দেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব
প্রণব মজুমদার
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে শীতকালে করোনার প্রকোপ বাড়বে, এটি অনেকদিন ধরেই আলোচনার মধ্যে রয়েছে। এর ফলে অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়তি চাপ সামলাতে হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ এখনও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো চরম পর্যায়ে পৌঁছেনি। তবে তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এখনও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। মানুষের জীবন না অর্থনীতি-কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত-এ প্রশ্নটিও অনেকদিন ধরেই আলোচনার মধ্যে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই থেকে তিন শতাংশে নেমে যেতে পারে। অথচ অর্থবছরের শুরুতে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এরইমধ্যে দেশে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নানা অজুহাতে চলছে কর্মী ছাঁটাই। হোটেল, রেস্তোরাঁ, দিনমজুরসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মতৎপরতা সেভাবে স্বাভাবিক হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনায় লকডাউনের কারণে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল এ এক মাসে অর্থনীতিতে ১ লক্ষাধিক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর ওই সময় কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দেশে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রতিদিন ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
বিআইডিএসের অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এ করোনার কারণে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখন আর অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, করোনার শেষ সম্পর্কে আমরা এখনও ধারণা করতে পারছি না। ক্ষতির পরিমাণ, জিডিপির ক্ষতি এখন যা বলা হচ্ছে তা প্রজেকশনের ভিত্তিতে। বাস্তবতা হতে পারে আরও ভয়াবহ।’
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দু’ভাবে ভাগ করা যায়। একটি হল কৃষি খাত, আর অন্যটি হল অকৃষি খাত। কৃষি খাতকে বলা যায় ভিত্তি কাঠামো এবং অকৃষি খাতকে বলা যায় উপরি কাঠামো। কৃষি খাতের অবস্থা কী? কৃষি খাতে প্রধান দুটি ফসল ধান ও গম উৎপাদন ব্যাহত হয়নি; বরং তা ভালোই উৎপাদন হয়েছে। অন্যদিকে করোনার মধ্যে কিছু ক্ষেত্র যেমন: দুধ উৎপাদন, হাঁস-মুরগির খামার ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
২০১৮ সাল পর্যন্ত সর্বশেষ জিডিপির তথ্যে দেখা যায়, কৃষি খাতের অবদান ১৩.০৭ শতাংশ, শিল্প খাতের অবদান ২৮.৫৪ শতাংশ এবং পরিষেবা খাতের অবদান ৫২.৯৬ শতাংশ। প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষি খাতের অবদান এত কম হওয়া সত্ত্বেও এটিকে এত গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কী কারণ আছে? তার অনেক কারণ আছে যেমন, পেঁয়াজের সরবরাহ ঘাটতির সময় এমনভাবে বাজার অস্থিতিশীল করা হয়েছে, যা দিয়ে দেশে একটি হাহাকার তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে যদি চাল-আটার সরবরাহের সামান্য ঘাটতি তৈরি হয়, তাহলে আমাদের দেশের অসাধু ব্যবসায়ীসহ কিছু মানুষ মিলে অল্পদিনের মধ্যে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে তা অনুমান করা যায়। সরকার এটি উত্তমভাবে বুঝতে পেরেছে এবং এ বিষয়ে নানা রকম পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
ঔষধ শিল্পে উৎপাদন এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক ছিল। তবে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে পড়েছিল পরিষেবা খাত। তবে এ খাতের সব ক্ষেত্র একরকম প্রভাব পড়েনি। যেমন, বেসরকারি হাসপাতাল খাত প্রচুর ব্যবসা করেছে, আবার অনেক ডাক্তার করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে বেশ কিছুদিন চেম্বারেও বসেননি। আবার বিক্রয়-বিপণন খাতের একটি অংশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। এ জন্য সে খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনায় লকডাউনের সময়ও পাড়া মহল্লার মুদিদোকানের মতো প্রতিষ্ঠান সীমিতভাবে ব্যবসা করেছে। শহর এলাকায় এটি প্রধান ব্যবসা না হলেও গ্রাম এলাকায় এটিই প্রধান ব্যবসা। এ ছাড়া ওই সময় তৈরি পোশাক খাতসহ বিভিন্ন শিল্প খাত নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বিভিন্ন শিল্প খাতের ওপর নির্ভরশীল উপখাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির অতি ক্ষুদ্র অংশ যদি কৃষি খাত হয়, তাহলে এ খাতের ইতিবাচক দিক দিয়ে কি গোটা অর্থনীতিকে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে? এ খাতে মোট কর্মসংস্থান হয় প্রায় ৩৮ শতাংশ। ধান গম ছাড়াও ইতোমধ্যে অনেক অর্থকরী ফসল যেমন: কমলা, মালটাও দেশে চাষ হচ্ছে। তাই দেশের কৃষি খাত যত ক্ষুদ্র হোক না কেন, তা হচ্ছে খোরাকি অর্থনীতি। এখনও মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ বাদ দিলে আর বাকি সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ খাত দ্বারা উপকৃত হয়। তার চেয়ে বড় কথা, এ স্থায়ী সম্পদ থাকার কারণে মানুষ আর্থিকভাবে অনেক বেশি নিরাপদ মনে করে।
দেশে প্রায় এক কোটি পরিবার প্রত্যক্ষভাবে রেমিটেন্সের আওতায় রয়েছে। যাদের মধ্যে প্রায় ৭-৮ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরেছেন। তারা যে সবাই কপর্দকহীন হয়ে ফিরেছেন, এ কথা বলা যাবে না। রেমিটেন্সের প্রবাহ তুলনামূলক এখনও ভালো আছে; যা তাদের পরিবারকে আর্থিক নিরাপত্তা দিচ্ছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন সন্তোষজনক। মিডিয়ায় রেমিটেন্স কমার কথা এক সময় যেভাবে আলোচনা করা হয়েছিল সেভাবে কমেনি।
চলতি অর্থবছরের সাড়ে তিন মাসে ৭৯৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা; যা গত অর্থবছরের পুরো সময়ে আসা রেমিটেন্সের প্রায় অর্ধেক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, অক্টোবর মাসের প্রথম ১৫ দিনে ১২২ কোটি ৭৮ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ১৫ দিনে ৮০ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন তারা। আর পুরো অক্টোবর মাসে এসেছিল ১৬৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার।
বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা আভাস দিয়েছে- এ বছর প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশের বেশি হবে না। যদি তাই হয় মন্দ কী, এটি মাইনাস না হলেই ভালো। তাহলে বড়সংখ্যক ব্যক্তির অবস্থা তেমন খারাপ হবে না। তবে এটা সত্য, সব মানুষের ওপর এর প্রভাবে একই রকম পড়বে না। দেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র পেশাদার গোষ্ঠী রয়েছেন, যারা নিঃসন্দেহে আর্থিক সংকটে রয়েছেন। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে করোনার কী প্রভাব পড়বে, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে; তা বোঝার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
প্রণব মজুমদার : গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক এবং অর্থকাগজ সম্পাদক
writerpranabmajumder@gmail.com