Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

লোভের অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার শুভ লক্ষণ নয়

Icon

এম এ খালেক

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লোভের অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার শুভ লক্ষণ নয়

শাব্দিক অর্থ যাই হোক না, ‘লোভ’ বলতে আমরা বুঝি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করা, যা আমার জন্য মোটেও ন্যায়সংগত নয়। অর্থাৎ, নীতিগতভাবে আমার পাওয়ার কথা নয় বা পাওয়া উচিত নয়; কিন্তু আমি তা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করি-এমন অবস্থাকেই লোভ বলা যেতে পারে। মানুষের মাঝে প্রচণ্ড লোভের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

অন্য কোনো প্রাণী বা জীবের মধ্যে লোভের উপস্থিতি তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। মানুষ একমাত্র প্রাণী, যে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে; কিন্তু মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা যখন লোভের ধারক-বাহক হয়ে ওঠে তখনই বিপদ ঘটে।

আমরা কী দেখছি? সরকার যখনই কোনো পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যায়, তখনই বাজারে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। এক শ্রেণির অতিলোভী ব্যবসায়ীর কারণে সরকারি সব পদক্ষেপ অকার্যকর হয়ে পড়ে। আমাদের মতো দেশের বাজারব্যবস্থার ওপর সরকারের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।

এমনকি মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক রীতি অনুসরণ করেও বাজার চলছে না। বাজার চলছে এক ধরনের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। তাই দেখা যায়, এক এক সময় বিভিন্ন পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। আমরা সাধারণ পেঁয়াজ ৩০০ টাকা কেজি দরে খেয়েছি। এটা কি কোনো দিন আমরা কল্পনা করেছি? কর্তৃপক্ষীয় পর্যায় থেকে প্রায়ই বলা হয়, বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই।

তাদের এ বক্তব্য মোটেও ঠিক নয়। কিছুদিন আগে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বললেন, ভারত থেকে ট্রাক আসতে অসুবিধা হচ্ছে বলেই বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো পাগলেও এটি বিশ্বাস করবে না। আমাদের দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ীর মধ্যে নৈতিকতার অভাব রয়েছে। ফলে তারা বাজার থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতে পারছেন।

যেমন, বাজারে কোনো একটি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে তারা পণ্যটির মূল্য বাড়িয়ে দেন। নতুনভাবে আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে এ মূল্যবৃদ্ধি মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু যে পণ্যটি আগে থেকেই ব্যবসায়ীদের স্টকে রয়েছে, সেই পণ্যের মূল্য কেন বাড়বে? এক নীতিবান ব্যবসায়ী কখনো আগে থেকে স্টকে থাকা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করতে পারেন না।

যখন কোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায়, তখন একজন সৎ ব্যবসায়ীর উচিত হবে স্টকে থাকা পণ্য দ্রুত বাজারে ছেড়ে দিয়ে ভোক্তাসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবের চেষ্টা করা; কিন্তু আমাদের দেশে এর উলটোটিই প্রত্যক্ষ করা যায়। কোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেলে ব্যবসায়ীদের অনেকেই সংশ্লিষ্ট পণ্যটি বাজার থেকে তুলে নিয়ে বেশি মূল্য পাওয়ার আশায় তা স্টক করে রাখেন।

দার্শনিক জন লক বলেছিলেন, সরকার যদি সুদের হার কমিয়ে দেয় তাহলে ঋণদানকারী ব্যক্তি বা সংস্থাগুলো ভিন্ন পথে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। এমনকি ঋণ সংকোচন নীতিও গ্রহণ করতে পারে।

সরকার বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ যদি বাজার চাহিদা এবং জোগানের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে ঋণের সুদহার কমিয়ে দেয়, তাহলে যে প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা জন লক অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আমরা বর্তমানে কী দেখছি? আমাদের দেশে এখনো জন লকের থিউরি বিদ্যমান বাস্তবতা। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এক নির্দেশনাবলে ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশে নির্ধারণ করে দেয়।

একইসঙ্গে আমানতের ওপর প্রদেয় সর্বোচ্চ সুদহার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের বেলায় ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ ৯/৬ বলে বহুল আলোচিত।

ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের উদ্যোক্তা/মালিকরা ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন সময় নানা দাবি আদায় করে নেন। আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মোট আমানতের ২৫ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা যেত; এখন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের চেয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আমানত সংরক্ষণ করা হলে সুদের হার দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। এটা করা হয়েছে এ জন্যই যে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বেশি মুনাফা পাওয়ার আশায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে বেশি বেশি করে আমানত সংরক্ষণ করে।

এখানে একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানসিক আচরণের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি মুনাফা পাওয়ার আশায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণ করবেন, কর্তৃপক্ষ এটাই ধরে নিয়েছেন। এখানে এক ধরনের লোভের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু মানুষের স্বাভাবিক আচরণে নীতি-নৈতিকতার চেয়ে লোভ বেশি কাজ করে।

এর ফলে তারা প্রায়ই প্রতারণার শিকার হন। বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীনে অসংখ্য ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তারা উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে উদ্বৃত্ত অর্থের মালিকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান মাসে ১০/১২ শতাংশ হারে মুনাফা দিয়ে থাকে। প্রতিমাসে ১০ শতাংশ হারে মুনাফা দিলে প্রতিবছর ১২০ শতাংশ মুনাফা দিতে হয়।

এ লোভের বশবর্তী হয়ে অনেকেই এসব প্রতিষ্ঠানে আমানত সংরক্ষণ করেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বেশিরভাগই প্রতারণার শিকার হন। তারা প্রতারিত হয়ে সরকারের প্রতি দোষারোপ করে থাকেন; কিন্তু সরকার কি একবারও এ ধরনের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে আমানত সংরক্ষণের জন্য কাউকে প্রভাবিত করেছে? যারা এসব নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে আমানত সংরক্ষণ করেন তারা কি একবারও ভেবে দেখেন না, বাংলাদেশে কি এমন কোনো প্রতিষ্ঠান আছে, যারা বছরে ১২০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে?

আমরা ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে কী দেখলাম? একশ্রেণির বাজার-খেলুড়ে নানা কৌশলের মাধ্যমে শেয়ারবাজারকে এমনভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুললেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ১০০ টাকার শেয়ার ১০ হাজার টাকায় কিনতেও দ্বিধা করেননি।

তারা একবারও ভেবে দেখলেন না, ১০০ টাকার শেয়ার ১০ হাজার টাকায় কিনলেও কোম্পানিটি যখন লভ্যাংশ দেবে তখন তারা শেয়ারের ফেস ভ্যালুর ওপর ভিত্তি করেই লভ্যাংশ দেবে।

লভ্যাংশের সঙ্গে বোনাস দেওয়া হতে পারে; কিন্তু সব মিলিয়ে সেটা কোনোভাবেই ১০ হাজার টাকার সমপরিমাণ হবে না। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে নীতি বা বাস্তবতার চেয়ে লোভের উপস্থিতিই বেশি প্রবল।

বাংলাদেশ ব্যাংক যখন ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তখন ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তারা বেশ খুশি হয়েছিলেন; কিন্তু কিছুদিন যেতে-না-যেতেই তাদের সেই খুশির আবেগ ধুলোয় লুটিয়ে গেল। অভিযোগ উঠেছে, অধিকাংশ ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিলেও নানা অজুহাতে হিডেন চার্জ আরোপ করে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে।

কোনো কোনো ব্যাংক ঋণ সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে। বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে; কিন্তু তারা ঋণ দিচ্ছে না। অথচ করোনাকালীন আর্থিক ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশে এখন ঋণের চাহিদা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য আছে। উদ্যোক্তাদের ঋণের চাহিদা আছে; কিন্তু ব্যাংক কাক্সিক্ষত মাত্রায় ঋণ দিচ্ছে না বা উদ্যোক্তারা তাদের প্রয়োজনীয় ঋণের সংকুলান করতে পারছে না।

সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করার আগে আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম তাদের কস্ট অব ফান্ড হচ্ছে সোয়া ৮ শতাংশ। ঋণ প্রদানযোগ্য তহবিল তৈরিতে যাদের সোয়া ৮ শতাংশ ব্যয় করতে হয়, তাদের পক্ষে কি ৯ শতাংশ সুদে ঋণ প্রদান করা সম্ভব?

সরকার এসএমই সেক্টরের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজে ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কটেজ অ্যান্ড স্মল ইন্ডাস্ট্রিজকে যুক্ত করে এসএমই ঋণের সংজ্ঞায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন থেকে কটেজ অ্যান্ড মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ সহযোগে এসএমই সেক্টরের নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)। এ আইনি সংস্কারের ফলে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তাদের পক্ষে এসএমই খাতের মতো প্রাতিষ্ঠানিক ঋণপ্রাপ্তির দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদের এক সভায় এসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জামানতবিহীন ঋণদানের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এতে নারী উদ্যোক্তাদের পক্ষে ব্যাংক ঋণ পাওয়া সহজ হয়েছে। এসবই খাতা-কলমে রয়েছে; বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অধিকাংশ ব্যাংক পারতপক্ষে এসএমই খাতে ঋণ দিতে চান না। নারী উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আরও অবহেলিত।

তাদের নানাভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের জন্য নিরুৎসাহিত করা হয়। এমন সব ডকুমেন্টস চাওয়া হয়, যা তাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণের চেয়ে বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন।

যদিও সেখানে সুদের হার অনেক বেশি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা উচ্চ সুদহার নিয়ে চিন্তিত নন। তারা সময়মতো প্রয়োজনীয় ঋণ পেতে চান। এ কারণেই দেখা যায়, ব্যাংক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণ বিতরণ করতে না পারলেও এনজিওগুলো ঠিকই ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করছে। এনজিওগুলোর দেওয়া ক্ষুদ্রঋণ আদায়ের হারও ব্যাংকিং সেক্টরের যে কোনো ঋণের চেয়ে বেশি।

এটি সম্ভব হচ্ছে মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, এনজিওগুলোর মনিটরিং সিস্টেম অত্যন্ত নিবিড় এবং কঠোর। আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। তারা চাইলেই ঋণের টাকা আটকে রাখতে পারেন না। অবশ্য তাদের নৈতিকতাবোধও বড় এবং ইচ্ছাকৃত বৃহৎ ঋণখেলাপিদের চেয়ে উত্তম। আমাদের দেশে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ পেতে হলে রাজনৈতিক এবং আর্থিক ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। আবার ঋণখেলাপি হতে হলেও এ দুটি ক্ষমতার বড়ই প্রয়োজন।

এম এ খালেক : অর্থনীতি বিশ্লেষক, সাবেক ব্যাংকার

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম