আইন কি সব ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে?
ডা. জাহেদ উর রহমান
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইরফান সেলিমের বাবা হাজী সেলিম সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা এবং সংসদ সদস্য। তার শ্বশুর সরকারি দলের এমপি, শাশুড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান।
লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, জনাব ইরফান নিজে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার। এ দেশের ক্ষমতাসীন দলের এত ক্ষমতাশালী মানুষদের কাউকে এ দেশের আইনের হাত ছুঁতে পারবে, এটা কেউ বিশ্বাস করত না। কিন্তু তিনি একদিন হঠাৎ ঝামেলায় পড়েছিলেন।
ঝামেলাটা কী, সেটা আমাদের এখনো মনে থাকার কথা। সেই ঝামেলার কথা আর পুনরুল্লেখ করছি না। তবে সে ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপগুলো এ কলামের স্বার্থে উল্লেখ করা জরুরি।
রাস্তায় ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার পর থেকেই ইরফান ‘আইনের হাত’ দেখতে শুরু করেন। দেশের সশস্ত্র বাহিনীর একজন সদস্যের সঙ্গে সমস্যায় না জড়ালে এমন কিছু তার জীবনে ঘটত কিনা সন্দেহ।
ঘটনার পরদিন ২৬ অক্টোবর পুরান ঢাকার বড় কাটরায় ইরফানের বাবা হাজী সেলিমের বাড়িতে দিনভর অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত মাদক রাখার দায়ে ইরফান সেলিমকে এক বছর কারাদণ্ড দেন।
ইরফানের দেহরক্ষী মো. জাহিদকে ওয়াকিটকি বহন করার দায়ে দেন ছয় মাসের সাজা। জনাব ইরফানের বাসা থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
এরপর ২৮ অক্টোবর র্যাব-৩ চকবাজার থানায় ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী জাহিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক চারটি মামলা করেন। এ মামলার ভাগ্যে কী ঘটছে সেটা জানার আগে দেখে আসা যাক এই সময়ে ভীষণ আলোচিত আরেকটা মামলার গতিপ্রকৃতি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হয়ে কারারুদ্ধ অবস্থায় মারা গেছেন লেখক মুশতাক। তাই তিনি এবং আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো আবার সামনে এসেছে আমাদের।
গত বছর এ গ্রেফতার এবং মামলাগুলো আমাদের দেশেই শুধু নয়, সমালোচিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার বাংলাদেশ সম্পর্কে মূল্যায়নেও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে এই করোনাকালেও দেশের সাংবাদিক ও নাগরিকদের ওপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক প্রয়োগের বিরুদ্ধে শক্ত সমালোচনা আছে।
গত বছরের ৫ মে র্যাব-৩ রমনা থানায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, মুশতাক আহমেদ, দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া, মিনহাজ মান্নানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারা, ২৫ (১) (খ), ৩১ ও ৩৫ ধারার অধীনে মামলা করে।
তাদের বিরুদ্ধে যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জাতির পিতা, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহামারি করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, তারা রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধ করেছেন।
এদের মামলার সাম্প্রতিক হাল জানার আগে দেখা যাক ইরফান সেলিমের মামলাগুলোর ভাগ্যে কী ঘটছে। পুলিশ তার বিরুদ্ধে দায়ের করা অস্ত্র এবং মাদক মামলার চার্জশিট দেয় গত ৫ জানুয়ারি, যাতে তাকে এসব অপরাধ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
চার্জশিটে আরও কিছু কারণের সঙ্গে বলা হয়, তার বাসা থেকে যে পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়েছিল, সেটি ইরফান সেলিমের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করতে অসৎ উদ্দেশ্যে কে বা কারা রেখে যায়।
অর্থাৎ সেটি তার অস্ত্র ছিল না! তার বিরুদ্ধে মাদক মামলার চার্জশিটেও পুলিশ বলেছে, ইরফান সেলিমের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করতে অসৎ উদ্দেশ্যে কে বা কারা বিদেশি মদ ও বিয়ার তার বাসায় রেখে যায়। অর্থাৎ আমাদের এটা বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে প্রবল পরাক্রমশালী এমপি এবং তার কমিশনার পুত্রের বাসায় এসব রেখে যাওয়ার সাহস আশপাশের মানুষের আছে।
ইরফান সেলিমের বাসায় র্যাবের দলটির অভিযানের সময় যে ভ্রাম্যমাণ আদালত ইরফান সেলিমকে সাজা দেয় সেটি পরিচালনা করেছিলেন অতি আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম।
আমাদের অনেকে স্তম্ভিত হবেন এটা জেনে যে, পুলিশি তদন্তের সময় নাকি জনাব আলম পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
অস্ত্র ও মাদক মামলার চার্জশিট আদালত গ্রহণ করে তাকে এ মামলাগুলো থেকে মুক্তি দিয়েছে। অর্থাৎ ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে বাকি থাকবে একমাত্র মামলা যেটি দায়ের করা হয়েছে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায়।
মামলার গতিপ্রকৃতি বলছে, সেই মামলা থেকেও তিনি হয়তো মুক্ত হয়ে যাবেন। আমাদের হয়তো জানানো হবে এই ঘটনাও ঘটানো হয়েছে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে।
এবার দেখা যাক ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মামলাগুলোর ভাগ্যে কী ঘটেছে। কিছুদিন আগে ওই মামলার চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ যাতে আর সবাইকে মুক্তি দিয়ে আসামি হিসাবে রাখা হয়েছিল কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, লেখক মুশতাক আহমেদ ও রাষ্ট্রচিন্তার কর্মী দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়াকে।
চার্জশিট অনুযায়ী অনলাইনে তাদের ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কর্মকাণ্ডের সাক্ষী করা হয়েছে বাসা, মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষী, পিয়ন, আত্মীয়সহ ছয়জন সাধারণ নাগরিককে।
অভিযুক্ত তিন ব্যক্তি কী ধরনের মুঠোফোন ব্যবহার করতেন, কোন কোন নামে তাদের ফেসবুক আইডি আছে এবং কোন পেজ থেকে ষড়যন্ত্রমূলক পোস্ট দিয়েছেন বা অনলাইনে নিজেদের মধ্যে কী কথা বলতেন, তা-ও এই সাক্ষীরা জানতেন!
গত মাসে আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানা গেছে। এই ছয় সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভাষা হুবহু একই, যদিও এদের পাঁচজনই পত্রিকাকে বলেছেন, এ ধরনের কোনো সাক্ষ্য তারা পুলিশকে দেননি।
পড়লে উদ্ভট মনে হতে পারে, কিন্তু এত আলোচিত মামলাগুলোর ক্ষেত্রে ঠিক এ ঘটনাটি ঘটেছে। এ মামলায় দিদারুলের জামিন হলেও আটক ছিলেন মুশতাক ও কিশোর। এরপর মুশতাকের ভাগ্যে যা ঘটেছে সেটা আমরা সবাই দেখলাম।
গ্রেফতারের পর পুলিশি নির্যাতনে ভয়ংকরভাবে আহত হলেও কিশোরের জামিন হলো মাত্রই। দুর্মুখ নেটিজেনরা যৌক্তিকভাবেই বলছেন, মুশতাক মারা না গেলে কিশোরের জামিন হতো না।
জানি না, পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ দুটি মামলার এ দু’ধরনের গতি দেখে কী বলবেন। এ দুই মামলায় অভিযুক্তরা অপরাধগুলো করেছেন কিংবা করেননি সেরকম কোনো পূর্বানুমান ছেড়ে দিয়েও যদি নিরপেক্ষভাবে চার্জশিটের কথাগুলো আমরা দেখি, তাহলে কি বলা যায় এ মানুষগুলোর বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে এগোচ্ছে?
একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যার কাজের ওপর মানুষের কারাগারে থাকা, শাস্তি পাওয়া, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে সেই প্রতিষ্ঠান পুলিশ কি এ ধরনের চার্জশিটে ন্যূনতম লজ্জাবোধ করে? আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত বাহিনী হিসাবে তারা যে আর সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলাদা, পুলিশ বাহিনী কি সেটা অনুভব করে?
পুলিশ বাহিনী কি এই সচেতনতা সব সময় রাখে যে তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, কোনো দলের নয়?
এ দেশে প্রতিটি সরকারের সময় সরকারের পক্ষ থেকে কতগুলো আপ্তবাক্য শোনা যায়- অপরাধ করলে আইনের হাত থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। বলার চেষ্টা হয় এ দেশে আইন নিজস্ব গতিতেই চলে; সরকার কখনোই তাকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে না।
কথা হচ্ছে, সত্যি সত্যি আইনের নিজস্ব গতি থাকলেই হয় না, আইনটি কেমন, সেটাও এক অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। সেই আলোচনা এ আলোচনায় ঢুকিয়ে এ কলামের কলেবর আর বাড়াচ্ছি না।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি আমরা অল্প কয়দিন পরেই। একটা রাষ্ট্রের জীবনে ৫০ বছর সময়টা যথেষ্ট দীর্ঘ। এ সময়ে একটা গণতান্ত্রিক আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য অতি প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং সেগুলোকে পর্যাপ্তভাবে শক্তিশালী করার কথা ছিল, যেন কোনো সরকার চাইলেও জনগণের সাংবিধানিক এবং আইনি অধিকার নষ্ট করতে না পারে। কিন্তু আমরা দেখছি ঠিক উল্টোটা।
দেশে যখন যে সরকারই ক্ষমতায় থাকে, তখন তার প্রবণতা থাকে নিজের পক্ষের লোকদের অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া আর প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা যে কোনো মূল্যে।
অনেক ক্ষেত্রে ‘আইনের হাত’ থাকে অনেক এবং ভীষণ শক্তিশালী, আর কিছু ক্ষেত্রে আইন একেবারেই ‘হাতহীন’ কিংবা থাকলেও সেই হাত শক্তিহীন, বিকলাঙ্গ।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট