অনলাইন শিক্ষাদান নিয়ে ভাবনা
এমএম শহিদুল হাসান
প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২০, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কোভিড-১৯ মহামারী বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ঐতিহ্যগতভাবে ক্লাসরুমে শিক্ষাদান করান। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিকট ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সম্ভাবনা না থাকার কারণে অনেকটা নিরুপায় হয়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। দুটি মুখ্য কারণে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই অনলাইনে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে।
দীর্ঘ সময় পড়াশোনা থেকে দূরে থাকলে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং তাদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর ক্যাম্পাসে ফিরে নাও আসতে পারে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি একাডেমিক কার্যক্রম শুরু না করে তবে তাদের ছাত্ররা টিউশন ফি, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্থপ্রাপ্তির প্রাথমিক উৎস, প্রদান করবে না। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক সংকটে পড়বে এবং তারা শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি দিতে পারবে না।
ছাত্রদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন অনলাইনে পড়ানোর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে। প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করে ক্লাসরুম পড়ানো থেকে অনলাইনে পাঠদান শুরু করা শিক্ষকদের জন্য অবশ্যই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা অনলাইন প্লাটফর্ম ও টুলস দিয়ে পড়ানোই অনলাইন শিক্ষা নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু পাঠদানের মাধ্যমে জ্ঞান সঞ্চালন করাই শ্রেণিকক্ষে বা অনলাইনে শিক্ষাদানের মূল উদ্দেশ্য নয় এবং শেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, উচ্চ-দক্ষতা ও উচ্চ চিন্তা করার ক্ষমতা এবং উদ্ভাবনী গুণ অর্জনে সহায়তা করাই শিক্ষাদানের মূল উদ্দেশ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়ে শিক্ষার্থীরা কিভাবে উল্লেখিত গুণাবলী অর্জন করতে পারে এ ব্যাপারে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন পুরনো শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করে Outcome Based Education (ওবিই) গ্রহণ করেছে। এই পদ্ধতিটি অনেকটা ডাক্তারের রোগী দেখার মতো। ডাক্তার প্রতি রোগী আলাদাভাবে দেখেন এবং রোগ অনুসারে প্রেসক্রিপশন দেন। কোর্স শিক্ষক তার কোর্সে কিছু লার্নিং আউটকাম নির্ধারণ করেন এবং তাকে অবশ্যই শিক্ষণ এবং শেখার ক্রিয়াকলাপে এমন কৌশল প্রয়োগ করতে হবে যাতে প্রত্যেক ছাত্র শেখার ব্যাপারে উদ্দীপিত হয় এবং লার্নিং আউটকামগুলো অর্জন করতে পারে।
ইউজিসি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষাক্ষেত্রে ওবিই গ্রহণ করতে বলেছে। দেশে খুব কমসংখ্যক শিক্ষকের ওবিই বিষয়ে ধারণা আছে। অনলাইনে ওবিই শিক্ষাদান ও ছাত্রের মূল্যায়ন পদ্ধতি সনাতন পদ্ধতিতে শিক্ষাদান ও মূল্যায়ন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মনে রাখতে হবে, সঠিক প্রস্তুতির অভাবে অনেক দেশ সফলভাবে ওবিই বাস্তবায়ন করতে পারেনি। শিক্ষকদের ওবিই সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন।
শিক্ষকদের জানতে হবে কীভাবে অনলাইন ক্লাসে শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় এবং ছাত্রদের মূল্যায়নের জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোও। মনে রাখতে হবে, ক্লাসরুম পড়ানোর জন্য প্রণীত সিলেবাস দিয়ে অনলাইন শিক্ষণ করানো হয় না। অনলাইন শিক্ষার চাহিদা অনুসারে কোর্সগুলো প্রণয়ন করতে হয়।
অনলাইন শিক্ষণ বেশিদিন স্থায়ী হবে না ভেবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন শিক্ষণকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু ইন্টারনেটে সহজলভ্য অনলাইন প্লাটফর্মগুলো ব্যবহার করে কয়েকটি সেমিস্টার শেষ করার কথা ভাবতে পারে। এটি মানসম্পন্ন শিক্ষায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সঠিকভাবে অনলাইন শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিনা ইউজিসি তা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইন শিক্ষাদান, শিখন ও মূল্যায়নের বিষয়ে একাধিক কর্মশালার আয়োজন করতে হবে যাতে শিক্ষকরা অনলাইন শিক্ষাদান, শিখন এবং ছাত্রদের কোর্স পারফরম্যান্স মূল্যায়ন ক্ষেত্রে সফল হতে পারেন। প্রশিক্ষণে শুধু অনলাইন সরঞ্জাম শেখার ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত নয়।
অন্যদিকে, অনলাইন শিক্ষাদান, বিশেষ করে পরীক্ষার সময় নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন। শহরের বাইরে যেসব ছাত্র থাকে তাদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়কে নিতে হবে অথবা অন্য কোনো সমাধান বিশ্ববিদ্যালয়কেই বাতলাতে হবে। বিশ্বের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেণিকক্ষে পাঠদান পরিচালনা করে এবং তারা তাদের অফিসের কাজ, প্রাপ্তবয়স্ক ও আর্থিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য প্রশিক্ষণ, শর্ট কোর্স ইত্যাদির জন্য লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এলএমএস) সফটওয়্যার ব্যবহার করে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি এ ধরনের সফটওয়্যারভিত্তিক লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার এড়াতে পারে?
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত অনলাইন কোর্স, যা ম্যাসিভ, ওপেন, অনলাইন (MOOCs) নামে পরিচিত, বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এমআইটি ও স্ট্যানফোর্ড তাদের অনুষদ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য লার্নারের জন্য অনলাইন কোর্স পরিচালনা করে। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন- আরবান স্টাডিজ, ভ্যালুজ ও পাবলিক লাইফ, টিচার প্রিপারেশন, টেকনোলজি ও সোসাইটি, ক্রিয়েটিভ রাইটিং, এনট্রোপেনিওয়রশিপ সার্টিফিকেট কোর্স অফার করে থাকে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এক্সিকিউটিভ লিডারশিপ, ডিপ্লোমা ইন গ্লোবাল বিজনেস, হিস্টোরি অব ইকোনমিক থট, ডিপ্লোমা ইন ফাইন্যানসিয়্যাল স্ট্র্যাটেজি ইত্যাদি প্রোগ্রাম সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করছে।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে পারে না, তাই তারা তাদের সম্প্রদায়গুলোর জীবন ও পেশাগত অগ্রগতির লক্ষ্য অর্জনে নানা ধরনের অ্যাডভান্সড ডিগ্রি এবং এক্সিকিউটিভ এডুকেশন বিনামূল্যে অনলাইনে পরিচালনা করে থাকে। কন্টিনিউইং এডুকেশন বিভাগ এবং একাডেমিক বিভাগগুলো অনলাইন প্রোগ্রামগুলো পরিচালনা করে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে এ ধরনের প্রোগ্রাম পরিচালনা করতে পারে।
মানুষের স্বভাব হল সময় ব্যয় করে যা শিখেছে তা ব্যবহার করা। তাই অনুমান করা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার যখন খুলবে, শিক্ষকরা ক্লাসরুমে শিক্ষকতায় ফিরে এলেও তারা কিছু কোর্স অনলাইনে পড়াতে চাইবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি তাদের কথা শুনবে? আন্তর্জাতিকীকরণের এই যুগে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিন্নভাবে চলা যৌক্তিক হবে না।
অনলাইন শিক্ষাদান ও শেখার জন্য, অনলাইন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজিং, প্রতিদিনের আর্থিক হিসাব-নিকাশ ইত্যাদি কাজের জন্য মূল্যবান সফটওয়ারের প্রয়োজন হবে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে অনলাইনে শিক্ষা এবং অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করার কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সফটওয়ারের ব্যবহার বাড়বে এবং বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করবে।
এমএম শহিদুল হাসান : উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
vc@ewubd.edu