বস্তিবাসী শিশুরাও আলোকিত হোক
মো. মাহবুব হাসান শাহীন
প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অনাথ শিশু মাহিম। আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতো আলো ঝলমলে জীবন নয় তার। কষ্টের কশাঘাতে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে তার জীবন পার করতে হয়েছে। নিয়তি তার সহায় হয়নি জন্ম থেকেই, তাই পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকেই পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত সে।
জন্মদাতা পিতা মারা যাননি, তবে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে অন্য একজন নারীকে বিয়ে করে শুরু করেছেন আলাদা সংসার। এত বড় মানসিক আঘাত সহ্য করতে না পেরে শিশু মাহিমকে রেখে জন্মদাত্রী মা একদিন হারিয়ে যান।
এরপর থেকেই নিরুপায় মাহিমের ঠাঁই হয় অভাবগ্রস্ত নানা-নানির সংসারে। মাহিমের তিন বছর বয়সে তার জীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। অভাবের সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী মাহিমের নানা তাদের দুঃখ সাগরে ভাসিয়ে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান। তখন থেকেই মাহিমের একমাত্র আশ্রয় তার নানি।
অসহায় নানি জীবিকার প্রয়োজনে বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তি। কিন্তু ভিক্ষা করে প্রতিদিন দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করা সবসময় সম্ভব হতো না। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত আয়ের জন্য মাহিমকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষা শুরু করেন তার নানি। এতে আয়-রোজগার কিছুটা বাড়ে। কিন্তু সেটাও শুধু খেয়েপরে কোনোরকমে বেঁচে থাকার মতো।
মাহিম আরেকটু বড় হলে এই আয়েও চিড় ধরে। বাধ্য হয়ে মাত্র সাত বছর বয়সে সে পাড়ার কাপড়ের দোকানে পরিষ্কার-পরিছন্নতার কাজ নেয়। দারিদ্র্যের কশাঘাতে পিষ্ট মাহিমের অন্ধকার জীবনের আরও একটি বছর এভাবে কাটতে থাকে। নেই শিক্ষা, নেই আশ্রয়, নেই মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। অন্ধকারে যখন তলিয়ে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ করেই ২০১৭ সালে আলোর দেখা পেল মাহিম। সে ২০১৭ সালে সরকার পরিচালিত রস্ক (রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন) প্রজেক্টের বরিশাল পলাশপুর আরবান স্লাম আনন্দ স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়।
বর্তমানে সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। মাহিম বড় হয়ে একজন ডাক্তার হতে চায়। চায় মানুষের মতো মানুষ হতে। ফিরে পেতে চায় হারিয়ে যাওয়া বাবা ও মাকে। চায় তাদের ভালোবাসার আলিঙ্গন। আর মাহিমের নানি চান তার নাতি যেন পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হয় এবং ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে পারে।
সারা দেশে এরকম অসংখ্য মাহিম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সবার জীবনে চলার পথ হয়তো এক নয়। তবে তাদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র কিন্তু অভিন্ন। তাদের স্বপ্নহীন জীবনে নতুন স্বপ্ন পূরণে এরকম অসংখ্য শিশু-কিশোরের পাশে আস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে আরবান স্লাম চিলড্রেন এডুকেশন (ইউএসসিই) প্রোগ্রাম।
রস্ক প্রকল্প ফেইজ-২ একটি সরকারি (জিওবি) পদক্ষেপ, যার লক্ষ্য গ্রামীণ উপজেলার স্কুলবহির্ভূত শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার দ্বিতীয় সুযোগ প্রদান করা। রস্ক ফেইজ-২ প্রকল্প সব পর্যায়ের শিক্ষায় প্রবেশাধিকার, গুণগতমান ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করতে পিইডিপির প্রচেষ্টার পরিপূরক হিসাবে কাজ করছে এবং এসডিজি-৪ (একীভূত এবং সমমর্যাদা ও মানসম্পন্ন শিক্ষা) অর্জনে অবদান রাখছে। এছাড়াও আরবান স্লাম চিলড্রেন এডুকেশন এবং প্রি-ভোকেশনাল ট্রেনিং প্রোগ্রাম স্কেল অ্যাপের মাধ্যমে এসডিজি-৮ (সবার জন্য যথাযথ চাকরি এবং উপযুক্ত কাজ) অর্জনে সহায়তা করছে।
এই পাইলট কর্মসূচির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক সেভ দ্য চিলড্রেনকে কারিগরি সংস্থা (টিএ) হিসাবে এপ্রিল ২০১৪ থেকে জুন ২০১৬ পর্যন্ত রস্ক প্রকল্পে নিয়োগ করে। পরবর্তী সময়ে কর্মসূচিগুলোর সফলতা ও শিখনের ভিত্তিতে রস্ক ইউনিট আরবান স্লাম চিলড্রেন এডুকেশন (ইউএসসিই) প্রোগ্রামের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
এ শিক্ষা কর্মসূচি ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সের বস্তিবাসী সেই সব শিশুকে টার্গেট গ্রুপ হিসাবে গ্রহণ করেছে, যারা কখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি অথবা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রক্রিয়া থেকে ঝরে পড়েছে। প্রকল্পে যোগ্য শিশুদের চিহ্নিত করতে সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাড়ি পরিদর্শন, শিশুদের পিতামাতা ও কম্পাউন্ড ম্যানেজমেন্ট কমিটি (সিএমসি) সদস্যদের সঙ্গে সভা করা হয়েছে। বস্তি এলাকার প্রতিটি কম্পাউন্ডে ৪ থেকে ৮টি এলসি, অফিস কক্ষ, শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য চাইল্ড ক্লাব স্থাপন করা হয়।
প্রতিটি এলসিতে ২৫-৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রাখা হয়। কোনো কারণে কোনো শিক্ষার্থী ঝরে পড়লে প্রথম ৩০ দিনের মধ্যে শিক্ষার্থী রিপ্লেসের সুযোগ রাখা হয়। এখানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত প্রাথমিক শিক্ষাক্রম অনুসরণে তিন বছরের অ্যাক্সিলারেটেড শিখন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হয়। এ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি ৬ মাস অন্তর এবং ১২ মাসে ৫ম শ্রেণির একাডেমিক কার্যক্রম শেষ করা হয়। এতে বিপুলসংখ্যক ঝরে পড়া শিশু সরকারের শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে।
এ ছাড়াও রস্ক প্রকল্প ফেইজ-২-এ ২০১৩ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত ১৪৮টি গ্রামীণ উপজেলায় ঝরে পড়া ও স্কুলবহির্ভূত ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী মোট ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৫৫৬ জন শিক্ষার্থীকে ২০ হাজার ২৩৯টি শিখন কেন্দ্রে (এলসি) উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা চক্রের আওতায় আনা হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রি-ভোকেশনাল দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় ইতোমধ্যে ৫৭টি উপজেলায় ১৬ হাজার ৫০০ জন কিশোর-কিশোরীকে তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
বর্তমানে কক্সবাজার জেলার ৮টি উপজেলায় এবং বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৮ হাজার ৫০০ জন কিশোর-কিশোরীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত কক্সবাজার জেলায় আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দেড় লাখ শিশুকে ইউনিসেফের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ভাষায় এনটিএফ নীতিমালার আলোকে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে তিনবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, যা ২০১৩ সালে শুরু হয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যায়।
শেষ কথা হলো, শিক্ষাবঞ্চিত ছিন্নমূল বস্তিবাসী শিশুদের জন্য এটি একটি সীমিত পরিসরের ব্যবস্থা হলেও অসংখ্য অসহায় শিশুকে দেখিয়েছে আশার আলো, দিয়েছে নতুন জীবন।
মো. মাহবুব হাসান শাহীন : সরকারি কর্মকর্তা (উপসচিব)