Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্বদেশ ভাবনা

নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার অপরিহার্য

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার অপরিহার্য

এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, গণতন্ত্রের উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই-সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বছরে পেছন ফিরে দেখার সময় এসেছে গত পাঁচ দশকে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কতটা কার্যকর হয়েছে। গণতন্ত্র কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।

জাতীয় নির্বাচন বলতে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনকে বোঝানো হয়েছে। সংবিধানের ১১৯(১) অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। দায়িত্ব প্রদান করেই সংবিধান নিশ্চুপ থাকেনি। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারী (এখানে কর্মচারী বলতে কর্মকর্তাকেও বোঝাবে) প্রয়োজন হবে, কমিশন অনুরোধ করলে রাষ্ট্রপতি সেরূপ কর্মচারীর ব্যবস্থা করবেন।

সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের বিধান অনুসারে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩য় অনুচ্ছেদের নির্দেশনার আলোকে সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিস্তারিত বিধানাবলি সংবলিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ জারি করা হয়েছে, যা সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় সংশোধিত হয়েছে।

তাছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অধীনে প্রণীত হয়েছে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, স্বতন্ত্র প্রার্থী বিধিমালা। আরও প্রণীত হয়েছে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন। এ সবের উদ্দেশ্য হলো অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর যেমন-ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার নির্বাচন তাদের স্ব স্ব আইন যেমন-ইউনিয়ন পরিষদ আইন, উপজেলা পরিষদ আইন, জেলা পরিষদ আইন, সিটি করপোরেশন আইন এবং পৌরসভা আইনের অধীনের অনুষ্ঠিত হয়। এসব আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন পরিচালনা করে। এসব আইনের অধীনে প্রণীত হয়েছে নির্বাচন আচরণ বিধিমালা, যার উদ্দেশ্য হলো সব ধরনের প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন পরিচালনা করবে।

সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যেরূপে নির্দেশ করবেন, সেরূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং ওই বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করবেন।

২০১১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা অনধিক চারজনে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ অনুচ্ছেদের অন্যান্য বিধান অপরিবর্তিত থাকে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেই নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত আইন থাকলেও সংবিধানের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে গত প্রায় পাঁচ দশকে এ বিষয়ে আইন প্রণীত হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সময়ে সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক দলগুলো শুধু সংবিধান নির্দেশিত নির্বাচন কমিশন গঠন আইন প্রণয়নে উদ্যোগ নেওয়া থেকে বিরত থাকেনি, বরং তারা তাদের দলীয় ভাবধারায় বিশ্বাসী বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দিয়ে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে তাদের সহায়তায় জয়লাভ করে ক্ষমতায় থাকার সময় দীর্ঘায়িত করেছে।

এ প্রক্রিয়া এখনো সক্রিয় রয়েছে। একটি বাছাই কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত দ্বিগুণসংখ্যক ব্যক্তির মধ্য থেকে একজন সিইসি ও চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দানের যে পদ্ধতি বর্তমান ও এর আগের নির্বাচন কমিশন গঠনে অনুসরণ করা হয়েছে, তা নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধানের নির্দেশনাকে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল মাত্র। নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধান নির্দেশিত আইনটি যত তাড়াতাড়ি প্রণয়ন করা যাবে, ততই তা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনে সহায়ক হবে এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩য় অনুচ্ছেদের নির্দেশনার আলোকে ১৯৭২ সালে জারিকৃত আরপিওতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় প্রয়োজনীয় প্রায় সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এসবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো-নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও দায়িত্ব, মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিযুক্ত রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব ও ক্ষমতা, প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের ক্ষমতা ও দায়িত্ব, নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা ও বাছাই, প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হলফনামায় আটটি বিষয়ে তথ্য প্রদান, চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ব্যয়সীমা ও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী একজন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়সীমা, ভোটগ্রহণ পদ্ধতি, ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন।

গত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ক্ষমতা প্রয়োগে আগ্রহী হয়নি, যার ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারেনি। আরপিও’র ৯১-ই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি নির্বাচন কমিশনের নিকট প্রতীয়মান হয় যে কোনো প্রার্থী বা তার এজেন্ট আরপিও বা বিধিমালা বা আচরণ বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করেছেন বা লঙ্ঘনের চেষ্টা করছেন, তবে কমিশন কতিপয় শর্ত পালন সাপেক্ষে ওই প্রার্থীর প্রার্থীপদ বাতিল করতে পারবেন। গত প্রায় পাঁচ দশকের নির্বাচনের ইতিহাসে কমিশন তার এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে বলে মনে পড়ে না।

গণপ্রতিনিধি আদেশে একজন প্রার্থীর ব্যয়সীমা ২৫ লাখ টাকা নির্ধারিত হলেও অধিকাংশ প্রার্থী এ ব্যয়সীমার অনেকগুণ বেশি টাকা নির্বাচনে খরচ করেন। নির্বাচনী প্রচারণাকালে একজন প্রার্থী নির্ধারিত ব্যয়সীমার অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করলেও নির্বাচন কমিশন তার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহ দেখায় না। ফলে নির্বাচনে পেশিশক্তি ও কালো টাকার প্রভাব অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে, যা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করে ফেলছে।

আমাদের সংবিধান জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এ নির্বাচন পরিচালনা করে মূলত মাঠ প্রশাসন। আরপিও ১৯৭২-এ সংসদ সদস্যদের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসাবে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা না থাকলেও কমিশন কর্তৃক জেলা প্রশাসককে (ডিসি) রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (ইউএনও) সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসাবে নিয়োগ প্রদান একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিধিত্ব আদেশে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে রিটার্নিং অফিসার মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার নিয়োগ দেন।

এ আদেশে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে একজন রিটার্নিং অফিসার তার কর্তৃত্বাধীন এলাকায় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার স্বার্থে প্রয়োজনীয় যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক কোনো শর্ত আরোপ সাপেক্ষে সহকারী রিটার্নিং অফিসার রিটার্নিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণে থেকে রিটার্নিং অফিসারের ক্ষমতা ভোগ ও কার‌্যাবলি সম্পন্ন করেন। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ওসিসহ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ডিসি, ইউএনও, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ওসি-এসব কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ তাদের পদোন্নতি, বদলিসহ তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকায় ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে নির্বাচনে তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা অনেকটা সহজ হয়। বাংলাদেশে এ যাবৎ দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার পরাজিত না হওয়া এর সত্যতা প্রমাণ করে।

বাস্তবিক অর্থে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১১টি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে চারটি যেমন-অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬-এর ১২ জুন, ২০০১-এর ১ অক্টোবর এবং ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হলেও দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যেমন-জাতীয় আওয়ামী লীগের শাসনামলে ১৯৭৩-এর ৭ মার্চ, বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি, জাতীয় পার্টির শাসনামলে ১৯৮৬-এর ৭ মে ও ১৯৮৮-এর ৩ মে এবং বিএনপি শাসনামলে ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন নিরপেক্ষতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারগুলোর পক্ষে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে মাঠ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। ফলে এসব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি।

স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে ৪৫ বছর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয়ভাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১৪-১৮ মেয়াদে স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ (সংশোধন) আইন-২০১৫, উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন-২০১৫, পৌরসভা (সংশোধন) আইন-২০১৫ এবং সিটি করপোরেশন (সংশোধন) আইন-২০১৫-এর মাধ্যমে কেবল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল মনোনীত এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ম এখনো বলবৎ রয়েছে। এতে শুধু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পদে নির্দলীয়ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যই লোপ পায়নি, বরং সমাজে, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে হাজার হাজার বছরের সামাজিক বন্ধনে ফাটল ধরেছে। দলীয় আনুগত্যের কারণে একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সদ্ভাব নষ্ট হয়েছে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন রাজনীতিকীকরণ, নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা এবং নির্বাচন পরিচালনাকারী মাঠ পর্যায়ের কর্মতাদের ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি কারণে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্যবর্তী এবং একাদশ সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০১৫, পৌরসভা নির্বাচন ২০১৫, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ২০১৬, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০২০ এবং সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ক্ষমতাসীন সরকার গ্রামীণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ প্রতিষ্ঠান জেলা পরিষদে আইন (জেলা পরিষদ আইন ২০০০) প্রণয়ন করে এমন এক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে যেখানে সাধারণ মানুষের ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। ভোট দেবেন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা নির্বাচকমণ্ডলী। এ পদ্ধতি আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনীয়।

উপরের বর্ণনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, নব্বইয়ের দশকে এবং ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত কয়েকটি সংসদ নির্বাচন ছাড়া স্বাধীনতার পাঁচ দশকে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি এবং এসব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কোনো দলীয় সরকার পরাজিত হয়নি। জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব পড়েছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের ওপর। নির্বাচন ব্যবস্থা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়নি। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের। গত এক দশকে ভোটারদের ভোট দিতে না পারাসহ নানা অনিয়মের কারণে মানুষ ভোট প্রদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। জাতীয় নির্বাচন, উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে খুব স্বল্পসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছে, যা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। তাই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে ন্যূনতম ভোটের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করা দরকার হয়ে পড়েছে।

২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছিল, ওই বছরের ৩০ আগস্ট অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনে আসনভিত্তিক রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। কমিশন থেকে সে অনুযায়ী আরপিওতে সংশোধনী আনার প্রস্তাব সরকারের কাছে পেশ করার সিদ্ধান্ত হয়।

পরে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি। জেলাভিত্তিক নিয়োজিত রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় মিডিয়া ক্যুর নজির দেশে রয়েছে। তাই আসনভিত্তিক রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে। আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে সংসদ সদস্য নির্বাচন, অর্থাৎ যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সে দল জাতীয় সংসদে তত শতাংশ সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাবে-ফর্মুলাটি বিবেচনার দাবি রাখে। মোটকথা, গত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা বলে দেয়, নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার আনা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম