Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আত্মত্যাগের চৈতন্য

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আত্মত্যাগের চৈতন্য

বাঙালি মাত্রই জানেন, ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকই পাকিস্তান আন্দোলন খ্যাত লাহোর প্রস্তাব পেশ করেছিলেন।

১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম বাংলার ভোটাররা প্রায় ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগে পাকিস্তানের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। তৎকালীন ভারতে মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলোর মধ্যে এটিই ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম।

তথাপি পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে এ পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর নির্মম, আত্মঘাতী ও অদূরদর্শী ঔপনিবেশিক দুর্ব্যবহার সম্পর্কে সবাই সম্যক অবগত।

সাবেক পাকিস্তান মূলত সমগ্র নাগরিক সমর্থিত কোনো রাষ্ট্র ছিল না। এখানে সামরিক-বেসামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের কূটচালে শাসনতান্ত্রিক একটি সংবিধানও রচিত হয়নি। নয় বছরের চেষ্টায় যে একটি শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়েছিল; একদিনের সামরিক আঘাতে চরম চক্রান্ত ও নৈরাজ্যের অপকৌশলে তা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়।

১৯৪৩ সালে বঙ্গদেশে মুসলিম লীগ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল, তার পেছনে ছিল বঙ্গবন্ধুর বিশাল অবদান। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।

ক্রিপস্ কমিশন মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৪৬ সালে খাজা নাজিম উদ্দিন, চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং ঈসমাইল খানের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের ডাইরেক্ট অ্যাকশন কর্মসূচির ফলস্বরূপ কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার যে সূত্রপাত হয়, সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থেকে বঙ্গবন্ধু এ উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রশমনে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন।

কংগ্রেস প্রস্তাবিত বঙ্গদেশকে পূর্ব-পশ্চিম হিসাবে ভাগ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার যে বিল উত্থাপিত হয়েছিল, তার বিপরীতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসু-এ তিন নেতা অখণ্ড বাংলাদেশ দাবি করেন। অখণ্ড বাংলাদেশের সমর্থনে নেতৃত্বদানকারী সোহরাওয়ার্দী সাহেব এবং তার বিপরীতে বঙ্গদেশ বিভক্তির সমর্থক খাজা নাজিম উদ্দিনের মধ্যে নেতৃত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ও কতিপয় প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ছাড়া সেই সময় সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বের প্রতি আর কারও সমর্থন তেমন সুস্পষ্ট ছিল না।

পরবর্তী সময়ে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতা আরও বেগবান হয়।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার সময় তিনি সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। আরও পরে নিজস্ব আদর্শ ও ভূমিকার ভিত্তিতে ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব অভূতপূর্ব গ্রহণযোগ্যতায় অভিষিক্ত হয়।

তাছাড়া ’৫৪-এর নির্বাচনে বিজিত নেতৃত্বকে বারবার বাতিল করে দেওয়ার করাচি ষড়যন্ত্র, ’৫৮-এর সামরিক শাসন, ’৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও ভূমিকা এবং এর ফলস্বরূপ জেল-জুলুম তাকে অবিসংবাদিত ও জনপ্রিয় নেতায় পরিণত করে।

পর্যায়ক্রমে ’৬৬ সালে ছয় দফা প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার কর্তৃক বহু মামলা দায়েরের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। ১৯৬৭ সালের শেষদিকে বঙ্গবন্ধুকে ১ নম্বর আসামি করে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এরই প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সমগ্র বাংলা। পূর্ব বাংলার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সংঘটিত আন্দোলনের ফলে ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি ঐতিহাসিক ১১ দফা ঘোষণা করা হয়।

এ ১১ দফাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা গণআন্দোলন থেকে জন্ম নেয় গণঅভ্যুত্থানের। আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যদের চরমভাবে দণ্ডিত করার যে নীলনকশা প্রণীত হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানীর জনসভায় সংগ্রামী জনতার উচ্চারণ ধ্বনিত হলো-‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’।

পরবর্তী ইতিহাস ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয়। কিন্তু সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের এ বিজয়কে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হলেও বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম এখনো বহুলাংশে অসম্পূর্ণ।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণে বারবার ফিরে যেতে হচ্ছে কবি জীবনানন্দ দাশের সেই অমর কবিতায়। মনে হয় যথাযোগ্য মর্যাদায় বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করার উদ্দেশ্যেই পঙ্ক্তিগুলো আগাম গ্রন্থিত হয়েছিল-‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;/হয়তো বা হাঁস হ’ব-কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,/সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে;/ আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে/জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।’

আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব শহিদ সদস্য, জাতীয় চার নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহান শহিদদের স্মৃতির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। দুই লক্ষ জননী-জায়া-কন্যার সর্বোচ্চ ত্যাগ, আহত-পঙ্গুসহ সব মুক্তিযোদ্ধাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে নিবন্ধের ইতি টানছি।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম