শিক্ষা পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা
ড. এ কে এম মাকসুদুল হক
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২১, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এক বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। গত বছরের ১৭ মার্চ করোনা মহামারির কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে এখন পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। সব ঠিক থাকলে ৩০ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম পর্যায় শুরু হবে।
প্রথম ধাপে পঞ্চম, দশম (পুরোনো) এবং দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। বাকিদের সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন শ্রেণিকক্ষে আসতে হবে। প্রথম ধাপের এ প্রক্রিয়া চালুর পর সামাজিক সংক্রমণ নিয়ন্ত্রিত থাকলে পরবর্তী সময়ে হয়তো ২/৩ মাসের মধ্যে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হতে পারে।
তবে যেভাবেই হোক ৩০ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলো খুলে যাচ্ছে-এটাই দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এতে খুবই আনন্দিত। আর এর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে জড়িত অসংখ্য শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, ক্ষুদ্রব্যবসায়ী এবং অন্য পেশাদাররা অধীর আগ্রহে দিন গুনছে বিদ্যালয়গুলো খোলার জন্য।
ফলে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে শিক্ষাঙ্গনে; কিন্তু শিখন-পঠনে শিক্ষার্থীদের জীবনে যে সমূহ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়বে। তবে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করলে এ শিক্ষা পুনরুদ্ধার করা কিছুটা সম্ভব হবে বলে শিক্ষাবিদরা মনে করেন।
গত এক বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে তিনটি পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। এর মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না হতে পারাটা ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর জন্য বিভিন্ন জটিলতার উদ্ভব হয়েছে এবং এর সামাজিক ও একাডেমিক নেতিবাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী; যা ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীকে মোকাবিলা করতে হবে।
অন্যদিকে কোনো বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের অটোপ্রমোশন দিতে হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা শিখন-পঠনে ঘাটতি নিয়েই পরবর্তী উচ্চতর শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। এতে তাদের শিখনের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে; যা পরবর্তী শ্রেণিতে শিখনে অসুবিধার সৃষ্টি করবে।
সব মিলে সারা দেশে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী এ ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বড় ক্লাসের চেয়ে শিশুদের ক্ষতি বেশি হয়েছে। কারণ, শিশু শ্রেণিতে ‘লার্নিং-এবিলিটি’ বা ‘শিখন সক্ষমতা’ অর্জন না হওয়ায় তারা পুরো একটি বছর পিছিয়েই থাকবে।
দীর্ঘ ছুটির কারণে এ বছর ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রায় এক কোটি শিশু স্কুলে ফিরবে না। আমাদের দেশে এর প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত তাদের বিদ্যালয়ে নাম তালিকাভুক্ত করেনি বা ভর্তি হয়নি।
একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। কারণ, এসব শিশুর পরিবার আর্থিকভাবে অসমর্থ হয়ে পড়ায় তারা এখন আয়-রোজগারের কাজে পিতা-মাতার সহযোগিতায় নেমেছে, যদিও এখন পর্যন্ত এর কোনো জরিপ প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তবে মেয়েশিশুদের বেলায় ঘটেছে বাল্যবিবাহের ঘটনা। এমনিতেই বাল্যবিবাহের ঘটনায় বাংলাদেশে অবস্থান চতুর্থ।
ফলে এরা হয়তো বা আর কখনো স্কুলে ফিরে আসবে না। করোনাকালে সরাসরি শ্রেণি পাঠদান বন্ধ থাকলেও শহরাঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম চালু রেখেছে। তবে গ্রামাঞ্চলে এ সংখ্যা খুবই কম ছিল।
সরকারিভাবেও টেলিভিশন-রেডিওতে দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়া চালু ছিল; কিন্তু ‘ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন’ (সিএএমপিই)-এর ২০২০-২১-এর প্রতিবেদন মোতাবেক ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই এ দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেনি।
অর্থাৎ যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণ নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বাকি ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বিরাট বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে বা ‘লার্নিং গ্যাপ’ তৈরি হয়েছে।
এ ‘লার্নিং গ্যাপ’ শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ভয়াবহ ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া ‘লার্নিং পোভারটি’ পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে হয়। বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ডে ১০ বছর বয়সের শিশু অথবা প্রাথমিক স্তর শেষ করে একজন শিক্ষার্থী যদি সাধারণ বিষয় পড়তে ও বুঝতে না পারে, তবে সে ‘লার্নিং পোভারটি’ বা ‘শিখন দারিদ্র্যের’ অন্তর্ভুক্ত হবে। নিু ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় এর হার ৫৩ শতাংশ।
কিন্তু বাংলাদেশে ‘লার্নিং পোভারটি’ বা শিখন দারিদ্র্যের হার ৫৬ শতাংশ। দীর্ঘদিন ছুটি থাকায় এ শিশুগুলো পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে এ ‘শিখন দারিদ্র্য’-এর হার আরও নিচে নেমে গেছে বলে অনুমান করা যাচ্ছে। তবে এ সময় যারা ‘অনলাইন’ শ্রেণি কার্যক্রমে যুক্ত ছিল তাদের শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা এগিয়ে চললেও তারা অন্য নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
এ সময়ে অনেক শিশু-কিশোর ‘স্মার্টফোন অ্যাপস’-এ আসক্ত হয়ে পড়েছে। অনেকের বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে ‘স্মার্টফোন’-এ সময় দেওয়ার জন্য। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থায় বন্ধ থাকায় দেশের অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন স্কুল অচল হয়ে পড়েছে। অনেক শিক্ষক পেশা বদল করে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে দিন গুজরান করছেন।
ফলে সামনে কয়েক মাসের মধ্যে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে এলে প্রাথমিকের প্রায় পৌনে দুই কোটির শিক্ষার্থীর সবাই স্কুলে স্থান পাবে না। কারণ, আর্থিক কারণে অনেক কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুব সহসাই চালু করা সম্ভব হবে না।
এ করোনাকালীন ছুটি আমাদের দেশের চলমান দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে। ‘ইউএনডিপি’-এর ২০২০ সালের প্রতিবেদন মোতাবেক ‘গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স’ (জিকেআই)-এ বিশ্বের ১৩৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১১২তম। পাকিস্তান ১১১তম, নেপাল ১১০তম এবং ভারত ৭৫তম স্থানে অবস্থান করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ মহামারির কারণে অনলাইন শিক্ষার প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে ‘জিকেআই’-এ আমরা আরও পিছিয়ে পড়তে পারি।
করোনা মহামারিতে দেশের অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্য, সেবা, কৃষি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বিপর্যয় নেমে এসেছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাত এসেছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য প্রায় এক লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। শিল্প, বাণিজ্য, সেবা, কৃষি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সব খাতেই প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। আর বেসরকারি শিক্ষকরা জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে পেয়েছেন।
ইতোমধ্যে সবকিছুই খোলা রয়েছে বা খুলে দেওয়া হয়েছে। সবার আগে খুলে দেওয়া হয়েছে শ্রমঘন গার্মেন্টস শিল্প। খুলেছে যানবাহন, বাজার-ঘাট, স্টেডিয়াম। অনুমোদন পেয়েছে সভা-সমাবেশ, বিনোদন কেন্দ্র আর শপিংমলগুলো। সবশেষে আংশিকভাবে খুলতে যাচ্ছে শিক্ষাঙ্গন। কাজেই দেশে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।
এহেন পরিস্থিতিতে দেশের পতনোন্মুখ শিক্ষাকে পুনরুদ্ধার করতে হলে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণ করতে হবে। দেশকে ‘প্রজন্ম বিপর্যয়’ থেকে রক্ষা করতে হলে অতি দ্রুত সুনির্দিষ্ট আশু, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষা পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ নিতে হবে।
আশু পদক্ষেপের অংশ হিসাবে সরকারি পরিকল্পনা মোতাবেক ৩০ মার্চ বিদ্যালয়গুলো খুলে দিয়ে যথ দ্রুত সম্ভব সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে।
গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো যখন খুলে দেওয়া হয়েছিল, তখন দেশের করোনা পরিস্থিতি মোটেই ভালো ছিল না। সেই তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতি অনেক ভালো। তাছাড়া ইউনেস্কো বলেছে, স্কুলে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায় এমন কোনো প্রমাণ নেই।
প্রথমেই আমাদের বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতিসংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে একটি উপযোগী বস্তুনিষ্ঠ তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে। তারপর সেই সব তথ্য ব্যবহারের মাধ্যমে করোনায় শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
আর গত এক বছরে শিক্ষার হারানো মান ফিরিয়ে আনার জন্য কমপক্ষে পৌনে দুই বছরের (২০২১-২২) একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে ২০২০ সালের শিখন-পঠন থেকে বাদ পড়া শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে হবে।
আগামী চার মাসে (জুলাই ২০২১ পর্যন্ত) গত বছরের পাঠ্যক্রম সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পাঠদান সম্পন্ন করে বাকি ১৭ মাসে (ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত) পরবর্তী দুটি শ্রেণির পাঠ্যক্রম সাজিয়ে নতুন করে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস তৈরি করা দরকার। এ সিলেবাস প্রণয়নের সময় একাডেমিক ক্যালেন্ডারের ছুটি কমিয়ে নিতে হবে।
সাপ্তাহিক ছুটি একদিন করে বিভিন্ন ধর্মীয় বড় বড় উৎসবের কয়েকটি দিন ছুটি রেখে বাকি সব ছুটি বাতিল করে সেখানে শ্রেণি কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। এমনকি অন্যান্য জাতীয় দিবসেও অর্ধদিবস শ্রেণি কার্যক্রম চলতে পারে। এ দিবসসমূহে নানাবিধ প্রতিযোগিতার আয়োজন পাঠ্যক্রমের লেসনভিত্তিক বিষয় রাখা যেতে পারে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক সমাপনী, জেএসসি এবং সমমানের পাবলিক পরীক্ষাসমূহ বাতিল করা প্রয়োজন হবে।
আর শ্রেণি কার্যক্রমের পাশাপাশি অনলাইন দূরশিক্ষণের ব্যবস্থাকেও শিক্ষাক্রমের অংশে পরিণত করতে হবে। সপ্তাহে দুইদিন শ্রেণি পাঠদানের বাইরেও অনলাইনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশেষ পাঠদানে শিক্ষকরা যুক্ত হবেন নির্দিষ্ট সময়ে। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকরাও যুক্ত থাকবেন তাদের সন্তান বা পোষ্যদের পড়ালেখার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য।
তবে এজন্য শিক্ষকদের পরিশ্রম অনেক বেড়ে যাবে বিধায় প্রণোদনাস্বরূপ তাদের অতিরিক্ত সম্মানীর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন হবে।
আর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। প্রাথমিকভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে দুইজন করে শিক্ষককে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষক হিসাবে তৈরি করতে হবে; প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যাপকভাবে সব শিক্ষককে প্রশিক্ষিত করতে হবে বিশেষ পাঠদান দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য।
শিক্ষকদের ‘সৃজনশীলতা’ এবং ‘সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধানের দক্ষতা’ এ দুই পদ্ধতির শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করতে হবে যেন শিক্ষার্থীদের যুগের চাহিদা মোতাবেক আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলা যায়। সিলেবাসে শুধু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো (বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক ও বিজ্ঞান) অন্তর্ভুক্ত রেখে বাকি বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট ভিডিও বা ডকুমেন্টারি চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে।
সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও মনোযোগ রাখতে হবে। মহামারিতে তাদের যথেষ্ট পরিমাণ মানসিক চাপ নিতে হয়েছে। কাজেই শিক্ষক ও অভিভাবক সবাইকেই শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে মৌলিক ধারণা দিতে হবে।
আরও একটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, সেটা হলো এ সময় ‘দূরশিক্ষণ’ ব্যবস্থার কারণে ‘ধনী-দরিদ্র’ বা ‘শহর-গ্রামের’ শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ‘লার্নিং গ্যাপ’ সৃষ্টি হয়েছে তা পুরোপুরি মিটিয়ে ফেলার জন্য সর্বত্র একই প্রণীত সিলেবাস এবং শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি হবে।
করোনায় শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এ খাতে আর্থিক সহযোগিতা। বিদ্যালয়গুলোর ঘুরে দাঁড়ানো, শিক্ষক সমাজের বেঁচে থাকার অবলম্বন, প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা, আইসিটি উপকরণ সহজলভ্যকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলোয় প্রয়োজন প্রচুর আর্থিক বিনিয়োগ এবং প্রণোদনা।
কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের মাত্র ১১.৬৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ৬১.১১৮ কোটি এবং জাতীয় জিডিপি-এর মাত্র ২.১ শতাংশ। অথচ ইউনেস্কোর ন্যূনতম সুপারিশ হলো, তা হতে হবে জিডিপি-এর ছয় শতাংশ। কাজেই অবশ্যই শিক্ষা খাতে আমাদের অর্থ জোগান আরও অনেক বৃদ্ধি করতে হবে।
তার একটা বড় অংশ শিক্ষাসংক্রান্ত গবেষণায় খরচ করা জরুরি। যুগোপযোগী গবেষণা ছাড়া কোনো ক্ষেত্রেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এ গবেষণাকে ফলপ্রসূ করার জন্য প্রয়োজন প্রচুর আর্থিক সহায়তা।
পৃথিবীতে কোনো মহামারিই রাতারাতি শেষ হয়ে যায়নি। করোনাও খুব দ্রুত চলে যাবে না বলেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন। কাজেই এ মহামারি নিয়েই বিশ্বকে চলতে হবে দীর্ঘদিন; কিন্তু দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা যাবে না।
কাজেই গত বছরের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বের হয়ে এসে কী করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যে কোনো পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক রাখা যায়, তার জন্য একটি সমন্বিত জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
ড. এ কে এম মাকসুদুল হক : অধ্যক্ষ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
maksud2648@yahoo.com