গণমাধ্যম ও গণতান্ত্রিক সমাজ
অমিত রায় চৌধুরী
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২০, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিবর্তনের স্রোতে ভেসে মানবসভ্যতা সামনের দিকে এগিয়েছে। জীবনকে উপভোগ্য ও অর্থবহ করার ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই।
সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের ধারণাও মানুষের কল্যাণকর ভাবনার চমকপ্রদ উদ্ভাবনী। রাজতন্ত্র থেকে আধুনিক গণতন্ত্র- প্রবৃত্তিগত জোটবদ্ধতার অনুকূলে মানুষের নিরন্তর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এ এক পর্যায়ক্রমিক উত্তরণ।
গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র- আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কাঠামো ক্রমাগত যুক্তিগ্রাহ্য, মানবিক ও শ্রেয়তর করার অব্যাহত প্রচেষ্টার মাঝেই নিহিত আছে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে মানুষের চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা।
জনমানসে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে নাগরিকতাবোধ, জনমনে ক্রমশ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে সার্বভৌমত্বের ধারণা। আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের পাশে যুক্ত হয়েছে গণমাধ্যম; যা কার্যত রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছে। গণতান্ত্রিক অনুশীলনের সংস্কৃতিতে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা, নতুন গতি।
মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার ইউরোপে নবজাগরণের সূচনা ঘটিয়েছে। উনিশ শতকে বিজ্ঞানের এ অর্জন সংবাদপত্রের ইতিবৃত্তে আধুনিকতার উদ্বোধন ঘটায়। চীনে হাতে লেখা খবরের কাগজের চল থাকলেও ইউরোপ-আমেরিকা এমনকি ভারতবর্ষেও সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে এ শতকেই।
সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে সংবাদপত্র নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। মানুষের ভাবনা, চিন্তা, ধর্ম, রাজনীতি, আদর্শের বাহনে পরিণত হয় এ প্রিন্ট মিডিয়া। ‘মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ শব্দবন্ধটি নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করে।
ঔপনিবেশিক আমল এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সংবাদপত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রাধান্য সুস্পষ্ট ছিল। তবে এ কথাও সত্য যে, সরকার বা সরকারবিরোধী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা বা জনমত সংগঠনে সংবাদপত্রের প্রচ্ছন্ন বা প্রবল ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে যুগ নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তান শাসনামলে দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, জনপদ, অবজারভার যেভাবে বাঙালির অন্তর্গত চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়েছিল; গণমাধ্যমের মহত্ত্ব, সক্ষমতা ও জনসম্পৃক্ততা যেভাবে একটি জাতিসত্তার বিকাশে ইতিহাস-নির্ধারণী ভূমিকা রেখেছিল, তা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জয় বাংলা, বাংলার বাণী, সংগ্রামী বাংলা, মুক্তবাংলা, জাগ্রত বাংলার মতো অনেক পত্রিকা কখনও মুক্তাঞ্চলে, কখনও প্রবাসে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী জনতাকে যেভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল; উত্তাল মুক্তিকামী জনতাকে জাতীয়তাবাদী জনউচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত করেছিল- তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
মাতৃভূমির মুক্তির জন্য শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, সিরাজউদ্দিন হোসেন বা গোলাম মুস্তফার মতো মহৎপ্রাণ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের মহান আত্মত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। আর এ জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথে শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে আত্মবলীদানের এ বিরল দৃষ্টান্ত একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধের প্রকৃতি, ব্যাপ্তি ও চরিত্র সম্পর্কে অনাগত সময়ে সমাজ গবেষকদের কৌতূহলী উপাদান জুগিয়ে চলবে- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
কেতাবি ধারণা বলে- একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা কতটা গণতান্ত্রিক, কতটা বিরুদ্ধমত সহনীয়, তা পরিমাপের মাপকাঠি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক চর্চাকে নিশ্চিত করতে হলে মতের বহুত্ব, পথের বিবিধতা, আচরণিক বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান দেখাতে হলে, গণমাধ্যমের মুক্ত ও নিরাপদ পরিসর অপরিহার্য। সমালোচনা বন্ধ হলে গণতন্ত্র সৌন্দর্য হারাবে, বিকল্প তথ্যপ্রবাহ চালু হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। তাই সরকার শুধু ভিন্নমতকে সহ্য করবে তা নয়, প্রতিস্পর্ধী কণ্ঠকে নিরাপত্তাও দেবে। গণতন্ত্রের এই প্রহরীকে (ওয়াচ্ ডগ) রক্ষা করা জীবন্ত (ভাইব্র্যান্ট) সমাজের অস্তিত্বের জন্য ভীষণ জরুরি। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সামরিক, ধর্মভিত্তিক এমনকি গণতান্ত্রিক সরকারও কখনও কখনও মুক্তচিন্তার প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে। অগণতান্ত্রিক চিন্তার বিকাশকে উৎসাহিত করেছে, ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। ১৯৭৫-এ মানবসভ্যতার কলঙ্কজনক স্খলন, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করা বা প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের উত্থানকে নিরুৎসাহিত করায় গণমাধ্যমের ভূমিকাকে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় মনে হয়েছে। অথচ বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী সামাজিক মনস্তত্ত্ব নির্মাণে গণমাধ্যমের প্রত্যক্ষ অবদান থাকবে- এটি কাম্য, প্রত্যাশিত ও কাঙ্ক্ষিত।
বিগত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অকল্পনীয় উন্নতির ফলে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল ও রেডিওর মতো গতানুগতিক সংবাদমাধ্যমের পাশে জায়গা দখল করে নেয় সাইব্যানেটিকস; গড়ে ওঠে বিশাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, মেসেঞ্জার, ই-মেইলের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সংযুক্ত হওয়া যায় এক লহমায়। শুধু শ্র“তিমাধ্যমে নয়, দৃশ্যমাধ্যমেও মানুষ মানুষের সঙ্গে যুক্ত।
সংযুক্তির এ অভিসার ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে যায় অবলীলায়, স্বচ্ছন্দে। কিন্তু বিজ্ঞানের এ অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রায় বিপত্তি ঘটিয়ে ফেলে ফেক নিউজ কিংবা পোস্ট ট্রুথ-র আগ্রাসন। ডিজিটাল সংস্কৃতিতে যে কোনো মানুষ নিজের মতামত একটি কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের সাহায্যে প্রকাশ করতে পারে। সামাজিক মাধ্যমে প্রহরী বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট মতামত, নিবন্ধও আপামর জনসাধারণের সামনে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। কৃত্রিম সত্যের ধারণাটি হল- একটি অনভিপ্রেত পরিস্থিতি যেখানে প্রকৃত সত্যকে বাতিল করা হয় ও ব্যক্তিগত মতামত এবং আবেগনিষ্ঠ ধারণাকে প্রাধান্য দেয়া হয়।
এ পরিস্থিতিতে জনমতও এ আরোপিত সত্যের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। সামাজিক মাধ্যমের নেতিবাচক এ শক্তি সমাজের ওপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলতে পারে। সত্যকে বিকৃত করে, এক শ্রেণির মানুষের বিশ্বাস ও সমষ্টিগত ধারণাকে বদলে দিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়ে যায়।
বাবরি মসজিদ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি দৈনিকের উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রকাশ, ফেসবুকে মিথ্যা স্ট্যাটাস দিয়ে রামু বৌদ্ধমন্দিরে হামলা, যুদ্ধাপরাধী বিচার চলাকালে বা শাপলাচত্বর ঘটনায় ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত সংবাদ পরিবেশন বা ফেক ছবি সুপার ইম্পোজ করার মতো সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক সক্ষমতার এমন অনেক দৃষ্টান্ত এ সমাজে থেকে গেছে। পরিবর্তিত এ সামাজিক বাস্তবতা সমাজমননে মৌলিক কিছু কাঠামোগত পরিবর্তনের দাবি রাখে। ভুয়া খবরের মনস্তত্ত্বই হল পক্ষপাতদুষ্ট লক্ষ্যভেদ করে সমাজে ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজন সৃষ্টি বা দূরবর্তী কোনো উদ্দেশ্য অর্জন করা। সে কারণে যে পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন করে- তার ওপরই বর্তায় অপরিসীম দায়িত্ব মানুষকে শিক্ষিত করার, সংবেদনশীল করার; সজাগ রাখার।
তবে রহস্যময় মানবমনের অলিগলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টুকরো টুকরো প্রবৃত্তির সঙ্গে পরিচিত থাকাটাও জরুরি। আর প্রবৃত্তির এই তাড়নায় মানুষ এমন কিছু আচরণ করে, যা ব্যাখ্যাতীত। মানুষ সেই খবরগুলোকেই গ্রহণ করে, যা তারা গ্রহণ করতে চায়। এভাবে নিজেদের অজান্তে ও অগোছালো ভাবনার প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা মতামতকেই তারা পুষ্ট করে চলে নীরবে, নিভৃতে। নিজের আবেগের কাছে নিজের পরাজয়কেই নিত্য নিশ্চিত করে চলে। মানুষের জৈবিক প্রবণতার আরেকটি মজার দিক হল- পাঠক, বিশেষ করে বাঙালি পাঠক বা শ্রোতা অনেকেই বস্তুমুখী সৎ খবর পছন্দ করে না। নিজের পছন্দের কাগজ থেকে নিজ মতাদর্শ সমর্থনের পাথেয় জোগাড় করে নেয়। কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে ন্যারেটিভ কী হবে, তা বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ধারণা, মত ও গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই তৈরি করতে চায়। বিশ্লেষণ বস্তুনিষ্ঠ হলেও মতের মিল না ঘটলে পাঠক তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এখানেই চ্যালেঞ্জ এসে যায় নিরপেক্ষ গণমাধ্যমের টিকে থাকার প্রশ্নে। একদিকে প্রিন্ট উপকরণের ব্যয়বৃদ্ধি, সংকুচিত বিজ্ঞাপনের বাজার অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার পপুলিস্ট উল্লম্ফন। অন্যদিকে, সাংবাদিকতার পেশাগত নৈতিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার মতো উচ্চমার্গীয় মূল্যবোধকে আঁকড়ে থাকার চ্যালেঞ্জ। এ পরিস্থিতিতে সস্তা জনপ্রিয়তা বা মুনাফার আশায় পত্রিকা আপস বা সমঝোতা করলে সমষ্টিগত ধারণার গতিমুখ পাল্টে যায়। এক পর্যায়ে পাঠক বস্তুনিষ্ঠতার অভাবে পত্রিকা পাঠে আগ্রহ হারায়। সমাজের তাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়ে যায়। পরিস্থিতিকে সামাল দেয়া রাষ্ট্রের জন্যও তখন কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে এ দেশের ইতিহাসে গণমাধ্যমের রুখে দাঁড়ানোর দৃষ্টান্ত বিরল নয় বা শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময়ই তা সীমাবদ্ধ ছিল না। পাকিস্তান শাসনামলে মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দিয়ে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি উসকে দেয়া হয়। এ সম্ভাব্য মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালামসহ তারকাতুল্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’- তৎকালীন একাধিক শীর্ষ জাতীয় দৈনিকে এমনই আবেগঘন বলিষ্ঠ উচ্চারণ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিলকে সত্যি সত্যিই রুখে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ভাষা শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কালজয়ী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি’ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে নিকট অতীতেও আমরা দেখেছি- কল্যাণকর ভাবনায়, জাতীয়তাবাদী চেতনায়, সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিকতায় সত্যকে তুলে ধরতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন এসএম আলাউদ্দিন, সাইফুল আলম মুকুল, শামসুর রহমান, গৌতম দাস, মানিক সাহা ও হুমায়ুন কবির বালুর মতো প্রবাদপ্রতিম সংবাদকর্মী।
গণমাধ্যম, গণতন্ত্র ও বিদ্যমান সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে যখন আলোচনা করছি, ঠিক তখনই দেশের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক যুগান্তর তার ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে। সঙ্গত কারণেই এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা সমীচীন বলে মনে হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়া জগৎ এখন দেশি-বিদেশি রেডিও টিভি চ্যানেলের দখলে। আর গোটা গণমাধ্যমের পরিসর জুড়ে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ার একচ্ছত্র দাপট।
এমন বাস্তবতায় প্রিন্ট মিডিয়া কার্যত নিষ্প্রভ, কোণঠাসা। বিশ্বজনীন বিচরণ ক্ষেত্র, সহজ প্রবেশগম্যতা, সহজলভ্যতা ও তথ্য জগতের সঙ্গে পাঠকের সার্বক্ষণিক সংযোগ মিডিয়া জগতে এ মাধ্যমের শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করেছে। দেশে এখন সংবাদপত্রের আকার বর্ধনশীল। তবে গুণে-মানে শীর্ষ জাতীয় দৈনিক হাতেগোনা কয়েকটি। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে একটি পত্রিকার সগৌরবে টিকে থাকার নজিরও এ দেশে খুব বেশি নেই। তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে চলা, পেশাদারিত্ব প্রমাণ করা এবং জনমানসে নিরপেক্ষতার ধারণাকে বাঁচিয়ে রাখা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য বিষয়। বিশেষ করে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে, নানা মাত্রায়, মুক্তমনে, নির্মোহ দৃষ্টিতে কোনো বিষয়কে বিশ্লেষণ করার সততা, সাহস ও পেশাদারিত্ব যুগান্তরের আছে- অন্তত এমন ধারণা পোষণ করার যথেষ্ট যুক্তি আছে বলেই মনে হয়।
নিরপেক্ষতার ধারণা আপেক্ষিক এবং তা বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শ্রেণিভিত্তিক সূচকের ওপর নির্ভরশীল। নৈতিক দৃঢ়তা ও সত্যের সঙ্গে নিবিড় সখ্যই তথ্য পরিবেশনে নিরপেক্ষ মান অর্জনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে। এ নৈতিক স্থিতি সহজবোধ্য; কারণ যে ঘটনাকে ভিত্তি করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়, তাকে স্থায়ীভাবে আড়াল করা সম্ভব নয়। কিন্তু সংবাদ উপস্থাপন, অগ্রাধিকার নিরূপণ, গুরুত্ব আরোপ বা নিউজ আইটেম বাছাই করার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে পত্রিকার নীতিগত কৌশল; সততা কিংবা দায়িত্বশীলতার অঙ্গীকার। এই কাজটি বর্তমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সহজ নয়। সে প্রেক্ষাপটটি যুগান্তরের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
আর সেক্ষেত্রে বলা যায়, তাৎক্ষণিক সংবাদ পরিবেশন ও বস্তুনিষ্ঠতার এ পরীক্ষায় যুগান্তর উত্তীর্ণ। স্থূলদৃষ্টিতে যা ধরা পড়ে, তা হল- বিদ্যমান রাজনীতি ও আদর্শগত বিভাজনের ধারায় বিভক্ত ভিন্ন মেরুতে অবস্থানরত মানুষের আস্থাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে এ পত্রিকাটি।
এ কারণে বিভিন্ন সময় এ প্রতিষ্ঠানটিকে নানা বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে- বিষয়টি সহজে অনুমান করা যায়। একথা ভাবার সঙ্গত কারণ আছে যে, যুগান্তরের সংবাদ পরিবেশন, বাছাই বা সংবাদ বিশ্লেষণ বিভিন্ন মত-পথ, গ্রাম-শহরের পাঠকদের কাছে গ্রাহ্য হচ্ছে।
সমকালীন বিশ্বব্যবস্থা, ভূ-রাজনীতি, জটিল আর্থ-সামাজিক সমীকরণ; সর্বোপরি, প্রযুক্তির জয়োৎসবের যুগে একটি মানসম্পন্ন সংবাদপত্রের টিকে থাকা যথেষ্ট গৌরবের, সম্মানের, সাফল্যের। প্রত্যাশা থাকবে- যুগান্তর তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, অনন্য অর্জন ও নৈতিক উৎকর্ষ নিয়ে এগিয়ে যাবে অনন্তের পথে কালের স্রোত বেয়ে; গণমানুষের আস্থা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে।
অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ
principalffmmc@gmail.com