
প্রিন্ট: ০১ মে ২০২৫, ০৫:০৪ এএম
তর্জনীর অগ্রভাগে ছিল দ্রোহের ভাষা

ড. এম এ মাননান
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
১৯৭১। এ বছরটি শুধু একটি বছর নয়। নিজেই একটি ইতিহাস। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস, উদ্ভবের ইতিহাস, এক সাগর রক্তের ইতিহাস, ত্রিশ লাখ জীবনদানের ইতিহাস, দুই লাখ সম্ভ্রমহানির ইতিহাস, এক কোটি শরণার্থীর ইতিহাস, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জনযুদ্ধের ইতিহাস। সে ইতিহাসেরই একটা উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে আছে বাঙালির মাথা উঁচু করার আরেকটি ইতিহাস। সে ইতিহাস জন্ম নিয়েছে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে, একটি বটবৃক্ষের কাছাকাছি স্থানে একটি সাদামাটা ডায়াসের ওপরে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বুকে ধারণ করা আপন মাটির টানে ঘর ছেড়ে আসা লাঠি-বৈঠা হাতে দশ লক্ষাধিক উদ্বেলিত শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-শিক্ষকসহ আপামর জনতার সামনে।
এ ইতিহাসের সময়টা ছিল ৭ মার্চ, রোববার, বিকাল তিনটা-সাড়ে তিনটা। ইতিহাসের রচয়িতা তৎকালীন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, জনমানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই পাওয়া অসীম বাগ্মিতায় সব শ্রেণির মানুষের চিত্ত জয়কারী সোনার বাংলার নতুন ইতিহাস তৈরির নায়ক টুঙ্গিপাড়ার এক সিংহহৃদয় যুবক, যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সেদিন মঞ্চে এলেন, দক্ষিণমুখী মঞ্চে ঋজুভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কালো চশমাটি বক্তৃতা-স্ট্যান্ডের ওপর রেখে তর্জনী ঊর্ধ্বে তুলে বিশাল মানব-সাগরের দিকে তাকিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে যেন গেয়ে উঠলেন ‘ভায়েরা আমার ...’। কথা তো নয়, যেন আকাশে-বাতাসে কম্পন তুলে একটি আদর-মধুর ডাকে উপস্থিত সবাইকে কাছে টেনে নিলেন। তারপরই শুরু হলো মাত্র ১৯ মিনিটের বিশ্বজয় করা অমিয় ভাষণ, যা বিশ্ব-ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে পরবর্তী সময়ে সম্পূর্ণ আপন মহিমায়।
ইউনেস্কো ভাষণটিকে স্থান করে দিয়েছে বিশ্বের বিখ্যাত সব ভাষণের পাশে। ঋজুভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা সে মানুষটির অটল তর্জনী থেকে বেরিয়ে আসা ‘উল্লাস’ কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছে প্রায় সব দেশে। বিশ্ববাসী জানতে পারছে সেই ঐতিহাসিক তেজোদীপ্ত ভাষণের মর্মবাণী। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার জন্য কীভাবে দৃপ্ত শপথ নিতে হয় অকল্পনীয় বাগ্মিতায় দেশের আপামর মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, তা বুঝতে পারছে বিশ্বের মানুষ। বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ তোলার সুযোগ না দিয়ে কীভাবে অসাধারণ কৌশল খাটিয়ে স্বাধীনতার আহ্বান জানাতে হয়, তা জেনে অবাক হচ্ছে পৃথিবী।
ভাষণটি এমনি এমনি বিশ্ব-ইতিহাসে স্থান পায়নি। এটি সম্ভবত একদিনের ভাবনাও ছিল না। এটি ছিল তাৎক্ষণিক অলিখিত ভাষণ। তবে এক-দুদিনের চিন্তা-চেতনা থেকে উৎসারিত নয় এ ভাষণের মর্মবাণী। এটি ছিল সারা বাংলার জনগণের মাঝে থেকে তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদেরই একজন হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মহানায়কের পঁয়ত্রিশ বছরের অধিক কাল ধরে রাজনৈতিক জীবনের প্রজ্ঞার ফসল। বিশ্বপরিমণ্ডলে আদৃত এ ভাষণ; ভাষণ দেওয়ার খাতিরে দেওয়া ভাষণ নয়। এতে ছিল এ দেশের পোড় খাওয়া মানুষের প্রতি শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে একটা কঠিন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতির আহ্বান, স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান, মুক্তির লড়াইয়ে যা কিছু করা দরকার তা করার জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান। এ ভাষণই এনে দিয়েছে মুক্তি, পূর্ববাংলার মানুষদের চিরকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ২০২১ সাল থেকে এ দিবসটিকে ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চ দিবস’ হিসাবে পালনের সরকারি ঘোষণা দেশবাসীর অনেক আশার মধ্যে একটি আশাকে অনেক দেরিতে হলেও পূর্ণ করেছে। আমার মতো যারা এ ঐতিহাসিক ভাষণের দিন সমাবেশে উপস্থিত থেকেছে, তা প্রত্যক্ষ করেছে এবং যারা এ ভাষণের কারণে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘরে ঘরে জনযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং ‘গাজী’ হয়ে ফিরে এসে এখনো জীবিত রয়েছে, তারা নিশ্চয়ই আনন্দে অভিভূত হয়েছে। এ উদ্যোগটির জন্য ভাষণদাতা, স্বাধীনতার ঘোষক ও রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি জানাই অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। তারই চৌকস নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক বর্তমান সরকারকে জানাই অনেক সাধুবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই, তাহলে দেখব- চেয়ারবিহীন মঞ্চে দাঁড়ানো একজন মাত্র ব্যক্তি একক বক্তৃতা দিচ্ছেন। মনে হয়েছে যেন কথার মালা গাঁথছেন, কথার পিঠে কথা রেখে কথার মালা গেঁথে লাখ লাখ লোকের সমাবেশে পিনপতন নীরবতার মধ্যে কথার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন। বিমুগ্ধ মানুষ এক মনে শুনছেন। এতে ছিল না কোনো গৎবাঁধা সম্বোধন, ছিল না বাহুল্য ভূমিকা। এটি ছিল একক বক্তার গণহৃদয় জয় করার ভাষণ, শোষক-শাসকদের পায়ের তলায় কম্পন ধরানোর মতো আগুনঝরা ফুলকি। ছিল স্বৈরাচারী শাসকদের প্রতি শহরে-বন্দরে নিরীহ বাঙালি হত্যা বন্ধের কঠোর হুঁশিয়ারি। ছিল বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতি প্রয়োজনে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান।
রেসকোর্স ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে মঞ্চের সামনে বাঁশ দিয়ে ঘের দেওয়া জায়গাটির একটু বাইরে বসে যখন শুনছিলাম এ ভাষণটি, তখন মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ঊর্ধ্বে তোলা তর্জনী নিজেই কথা বলছে- তর্জনীর ভাষায় যেন ফুটে উঠছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, ক্ষোভের উত্তাপ। যেন বাক্সময় হয়ে উঠেছে উত্তাল দ্রোহ। সেই উত্থিত তর্জনী ছিল একাত্তরের প্রতীক, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল না বলা অনেক কথার ঝঙ্কার। কারও কাছে যদি মনে হয়, সেই তর্জনীর শিরজুড়ে ছিল ‘সংক্ষুব্ধ সময়ের চিহ্ন’, তা কী করে করব অবিশ্বাস? এ অঙ্গুলির শির থেকে যেন ঝরে পড়ছিল শব্দের উচ্ছ্বাস, শাসকদের বাংলার মাটি থেকে বিলীন হয়ে যাওয়ার সতর্ক সংকেত। তর্জনীর শির জানান দিচ্ছিল জনযুদ্ধের প্রস্তুতির, তীব্র সংগ্রামের আহ্বান আর দ্রোহের সুনামি সৃষ্টির সংকেত।
যে নাম ঠাঁই নিয়েছে আজ আকাশের গায়ে, যে নামের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের স্বাধীনতার বহমান নদী, একাত্ম হয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস। যে নাম হাজার মাইল দূর থেকে আসা স্বৈরশাসকদের ভিত করে দিয়েছে টলটলায়মান, সে নামটি সব অর্থেই সমকক্ষ স্বাধীনতার; সে নামটিই স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই নামের মানুষটির তর্জনী বহন করে একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোর অবিস্মরণীয় স্মারক। ২০২১-এর ৭ মার্চে বিনীত গর্বের সঙ্গে জাতি পালন করছে সে তর্জনী থেকে উৎসারিত অনুপ্রেরণার জন্মদাতার ভাষণ দিবস। অনাগত দিনগুলোয় প্রতিটি ৭ মার্চ পালিত হোক বিনম্র শ্রদ্ধায়, জাতির পিতার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতায়, যার তর্জনীর সঙ্গে একাকার হয়ে আছে এবং থাকবে বাংলাদেশের বিজয়নামার ইতিহাস। তার উঁচু করা তর্জনী চিরকাল হয়ে থাকুক আমাদের সবার মাথা উঁচু করা গৌরবময় বিজয়ের গগনে হেলান দেওয়া আকাশচুম্বী মিনার হয়ে। প্রতিটি ৭ মার্চে হোক বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর তৈরি ‘বঙ্গমিনার’-এর আহ্বান। প্রতি মার্চের সপ্তম দিনে একাত্তরের ৭ মার্চের জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ শব্দ তুলুক সব বাঙালির হৃদয়ে, জাগিয়ে তুলুক সেই উত্তাল-ভয়ঙ্কর দিনগুলোর মর্মকথা।
এ দিবসটি এখন থেকে পালিত হবে প্রতিবছর। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানবে বছরের পর বছর ধরে; যতদিন থাকবে এ দেশ-এ ভূমি ধরার বুকে, ততদিন জানবে সবাই এ দেশে এক মুকুটহীন রাজা ছিলেন, যিনি একটি মাত্র ভাষণের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষকে দেশমাতৃকার জন্য জীবন দিতে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। জয় করে নিয়েছিলেন সবার হৃদয়। তারা জানবে- তিনি রাজা-বাদশাহ হওয়ার জন্য জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করেননি, তিনি ক্ষমতার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার লোভে জীবনের সোনালি দিনগুলো কারান্তরালে বিসর্জন দেননি, তিনি শুধু বাংলার নিঃস্ব-বঞ্চিত-শোষিত মানুষগুলোকে শোষণ থেকে মুক্তি দেওয়ার ‘লোভে’ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বৈরশাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাকে স্মরণ করে প্রতিটি ৭ মার্চে অকুণ্ঠচিত্তে সবাই গেয়ে উঠবে- ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
ড. এম এ মাননান : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়