Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্বাধীনতার মাসে এ কীসের আলামত?

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাধীনতার মাসে এ কীসের আলামত?

সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনাটি চরম নিন্দনীয়, অবাঞ্ছিত, অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যে কারও মনে প্রশ্ন দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক-এক সাগর রক্ত ও বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে পাওয়া লালন-হাছন আর রবীন্দ্র-নজরুলের কর্ম ও সাধনাক্ষেত্র অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মাথায় আজ এ কীসের আলামত? আমরা লজ্জিত ও বাকরুদ্ধ। এর প্রতিকার কী? ঘরে-বাইরে আওয়ামী লীগের অনেক শত্রু আছে, কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে কীভাবে ওরা কাণ্ডটি ঘটাতে পারল! আজ আত্মসমালোচনারও ভীষণ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

অগ্নিঝরা মার্চ। আবেগ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দ-বেদনার কথা বলে শেষ করা যাবে না। প্রতিরোধের প্রস্তুতি, ঘুম জাগানিয়া ঐতিহাসিক ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণা। কালরাতে ঘুমন্ত জাতির ওপর উন্মত্ত হামলা। মহান নেতার জন্ম। আর এবারের মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের মাস। ১৭ মার্চ বুধবার সকাল ৮টায় কৃতজ্ঞ জাতি যখন পরম শ্রদ্ধাভরে বঙ্গবন্ধুর জন্মোৎসব পালনে তৎপর, ঠিক তখনই সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁ গ্রামে শত শত উন্মত্ত লোক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে স্লোগান দিতে দিতে হিন্দু সম্প্র্রদায়ের বাড়িঘর ও ধর্মমন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এমন উন্মত্ততা দেখে অনন্যোপায় হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে দৌড়ে হাওড় এলাকায় আশ্রয় নেয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গত দুদিনেও নারী ও শিশুরা বাড়িঘরে ফিরে আসেনি, সবাই নিরাপত্তহীনতায় ভুগছে। এর আগেও নানা ছুতায় ভয়াবহ হামলা ও নৃশংসতা দেশের বিভিন্ন স্থানে হয়েছে। এসব ঘটনা একাত্তরের ক্ষতের কথাই বারবার মনে করিয়ে দেয়। সেই উদ্বেগ, সেই উৎকণ্ঠা, সেই অনিশ্চয়তা আর বাড়িঘর ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ যাত্রা! এ জঘন্য সাম্প্রদায়িক অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কেবল এলাকাবাসী নয়, সচেতন সব মহলই ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও সোচ্চার হয়ে উঠেছে।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে বিশাল ও যুগান্তকারী এক ঘটনা। পাকিস্তানি শাসনামলে পাহাড়সম বৈষম্য, অন্যায় শাসন-শোষণ, অত্যাচার-নির্যাতন, স্বার্থপরতা আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রতিরোধসহ শত রকমের কর্মতৎপরতার সফল পরিণতি নয় মাসের আমাদের গৌরবময় মহান মুক্তিযুদ্ধ। এ অনন্য ঘটনায় দেশের ত্রিশ লাখ মানুষ জীবনদান করেছেন। দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছে। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি, যুদ্ধের স্থায়িত্ব, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা এবং ধ্বংসযজ্ঞ ও অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বিবেচনায় এরূপ ঘটনা ইতিহাসে বিরল।

প্রথমেই মানবতা ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি :

‘গাহি সাম্যের গান-

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিশ্চান।’

জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় ধরনের একটি সংস্কারের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ধর্মবিশ্বাসের গণ্ডির বাইরে মানবতা এবং উদার জাতীয়তাবোধের মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার দীক্ষাটা আমি এ সময়টিতে নিজের জীবনে লালন, ধারণ ও আত্মস্থ করতে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হই। আহা, সে কী প্রাণস্পর্শী ও উজ্জীবনী গান!

‘ছোটদের বড়দের সকলের-

গরিবের নিঃস্বের ফকিরের,

আমার দেশ সব মানুষের ...

হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান

দেশমাতা এক সকলের।’

আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটিও অনুষ্ঠিত হয় তখনই (১৯৭১ সালে)। জাতির এক চরম সংকট, অনিশ্চয়তা ও ঘোর দুর্দিনে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী সংঘটিত অত্যন্ত কঠিন এই অগ্নিপরীক্ষার সময়টিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ধর্ম ও বর্ণ, মত ও পথ, পেশা ও কর্ম, বিশ্বাস-পরিচয়-পরিচিতি ভুলে গিয়ে সর্বস্তরের মানুষ ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে একতাবদ্ধ ও সোচ্চার হয়ে ওঠে। অন্য কোনো ভাবনা ছিল না মনে। পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে এবং কাঁধে কাঁধ রেখে মরণপণ যুদ্ধে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জাগরণ, জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ, দেশপ্রেম ও ভ্রাতৃত্ববোধের এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’; ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ কিংবা তখনকার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি বোধকরি প্রতিটি দেশ-অন্তপ্রাণ মানুষের মনে আজও অনুরণিত হয়। এই অদম্য শক্তি আর দুর্দমনীয় সাহস এবং ঐক্য-চেতনার ওপর ভর করেই আমরা ‘রক্ত ও দুঃখের সাগর’ পাড়ি দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করি। বিশ্বসভায় অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। বিশ্ববাসী নতুন করে পরিচিত হয় লাল-সবুজের একটি সুদৃশ্য পতাকার সঙ্গে। আহা, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে! শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বঞ্চিত-অবহেলিত-শৃঙ্খলিত বাঙালি জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ করে। কিন্তু বলতে ও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সেই গৌরবমণ্ডিত ঐক্য, আনন্দ ও চেতনা স্বাধীনতা লাভের পর আমরা বেশিদিন ধরে রাখতে পারিনি।

‘এই দেশ হিন্দুর না, এই দেশ মুসলমানের না। এই দেশকে যে নিজের বলে ভাববে এই দেশ তার। এই দেশের কল্যাণ দেখে যার মন আনন্দে ভরে উঠবে এই দেশ তার। এই দেশের দুঃখে যে কাঁদবে এই দেশ তার। এবং এই দেশ তাদের, যারা এই দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে।’ আহা, দরদ দিয়ে, বড় আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দায়িত্বশীল একজন অভিভাবকের মতোই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সে কী বলিষ্ঠ ঘোষণা, সে কী আকুল আশাবাদ! এ কারণেই তিনি অনন্য, মহান নেতা।

এই পুণ্যভূমিতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। এ মুহূর্তে জরুরি হলো ক্ষতিগ্রস্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত হিন্দু নর-নারীর মনে যে করেই হোক আস্থা, বিশ্বাস ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনা। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, র‌্যাব মহাপরিচালক- প্রত্যেকেই ঘটনার নিন্দা, দোষীদের গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন। এ আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি যেন অতীতের মতো ‘বাকবন্দি’ হয়ে না থাকে। কেবল আশ্বাস প্রদান নয়, আমরা সংশ্লিষ্ট দুর্বৃত্তদের কঠোর শাস্তির নিশ্চয়তারও বিধান চাই। তাহলেই একের পর এক ঘটনা ঘটাতে ভবিষ্যতে কেউ আর সাহস পাবে না। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ ও তারই উত্তরাধিকার বহনকারী সরকারের কার্যক্রম দেখার অপেক্ষায় আছি।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম