Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

কারাগারে ২৫ মার্চের রাত

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কারাগারে ২৫ মার্চের রাত

২৫ মার্চ ১৯৭১-এ আমি ছিলাম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ১১ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করা হয়েছিল। সেদিন এ সভায় বক্তৃতা করেছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতৃবৃন্দ এবং তখনকার ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার।

আমি তখন ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। আমিও সেই সভায় বক্তৃতা রেখেছিলাম। এ ছাড়া আর যারা বক্তৃতা করেন তারা হলেন-কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, চিরানন্দ মজুমদার এবং আতিকুর রহমান সালু। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ১১ দফা কর্মসূচি পাঠ করেন প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ।

কেন আমরা এমন একটি দুঃসাহসিক কাজ করতে গেলাম? এ প্রশ্ন যারা গভীরভাবে রাজনীতিকে বুঝতে চান তাদের সবার মনে নাড়া দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যখন আমরা ছাত্রলীগের কর্মী ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করতাম, তখন আমি একটি কথা বলতাম। সেটা হলো ৬ দফা কর্মসূচি ৬ দফাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি ১ দফার আন্দোলনে পরিণত হবে। সেই আন্দোলন হবে সশস্ত্র।

পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ৬ দফা মেনে নেবে এমনটি আশা করা দুরাশা মাত্র। কারণ ৬ দফায় এমন কিছু দাবি আছে, যেগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে এক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকে না। আমি আরও বললাম, আমাদের ভাবতে হবে সশস্ত্র সংগ্রাম আমরা কীভাবে সংগঠিত করব। অস্ত্র কোথায় পাওয়া যাবে। আমাদের মধ্যে এমন কে আছেন, যিনি মাও জে দং বা হো চি মিনের মতো একটি সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে পারেন?

ভিয়েতনামে ছিলেন জেনারেল গিয়াপ, যিনি গেরিলা যুদ্ধের কৌশল খুব চমৎকারভাবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিলেন। চীন বিপ্লবেও মাও জে দংয়ের সঙ্গে ছিলেন চু দে এবং মার্শাল হো লুং। আমার কথা ছিল, একটি দীর্ঘস্থায়ী আত্মনির্ভর যুদ্ধের জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

পল্টন ময়দানে আমাদের সভাটি হয়ে যাওয়ার পর আমরা যারা বক্তৃতা করেছিলাম, তাদের সবার বিরুদ্ধে সামরিক আইনে মামলা করা হয় এবং আমাদের সবার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এ ব্যাপারে আমরা সময়মতো প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাই।

আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আত্মগোপনে থাকব। তখনকার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের হলগুলো রাত কাটানোর জন্য নির্ভরযোগ্য আশ্রয় ছিল। পুলিশ এবং ইপিআরের পক্ষে বড় ধরনের হাঙ্গামার ঝুঁকি না নিয়ে হলগুলোতে রাতের বেলা অভিযান চালানো সহজ ছিল না। এ ভরসাই আমরা করেছিলাম।

এরকম একটি সময়ে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা বিএম কলিমুল্লাহ ঢাকায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন এবং আমাকে অনুরোধ করলেন, আমি যেন মওলানা ভাসানীকে হাজীগঞ্জে একটি জনসভা করার জন্য তাকে রাজি করাই। আমি বললাম, এটা সম্ভব নয়। কারণ আমার ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে এবং আমি যদি মওলানা ভাসানীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি, তখন পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে ফেলবে।

এসব বলা সত্ত্বেও বিএম কলিমুল্লাহ আমাকে অনুরোধ করতে থাকেন। ওই সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী শাহরুখ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। আমি জানতাম, কিছুক্ষণ পরই মওলানা ভাসানী বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাবেন। শাহরুখ বলল, সে আমাকে তার প্রাইভেট কারটি দিয়ে দ্রুত তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে পারবে এবং কাজ সেরে দ্রুত ফিরে আসতে পারবে। এটি ছিল হিসাবের ভুল। বড় রকমের ভুল। আমি যখন বিমানবন্দরে পৌঁছালাম, মওলানা ভাসানী তখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। ওই অবস্থায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব ছিল না।

মওলানা সাহেব কথা শেষ করে দ্রুত বিমানে ওঠার জন্য রওনা করলেন। আমি দ্রুত বেরিয়ে এসে গাড়ির কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করলাম। এ সময় প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং পরবর্তী সময়ে এরশাদের মন্ত্রী বলে উঠলেন এখানে কারও নামে হুলিয়া আছে কিনা। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর, যাদের বেশিরভাগই ছিল সাদা পোশাক পরা তাদের তৎপরতা দেখে ব্যাপারটি আঁচ করছিলেন। আমি বললাম, আমার নামে হুলিয়া আছে। তিনি বললেন, তাহলে তো হয়েছে। বিমানবন্দর ভবনের বাইরে আসার পর একজন সাদা ধবধবে পোশাক পরা পুলিশ অফিসার আমাকে পেছন দিক থেকে ডাকলেন এবং আমার নাম-পরিচয় জানতে চাইলেন।

আমি পরিচয় জানানোর পর তিনি তার পরিচয় জানিয়ে বললেন, তিনি হলেন ডিএসপি লোদি। তিনি বললেন, আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। আমাকে একটি জিপে তোলা হলো এবং তার পেছনেই ছিল সশস্ত্র পুলিশ বহনকারী একটি ভ্যান। নানা পথ ঘুরে আমাকে রমনা পুলিশ স্টেশনে নিয়ে আসা হলো। সেই সময় রমনা পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন তৈয়ব হোসেন কাজী। আমাকে রমনা থানার ওসির রুমে কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলো। শুরু হলো দীর্ঘ কারাবাস। তৈয়ব হোসেন কাজী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্রে পড়েছিলাম ডিএসপি লোদিকে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত এ পুলিশ অফিসারকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। যে ব্যক্তি পাকিস্তান রক্ষার জন্য আমাকে গ্রেফতার করেছিলেন, তাকে সম্ভবত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করে এবং নিখোঁজ করে দেয়।

আমার গ্রেফতারের ৭ দিনের মাথায় মার্শাল ল’ কোর্টে বা সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে হাজির করা হলো এবং ১০ মিনিটের মধ্যেই বিচার কাজ সম্পাদন করা হলো। সামরিক আদালতে যুক্তিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। বিচার কাজের দায়িত্বে ছিলেন মেজর তিরমিজি নামে একজন পাঞ্জাবি সামরিক অফিসার। সেদিন আদালতে আমাকে সহায়তা করার জন্য এসেছিলেন ভাসানী ন্যাপ নেতা ব্যারিস্টার আবদুল হক। তিনিও কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। আদালতে এক ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করা হয়। লোকটি ছিল নিরক্ষর এবং গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতা তার ছিল না। সে বলল, সে মালিটোলায় থাকে। সে আরও বলল, ২২ ফেব্রুয়ারির জনসভায় সে উপস্থিত ছিল। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, এ অভিযুক্ত ব্যক্তি কি পাকিস্তান ধ্বংস করার কথা বলেছেন? সে শুধু জবাব দিল, কথাটি সত্য। মেজর সাহেব আমার দণ্ড ঘোষণা করলেন। আমাকে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১৫ বেত্রদণ্ড দেওয়া হলো। একই নির্দেশ জেলখানায় পাঠানো হলো।

এটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন জেলার নির্মল রায় নিশ্চিত করেছেন; কিন্তু পত্রপত্রিকায় উঠল আমাকে শুধু ১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সামরিক আইন বলবৎ রাখার বিরোধিতা করা। পাকিস্তানের ভূখণ্ডগত ঐক্য ও সংহতি ভেঙে ফেলার জন্য ওকালতি করা এবং নির্বাচনের বিরোধিতা করা।

আমি আমার স্ত্রীকে জানালাম, আমাকে দণ্ড দিয়ে কারাগারে যে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে, তাতে ১৫ বেত্রদণ্ডের পরিষ্কার উল্লেখ আছে। কিন্তু খবরের কাগজগুলোতে বেত্রদণ্ডের কোনো উল্লেখ নেই। গোপনভাবে আমার স্ত্রীকে এ খবর জানানোর পর সে একটি বিবৃতি দেয়। সে জানতে চায়, আমাকে প্রকৃতপক্ষে কী দণ্ড দেওয়া হয়েছে। তার বিবৃতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় বিবৃতিটি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায় ছাপানো হয়। পরদিন আইএসপিআরের পক্ষ থেকে জানানো হলো, আমাকে ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার জিলানী পুরো বিষয়টি রিভিউ করে বেত্রদণ্ডের আদেশ বাতিল করেছেন। শুরু হলো আমার সশ্রম কারাদণ্ডের জীবন। আমাকে পুরোনো কম্বলের পিস করা অংশ থেকে সুতা আলাদা করতে হতো।

অনেক সময় অন্য কয়েদিরা সুযোগ পেলেই কাজটি করে দিত। ৩০ জানুয়ারি ১৯৭১ আমার কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হলো। আমাকে কারামুক্তির পর নিয়ে যাওয়ার জন্য জেলগেটে কয়েকশ ছাত্রছাত্রী এবং ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আমাকে মুক্তি দেওয়া হলো না। সামরিক আইনের ১৬ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে আমাকে আটকে রাখা হলো। দু-চার দিনের মধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ এলো আমাকে জননিরাপত্তা আইনে ডিটেনশন দেওয়া হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে ৫২ দফা অভিযোগ করে এ আটকাদেশ দেওয়া হয়। প্রতি তিন মাস পর আটকাদেশ বর্ধিত করা হতো। মার্চ মাস শুরু হলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে থাকল। পূর্বের নির্ধারিত দিনে সংসদ অধিবেশন ডাকার ঘোষণা বাতিল করা হলো। এরপর ৭ মার্চ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে উদ্দীপনাময় ভাষণ দিলেন। মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের ইতিহাস এবং সামরিক সরকারের ষড়যন্ত্রের চেহারা তুলে ধরলেন।

তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ ছাড়া তিনি কিছু শর্তও প্রদান করলেন। তার মধ্যে ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, যারা আহত-নিহত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং সংসদের অধিবেশন ডাকা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তারা মনে করেছিল, শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন এবং তা করলে রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশের ওপর হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলি করে রক্তবন্যা বইয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু বাঙালি জাতির নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট পাওয়া নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতার ভাষা ও বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা এমনভাবে চয়ন করলেন যে, এ বক্তৃতাকে আন্তর্জাতিক মহলে ইউনিলেটারেল ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স হিসাবে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। শান্তিপূর্ণভাবে সভার কাজ শেষ হলো।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেন। আলোচনা বৈঠক হলো। শেষ পর্যন্ত সামরিক ক্র্যাকডাউনের বাস্তবায়ন শুরু হলো ২৫ মার্চ রাত থেকে। এর আগেই ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোও এসেছিলেন। তিনি দুই প্রধানমন্ত্রী ও এক প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রকাঠামো সংবিধানে যোগ করার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু এ প্রস্তাব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না।

কারাগারে থাকাবস্থায় অন্য একটি মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে খবর পেয়েছিলাম, পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তারা ক্র্যাকডাউন করবে। আদালতে আমার সঙ্গে দেখা করতে ছাত্র ইউনিয়নের কিছু নেতাকর্মী আসত। তাদের মধ্যে একজন ছিল বেশ বুদ্ধিমান ও নির্ভরযোগ্য।

তার মাধ্যমে মশিউর রহমান যাদু মিয়া ক্র্যাকডাউনের খবরটি পাঠান এবং জানতে চান আমাদের কী করা উচিত। আমি জানিয়ে দিলাম আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করে বৃহত্তর ঐক্যের জন্য জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা উচিত। আমার মাথায় ভিয়েতনামের মডেলটি কাজ করছিল। ২৫ মার্চ সকালেই পরিষ্কার হয়ে গেল আলোচনা আর হচ্ছে না এবং ক্র্যাকডাউন অবশ্যম্ভাবী।

২৫ মার্চ রাতে ১১-১২টার দিকে ইনসেনডিয়ারি বোমা নিক্ষেপ করে আকাশ আলোকময় করে তোলা হচ্ছিল এবং থেমে থেমে গুলিবর্ষণের আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল। সামরিক বাহিনী রাতের বেলা যদি অপারেশন চালায় তাহলে অন্ধকার ঘোচানোর জন্য এ বোমাটি ব্যবহার করে। কারাগারের ১৮ ফুট প্রাচীর অতিক্রম করে ফর্সা আকাশ দেখা গেছে। এমন সময় জেলার নির্মল রায় রাউন্ডে এসেছেন।

তার সঙ্গে জেল হাসপাতালের কম্পাউন্ডার এবং একজন সিপাহি, জেলখানার ভাষায় যাদেরকে মিয়া সাহেব বলা হয়, লণ্ঠন হাতে নিয়ে ছিলেন। জেলার সাহেবকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বাইরের পরিস্থিতি কেমন? উত্তরে তিনি খুব সংক্ষেপে নিচু গলায় বললেন, ভালো নয়। তিনি জানতেন, আমাদের বোঝার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। রাত ৩টার দিকে আইজি প্রিজনকে জগন্নাথ কলেজে অবস্থিত সামরিক ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, মার্চ মাসের প্রথম দিকে যে জেল বিদ্রোহ হয়, তার সঙ্গে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কোনোরকম ইন্ধন ছিল কিনা। তিনি স্পষ্টভাবেই জানিয়েছিলেন, এ ব্যাপারে তিনি আদৌ অবহিত নন। তাকে সকাল ৮টার দিকে পাকিস্তান বাহিনী তার বাসায় পৌঁছে দিল। সেই সময় খাকি পোশাক পরা বাঙালিরা ছিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রধান টার্গেট। ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অনেক পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। দীর্ঘ কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন কয়েদি মিটফোর্ড হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের জন্য ভর্তি হয়েছিল। সে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে আমাকে বলেছিল, সে পুলিশের অনেক লাশ স্তূপীকৃত অবস্থায় দেখতে পেয়েছিল। ২৬ মার্চ সকাল ৯-১০টার দিকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল জেলের সিপাহিদের ডরমিটরি ঘেরাও করল।

তাদের লাইন ধরে দাঁড়াতে নির্দেশ দিল। তারা সবাই কলেমা পড়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিল। এখন শুধু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ করা হবে। কারণ তাদের পোশাকও খাকি। তারা শত্রু। এ সময় পাকিস্তানি সৈনিকদের কমান্ডার জেলে সিপাহিদের কাছ থেকে জানতে চাইল তাদের বস কে। তারা বললেন, তাদের বস হলেন আইজি প্রিজন। তাকে রাত ৩টায় গ্রেফতার করে সকাল ৮টায় ছেড়ে দিয়েছে। তবুও কমান্ডার একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওয়াপেস দে দিয়া?

সিপাহিরা সবাই বলল, ইয়ে সাচ্চা বাত হ্যায়। তারপর কমান্ডার বলল, ঠিক হ্যায়। আপলোগ আচ্ছা আদাম হ্যায়। আপনা আপনা ডিউটি খাস কারকে করো। এদিকে জেলের অভ্যন্তরে যেসব সিপাহি ডিউটি করছিল তারা ভয়ানক ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের মনে শুধু একটিই ভয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী খাকি পোশাক দেখতে পেলে রেহাই নেই। তাই তারা প্যান্টের ভেতরে গোঁছ মেরে লুঙ্গি পরেছিল। যেই মাত্র শুনতে পেল জেলগেটে আর্মি এসেছে, সেই মুহূর্তেই খাকি প্যান্ট শার্ট খুলে কেবল লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে দাঁড়াল এবং থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। পড়তে থাকল নানারকম দোয়া দরুদ।

পুরো ’৭১ জুড়ে আমার কারা জীবনে বেশকিছু বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ পর্যায়ে সেগুলো তুলে ধরলে কাহিনিটা অনেক বড় হয়ে যাবে; তাই শেষ করছি। সেই কাহিনিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম