Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তৃতীয় মত

আমাদের প্রশাসন কি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত?

Icon

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের প্রশাসন কি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত?

সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে হিন্দুদের বাড়িতে হামলা-ভাংচুর। ফাইল ছবি

সুনামগঞ্জের শাল্লার একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে সম্প্রতি যা ঘটে গেল, তাতে অনেকের মনেই এ প্রশ্নটি জাগা স্বাভাবিক-আমাদের প্রশাসন কি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত? নইলে মাইকে ঘোষণা দিয়ে যেখানে পুলিশের নাকের ডগায় নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর অত্যাচার চালানো হলো, সেখানে পুলিশ নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করল কেন? সময় থাকতে অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারগুলোকে রক্ষায় এগিয়ে গেল না কেন?

ব্রিটিশ সরকার স্বীকার করে, তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এখনো বর্ণবাদী প্রবণতা আছে। প্রায়ই এ বাহিনীর মধ্য থেকেই রেসিজমের অভিযোগ ওঠে। এখন তো ব্রিটিশ রাজপরিবারেই রেসিজম বা বর্ণবাদের রোগ আছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ তুলেছেন সদ্য রাজপরিবার থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রিন্স হ্যারি এবং তার স্ত্রী মেগান। হ্যারি চার্লস ও ডায়েনার দ্বিতীয় পুত্র। এ অভিযোগে রাজপরিবার বিব্রত এবং আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। আমেরিকার পুলিশ বাহিনীতে যে রেসিজম আছে, তার প্রমাণ তো বারবার সাদা পুলিশের হাতে কালো নাগরিকের মৃত্যু। সম্প্রতি এমন এক মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ডে ‘ব্লাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে সারা আমেরিকা কম্পিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পতনেরও এটি একটি কারণ।

বাংলাদেশের প্রশাসনে অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে সাম্প্রদায়িকতা আছে কিনা তা নিয়ে কখনো কোনো জরিপ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, দাবি করেছে, তাদের প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ ধোয়া তুলসীপাতা। তারা সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতামুক্ত। এ দাবি সঠিক হলে আমরা খুশি হতাম। কিন্তু সরকারের দাবি এক, বাস্তবতা বলে অন্য কথা।

আর কেউ নন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য ঢাকার একটি বাংলা দৈনিককে (যুগান্তর নয়) নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে বলেছেন, ‘শাল্লায় হামলার বিষয়টি আগে থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন সংখ্যালঘুরা। এরপরও সেখানে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় স্থানীয় প্রশাসন। সহস্রাধিক লোক জড়ো হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল পুলিশের। অতীতেও দেখা গেছে, স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বল ভূমিকার কারণে এসব হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে এর দায় শেষমেশ আওয়ামী লীগ ও সরকারের ওপরই এসে বর্তায়।’

এই বক্তব্য শুধু প্রশাসন নয়, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত কিনা এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে অনেকের মনে জাগাবে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘সুনামগঞ্জের হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে স্থানীয় বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোনো প্রতিবাদ জানায়নি, যা আমাকে ভাবাচ্ছে। শাল্লার হিন্দুদের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছিল সেখানে হামলা হতে পারে। প্রশাসন জেনেও কেন নিষ্ক্রিয় ছিল?’

সনজিত চন্দ্র দাসের এ বক্তব্যের জবাব কী দেবে তারই সংগঠন স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অথবা স্থানীয় প্রশাসন? ঢাকার কাগজে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘সুনামগঞ্জের হিন্দু পল্লিতে হামলা হয় মাইকে ঘোষণা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে। পুলিশ অন্তত ১২ ঘণ্টা আগে হামলা হবে জেনেও তা ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

এ হামলাটি যে পরিকল্পিত তা বোঝা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের মতো এখানেও হিন্দু যুবক কর্তৃক ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে এবং পুলিশ অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে ওই যুবককে গ্রেফতার করেছে। এ গ্রেফতার করার কাজটি কি বৈধ হয়েছে? একটি সূত্র জানায়, ওই যুবক একটি ধর্মীয় দলের নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্যের জবাব ফেসবুকে দিয়েছেন। তা যদি হয়, তাহলে গ্রেফতার করতে হয় মূল উসকানিদাতাদের। উসকানির যিনি প্রতিবাদ করেছেন তাকে গ্রেফতার করা কোনোক্রমেই একটি গণতান্ত্রিক দেশের পুলিশের বৈধ কাজ নয়। তারা যদি ওপরের নির্দেশে কাজটি করে থাকে, তাহলে প্রশ্ন করা যায়, এ উপরওয়ালা কারা? ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা কি?

শাল্লায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় যুবলীগের এক স্থানীয় কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। যুবলীগের নেতারা বলেছেন, গ্রেফতার হওয়া যুবক যুবলীগের কেউ নয়। এ কথা এখন কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে কি? একটা ব্যাপার সত্য। শাল্লার হামলাকারীদের ধরার জন্য পুলিশ ও র‌্যাব এখন হন্যে হয়ে উঠেছে। হামলাকারীদের মদদদানকারী শহিদুল ইসলাম স্বাধীন (ইউপি সদস্য)সহ ২০-২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হয়তো আরও গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু তারা বিচারে সোপর্দ হলেও শাস্তি পাবে কি? অতীতের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কক্সবাজারের রামুর ঘটনা কী বলে? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

শাল্লার ঘটনাটি মিডিয়ায় এমনভাবে প্রচারিত হয়েছে এবং দেশের মানুষের মনে এমন ধিক্কার জন্ম দিয়েছে যে, আওয়ামী লীগ দল বা প্রশাসনের পক্ষে আপাতত বিষয়টি চেপে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই শাল্লায় পুলিশ ও র‌্যাবের জোর তৎপরতা চলছে। এ প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। তবে প্রচেষ্টাটি বিলম্বিত। শিয়াল মুরগি নিয়ে যাওয়ার পর গৃহস্থের ঘুম ভেঙেছে। এখন সরকার হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারগুলোকে ঘরবাড়ি নির্মাণ, মন্দির ও পারিবারিক দেবালয় মেরামতের জন্য অর্থ সাহায্য দেবে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো উপকৃত হবে। কিন্তু তাদের আক্রান্ত শিশু ও নারীদের মনে নিরাপত্তাবোধ ফিরে আসবে কি? এ হামলার ভীতিজনক স্মৃতি তাদের মনে পুরোনো ঘায়ের মতো দীর্ঘদিন কি দগদগ করতে থাকবে না?

বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর জন্য এখন দরকার তাদের মনে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা। টাকা-পয়সা সাহায্য দিয়ে তাদের পুনর্বাসিত করা যাবে, তাদের মনে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা যাবে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রামুর ঘটনা এবং শাল্লার ঘটনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো ভাববে, দেশে তাদের নাগরিক অধিকার নেই। বিনা কারণে যখন-তখন তাদের নির্যাতন করা হবে এবং তারপর সরকার তাদের পুনর্বাসনের জন্য কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের কর্তব্য সমাধা হলো ভাববে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর মন থেকে এ ভীতি ও নিরাপত্তাবোধহীনতা দূর করতে হলে দেশে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে গণ্য করা চলবে না। তাদের পূর্ণ নাগরিকত্বসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আগে আওয়ামী লীগ ছিল সংখ্যালঘুদের একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কিন্তু বর্তমানে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক ভূমিকা ক্রমাগত ক্ষুণ্ন হওয়ায় সংখ্যালঘুদের ভরসা করার কোনো স্থান নেই। আগে আওয়ামী লীগ কোথাও সাম্প্রদায়িক শক্তির তৎপরতা দেখলে তা প্রতিরোধের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। ১৯৫০ ও ১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনের কথা এখানে স্মর্তব্য।

এখন সেই আওয়ামী লীগ আছে কি? ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রামু, শাল্লার ঘটনায় সেই আওয়ামী লীগ, সেই ছাত্রলীগের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় কি? ক্ষমতাসীন দল যদি কঠোরভাবে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী না হয়, তাহলে সেই দলের অধীনস্থ প্রশাসনও সাম্প্রদায়িকতার দানব দমনে সক্রিয় ভূমিকা নেবে না এটাই স্বাভাবিক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রামুতে কী ঘটেছিল?

ঠিক শাল্লার হিন্দু যুবক কর্তৃক ফেসবুকে ধর্মবিরোধী বক্তব্য প্রদানের গুজবের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা সদরে অনুরূপ গুজব প্রচার করে ১০টি হিন্দু মন্দির ভাঙা হয় এবং শতাধিক হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী ও শিশুদেরও নির্যাতন করা হয়। এ হামলার ২২৮ জন আসামি এখনো জামিনে মুক্ত অবস্থায় বহাল তবিয়তে আছে।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে ১২টি ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করা হয় এবং বৌদ্ধপল্লিতে অগ্নিসংযোগ ও নারী-শিশু নির্বিশেষে বৌদ্ধ অধিবাসীদের চরম নির্যাতনের শিকার করা হয়। পরের দিন উখিয়া ও টেকনাফেও চলে সাতটি বৌদ্ধবিহারে অগ্নিসংযোগ। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। কিন্তু তাদের মনের ঘা শুকাতে পারেনি। অর্থাৎ তাদের মনে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে দিতে পারেনি। এ হামলার ১৮টি মামলা এখনো বিচারাধীন। ধৃত আসামিদের কেউ কারাগারে নেই।

দেশের এ অবস্থা মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগায়, আমাদের প্রশাসন সাম্প্রদায়িকতামুক্ত কি? সাম্প্রদায়িকতামুক্ত কি আমাদের অসাম্প্রদায়িক নামে পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলোও? ব্রিটেনে রাজপরিবারের ভেতরে রেসিজম বা বর্ণবাদ রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠায় রাজপরিবার বিব্রত। তারা এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। আমাদের দেশে শুধু প্রশাসন নয়, ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধেও সাম্প্রদায়িকতার যে অভিযোগ উঠেছে, তা মিথ্যা প্রমাণের জন্য তারা একটু সচেষ্ট হবেন কি? সচেষ্ট না হলে এদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হবে, এ সতর্কবাণীটি তাদের জানিয়ে রাখতে চাই।

লন্ডন ২১ মার্চ, রবিবার, ২০২১

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম