
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। তবে ঢাকা ত্যাগ করার আগে ‘অপারেশন সার্চলাইটে’ স্বাক্ষর করেন। এরপর রাত ১১টায় লে. জেনারেল টিক্কা খান মেজর জেনারেল খাদিম হোসেনকে অপারেশন চালানোর নির্দেশ দেন। নির্দেশটি পেয়ে তা কার্যকর করার জন্য তিনি তার স্টাফদের জানিয়ে দেন।
ঢাকার বাইরের গ্যারিসনগুলোতেও একটি সাংকেতিক বার্তার মাধ্যমে তা জানিয়ে দেওয়া হয়। অপারেশন শুরুর সময় নির্ধারণ করা হয় ২৬ মার্চ রাত ১টা। এই সার্চলাইট অপারেশন পরিকল্পনায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে ঢাকায় এবং মেজর জেনারেল খাদিম হোসেনকে ঢাকার বাইরে সমগ্র দেশে অপারেশন চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর অধীনে ব্রিগেডিয়ার আরবাবের অধিনায়কত্বে ৫৭ ব্রিগেডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর সার্বিকভাবে অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করেন টিক্কা খান।
ব্রিগেডিয়ার আরবাব ঢাকায় অপারেশন চালানোর জন্য তার ব্রিগেডের ১৩ সীমান্ত ফোর্সকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এবং ৪৩ লাইট অ্যান্টি এয়ারক্রাফট রেজিমেন্টকে বিমানবন্দর এলাকার দায়িত্বে মোতায়েন করেন। ২২ বালুচ রেজিমেন্টকে ইপিআর প্রধান সদর দপ্তর পিলখানার ইপিআরদের এবং ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশদের নিরস্ত্র করার দায়িত্ব দেন। ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে নবাবপুর এলাকায় এবং ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বালুচ ও ২২ পাঞ্জাব থেকে এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে গঠিত একটি বিশেষ বাহিনীকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, বিশেষ করে ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে অপারেশন চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাছাড়া এক প্লাটুন স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপকে (কমান্ডো) দায়িত্ব দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার (নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, পৃ. ৭৬-৭৮)।
টিক্কা খান সেদিন ১৫টি সামরিক আইন বিধি জারি করেন-সামরিক আইন বিধি ১১৭ থেকে ১৩১ পর্যন্ত। এসব সামরিক আইন বিধিতে সব রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সেন্সরশিপ ছাড়া কোনো বক্তব্য, পোস্টার বা লিফলেট প্রকাশ নিষিদ্ধকরণ; রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত কোনো খবর বা মতামত প্রকাশ নিষিদ্ধকরণ; সরকারি, আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীদের ২৭ মার্চ সকাল ১০টায় কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার নির্দেশ প্রদান; এবং পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস বা শিল্পকারখানায় মিছিল ও সমাবেশ নিষিদ্ধকরণ; ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে কোনো ধরনের অস্ত্র রাখা নিষিদ্ধকরণ এবং কারফিউ ভাঙার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচজন বা তার বেশি লোকের একত্রে সমাবেশ নিষিদ্ধকরণ এবং এ বিধি জারির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাইক্লোস্টাইল বা রিপ্রডাকশন মেশিনের মালিকদের মেশিন সামরিক আদালতে জমাদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তাছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যদের যে কোনো জায়গায় দোকান, বাড়িতে অস্ত্র, প্রচারপত্র বা পোস্টার খোঁজার জন্য তল্লাশি চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয় (একাত্তরের ঢাকা, পৃ. ৯৪-৯৬)।
২৫ মার্চ সকাল থেকেই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে, আজ রাতেই ক্র্যাকডাউন হবে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অন্যান্য দিনের মতোই সারাদিন ভিড় লেগে ছিল। তবে সন্ধ্যার পর থেকে ভিড় কমতে থাকে। সর্বশেষে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তার বাসা থেকে বিদায় নেন (মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল, পৃ. ৯৫)। তারা দুজন বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে কোনো নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য বেশ পীড়াপীড়ি করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি বাড়ি থেকে অন্যত্র সরে যেতে সম্মত হননি।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন, ‘‘আমরা সংক্ষেপে শহরের অবস্থা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের সঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য পুনরায় অনুরোধ জানাই। বঙ্গবন্ধু তার পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল। তিনি বললেন, ‘তোমরা প্রতিজ্ঞা পাঠ করেছ, আমি যা নির্দেশ করব, তাই শুনবে। ... আমি তোমাদের আজ আদেশ করছি, এ মুহূর্তে তোমরা আমার বাড়ি থেকে চলে যাও। আর তোমাদের দায়িত্ব তোমরা পালন করবে। ... আমি বাড়ি ছেড়ে গেলে হানাদাররা আমার জন্য ঢাকা শহরের সকল লোককে হত্যা করবে। আমার জন্য আমার জনগণের জীবন যাক এটা আমি চাই না’’ (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পৃ. ১৯)। সাইমন ড্রিংকেও বঙ্গবন্ধু অনুরূপ কথা বলেছিলেন। সাইমন ড্রিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ২৫ মার্চ রাত্রে ‘শেখ মুজিবের কাছে টেলিফোন করলাম। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আমি পালিয়ে যাব না, আমি পালিয়ে গেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকার সব লোককে মেরে ফেলবে। আমাকে খুঁজতে জ্বালিয়ে দেবে ঢাকার সব বাড়িঘর’ (সংবাদ, ১০ আশ্বিন, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ)।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বের হয়ে ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তাজউদ্দীনের বাড়ি যান এবং তাকে জানান, বঙ্গবন্ধু সবাইকে আত্মগোপনের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তার আগেই তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনে যেতে রাজি করাতে না পেরে হতাশ মনে বাড়ি ফিরে আসেন। তার মেয়ে শারমিন আহমদ লিখেছেন, ‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে আব্বু গেলেন মুজিব কাকুকে নিতে। মুজিব কাকু আব্বুর সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন সেই ব্যাপারে আব্বু মুজিব কাকুর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। মুজিব কাকু সে ব্যাপারে সম্মতিও দিয়েছিলেন। ... অথচ শেষ মুহূর্তে অনড় রয়ে গেলেন। ... আব্বু বললেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য হলো পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণরূপেই নেতৃত্ব-শূন্য করে দেওয়া। এ অবস্থায় মুজিব কাকুর ধরা দেওয়ার অর্থ হলো আত্মহত্যার শামিল’ (তাজউদ্দীন আহমদ, নেতা ও পিতা, পৃ. ৪৫)। তবে প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধু কি পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের নজরদারির মধ্যে ছিলেন না? গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তার পক্ষে কি আত্মগোপনে যাওয়া সম্ভব ছিল?
তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম গভীর রাতে তাজউদ্দীনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সে সময় ড. কামাল হোসেন খুবই চিন্তিত ছিলেন। তাদের গাড়ি ১৫ নম্বর সড়কের কাছাকাছি পৌঁছলে ড. কামাল হোসেন গাড়ি থামাতে বলে একক সিদ্ধান্তে গাড়ি থেকে নেমে যান। অথচ কথা ছিল তারা তিনজন একসঙ্গে থাকবেন। তিনি নেমে যাওয়ার সময় কথা হয়েছিল, তারা পরদিন মুসা সাহেবের বাড়িতে গিয়ে একত্রিত হবেন। কিন্তু তিনি এভাবে একাকী গাড়ি থেকে নেমে গেলে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ভীষণ হতাশ ও বিরক্ত হন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার চরম অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাধা দিতে পারলাম না। তবে মনে মনে খুবই বিরক্ত হলাম। কামাল হোসেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু তার একক সিদ্ধান্ত নেয়ার ধরনটা মেনে নিতে পারলাম না।’
যা হোক, পরদিন তাদের মুসা সাহেবের বাড়িতে একত্রিত হওয়ার কথা থাকলেও তা আর সম্ভব হয়নি। ড. কামাল হোসেন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। আর তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লালমাটিয়ায় রেলওয়ের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আ. গফুর সাহেবের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সেখানে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি কেটে চেহারা বদলে ফেলেন। অতঃপর তিনি ‘রহমত আলী’ এবং তাজউদ্দীন আহমদ ‘মহম্মদ আলী’ ছদ্মনাম গ্রহণ করে ২৭ মার্চ রায়েরবাজার দিয়ে নদী পার হয়ে নবাবগঞ্জ-ফরিদপুর-মাগুরা-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত চলে যান (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পৃ. ২০-৩২)।
রাত ১টায় অপারেশন শুরু করার কথা থাকলেও সেনাবাহিনী রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে; যাতে তারা সময়মতো বিভিন্ন স্থাপনায় পৌঁছে গিয়ে রাত ১টায় একসঙ্গে অপারেশন শুরু করতে পারে। এরপর তারা আরম্ভ করে নারকীয় তাণ্ডব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানাস্থ ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ চালায়। পিলখানা ও রাজারবাগে তারা প্রতিরোধের মুখে পড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিনা বাধায় নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। তারা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কোয়ার্টারস, জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলে ব্যাপক গণহত্যা চালায়।
সাইমন ড্রিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘২৭ মার্চ সকালে ... ঢাকার যে চিত্র দেখেছি তা ছিল খুবই বীভৎস। ... ইকবাল হলে চোখে পড়ে এক চরম ধ্বংসযজ্ঞ। সবকিছু পোড়া বিধ্বস্ত, ছাত্রদের লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যত্রতত্র। আমরা একস্থানে একসঙ্গে ৭টি লাশ স্তূপাকারে পড়ে থাকতে দেখি। সর্বমোট ৩০টি লাশ আমাদের চোখে পড়ে এখানে-সেখানে’ (সংবাদ, ১০ আশ্বিন, ১৪০৩ বঙ্গাব্দ)। টিক্কা খান ৪০ ঘণ্টার মধ্যে বাঙালিদের খতম করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি মানুষ নিয়ে ভাবছি না, ভাবছি দেশকে নিয়ে (স্বাধীনতার সাতকাহন, পৃ. ১৬৬)। শাহরিয়ার কবির লিখেছেন, ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে শুধু ঢাকায় পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার নিরীহ মানুষকে অকাতরে জীবন দিতে হয়েছিল (একাত্তরের গণহত্যা, নির্যাতন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পৃ. ১১-১২)।
সেদিন রাত ১টার কিছু পরে বঙ্গবন্ধুকে তার ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে করাচি প্রেরণ করা হয়। তবে গ্রেফতার হওয়ার আগেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার একটি টেক্সট মেসেজ তিনি ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন শহরে প্রেরণ করেন। আর তার স্বকণ্ঠে রেকর্ডকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাসংবলিত একটি বাণী বেতার তরঙ্গে ছড়িয়ে দেন (নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, পৃ. ৭৯-৮০)।
মো. এনামুল হক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

