ইচ্ছা, চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষা তার সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই কমে গেছে। তাছাড়া এসব দেশে রাজতন্ত্রও একটা বিরাট সমস্যা হয়ে গেছে। বেশির ভাগ আরব দেশেই এ রাজতন্ত্র বিরাজমান। এ রাজতন্ত্রকামীদের একটা বড় সম্পর্ক রয়ে গেছে আমেরিকার সঙ্গে। তারা তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই আমেরিকার ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে।

সৌদি আরবের কথা যদি বলি, এরা সবাই আমেরিকার ব্যাংকে টাকা রাখে। আমেরিকার ব্যাংকে যে টাকাটা রাখে তা থেকে যে ইন্টারেস্ট হয়, সেটা তারা আবার ঋণ হিসাবে দেয় আরব দেশকে উন্নয়ন করার ব্যাপারে। অন্য কথায়, একই ডলার থেকে দুবার লাভ করে যাচ্ছে আমেরিকা। এই যে একটা সিস্টেম চালু হয়েছে, তাতে জনগণের খুব একটা লাভ হয়নি। বড় কিছু অবকাঠামো হয়েছে এবং কিছু লোকের হয়তো লাভও হয়েছে। কিন্তু এখন যখন তেলের দাম কমে যাচ্ছে এবং তেলের প্রয়োজনীয়তা অনেক জায়গায় কমে গেছে, তখন সেখানে নতুন করে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

আরেকটা বড় সমস্যা হলো প্রজাতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের মধ্যে লড়াই। মনে রাখতে হবে, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যে লড়াই সেটা অনেকটা প্রজাতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের লড়াই। ইরানের রাষ্ট্রপ্রধান ফতোয়া থেকে স্পষ্টতই বলে দিয়েছেন, রাজতন্ত্র ইসলামবিরোধী। ইরানের এ উক্তি সৌদি আরব মেনে নিতে পারেনি। ফলে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের একটা লড়াই আছে। রাজারা মনে করেন, তারা যদি আমেরিকার সঙ্গে না থাকেন তাহলে তাদের ক্ষমতা হয়তো টিকবে না।

ওদিকে ইরানে, বিশেষ করে ইরানের বিপ্লবের পর যেভাবে চিন্তাভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটা অনেকটা প্রজাতন্ত্রকে সামনে রেখে। যেটাকে আমরা বলি রিপাবলিকান সিস্টেম। ওই জায়গায় বিবাদটা হওয়ার ফলে, আমি মনে করি, মুসলিম বিশ্ব একটা দুর্বল অবস্থায় আছে। এটা গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড যারা চালান, তাদের জন্য সুবিধা করে দিয়েছে।

একটা দুর্বল শক্তিকে যে কোনোভাবে পরিচালনা করা যায়। এ ধরনের নীতি ও আদর্শিক পার্থক্যের কারণে তুরস্ক, ইরান ও সৌদি আরব একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে কখনোই এগোতে পারেনি। সবাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় বড় আকারে। সেই জায়গায় একটা বড় সমস্যা তৈরি হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে আজ যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটা সেই সমস্যার কারণেই হয়েছে বলা যায়।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যতদিন এ সংস্কৃতি চলবে, ততদিন এর কোনো সমাধান হবে না। কারণ আরব দেশের রাজতন্ত্র খুবই কর্তৃত্বপরায়ণ রাজতন্ত্র।

কর্তৃত্বপরায়ণ রাজতন্ত্র যতদিন আছে, ততদিন বড় আকারে মুসলিম বিশ্বে পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না। এ জায়গায় যখন পরিবর্তন হবে, তখন হয়তো আমরা নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারব।

(অনুলিখন : জাকির হোসেন সরকার)

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম