মাউশির নেতিবাচক ভাবমূর্তি ঘোচানো হোক
মাছুম বিল্লাহ
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২০, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
১৩ জানুয়ারি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ অডিটোরিয়ামে ই-নথিবিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সম্পর্কে মানুষের মাঝে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। এমনকি আমারও নেতিবাচক ধারণা রয়েছে।’ শিক্ষা ভবনে অবস্থিত মাউশি অধিদফতরের এ বদনাম ঘোচানোর তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ছিলেন। মাউশির মহাপরিচালকও ছিলেন। সারা দেশের ১২০টি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, আইসিটি শিক্ষক ও কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষা সচিব বলেন, দেশের এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না, যে পরিবারে একজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী নেই। আমার পরিবারেও আছেন। যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে নেতিবাচক কথা বেশি হয়, মাউশি অধিদফতর তার একটি। যদিও এটি অনেকের কাছে কষ্টদায়ক হতে পারে। তিনি এ কথাগুলো বলেছেন এ জন্য যে, যেসব অধ্যক্ষ ওখানে উপস্থিত হয়েছিলেন তারাই ডেপুটেশনে কিংবা বদলি হয়ে কিংবা পদোন্নতি পেয়ে শিক্ষা ভবনে, শিক্ষা বোর্ডে, এমনকি মন্ত্রণালয়ে স্থান করে নেন। তাদের দ্বারাই সংঘটিত হয় এসব সেবা না দেয়ার নজির, অর্থের বিনিময়ে অবৈধ অনুমোদন, পোস্টিং ইত্যাদি কত কী।
শিক্ষা ভবনে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর রয়েছে। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী তথা শিক্ষিত মানুষের রয়েছে নেতিবাচক ধারণা। শিক্ষা অধিদফতর ও ডিআইএ’র মহাপরিচালক, পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রয়েছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজের শিক্ষকরা। আর ইইউডিতে রয়েছেন প্রকৌশলীরা। সচিব বলেন, বদনাম নিয়ে এখানে ঢুকেছি, যাওয়ার আগে আমি পজিটিভ ফিডব্যাক চাই। আমার আত্মীয়স্বজন বলবেন, শিক্ষা ভবন বদলে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মুজিববর্ষে অন্তত একটি সেবার মান বাড়ানো বা নতুন সেবা চালু করার আহ্বান জানান তিনি।
সচিব আরও বলেছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব পদে অর্থাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এই তার প্রথম দায়িত্ব। এর আগে এখানে কোনো দায়িত্ব তিনি পালন করেননি। তিনি বলেন, ‘আমি এক সময় ছাত্র ছিলাম। শিক্ষকরা আমাকে পড়িয়েছেন। যাদের কারণে আমি আজকের মাহবুব হোসেন, সেই শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করার বিরল সুযোগ পেয়েছি। এ সুযোগ আমি কাজে লাগাতে চাই। হয়তো সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না। তবে সব সমস্যার প্রতি আমি সংবেদনশীল থাকব।’ অত্যন্ত টাচি ভাষা ব্যবহার করেছেন, টাচি কথা বলেছেন জনাব মাহবুব। শিক্ষকদের আজ যে অবস্থা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের যে মর্যাদা তাতে এখন কেউ আর শিক্ষক হতে চান না। সেই শিক্ষকদের তিনি সম্মান দেখিয়ে কথা বলেছেন, এ মন্ত্রণালয়ের জন্য কিছু করতে চেয়েছেন। এটি একটি বিরাট বিষয়। তিনি অন্তত বলেছেন, সাহস দিয়েছেন, সাহস দেখিয়েছেন, সত্যি কথাগুলো বলেছেন। আমরা পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এসব পদের কর্মকর্তা শুধু মন্ত্রণালয়, বড় বড় হোটেলে মিটিং আর বিদেশ ভ্রমণ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। জনগণের কাজ করার সময় তাদের কোথায়? তারা সরকারের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকেন; কিন্তু যাদের জন্য ওই পদে বসা, তাদের কাছ থেকে শত শত মাইল কিংবা যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করেন।
মাননীয় সচিব কিছুটা হলেও বলেছেন, মাউশির মতো প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্টরা কোনো সেবা পান না। এখানে যারা আসেন তারা সবাই শিক্ষক, দেশ ও মানুষ গড়ার আসল কারিগর তারাই সেবা পান না। একইভাবে কিংবা আরও দুরবস্থা রাষ্ট্রপরিচালিত জনগণের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। ধরুন, এ দেশের এক লাখ মানুষ বিদেশে থাকছেন যাদের শ্রমে-কষ্টে, যাদের সাফল্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল। পাসপোর্ট তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু পাসপোর্ট নামক অফিসে গেলে মনে হবে, আমরা কলোনির কোনো বাসিন্দা, প্রভুদের কাছে সেবার জন্য এসেছি। আর তারা অপেক্ষা করেন প্রতিটি দাড়ি-কমায় আপনাকে-আমাকে হয়রানি করার জন্য, বিপদে ফেলার জন্য, অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য। পাসপোর্ট নেয়ার জন্য আপনাকে বাইরের খোলা জায়গায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে রোদ, বৃষ্টি কিংবা শীতের মধ্যে। মনে হয়, কলোনির বাসিন্দারা রিলিফের মাল নিতে এসেছেন। তার আগের ও পরের যে করুণ চিত্র, সেগুলো সম্পর্কে সবাই জানেন শুধু সরকারে বা বড় বড় পদে যারা আছেন, তারা টের পান না। তারা সবাই যেহেতু এ কষ্টগুলো ভোগ করেন না, তাই তারা এ বিষয়ে কোনো কথাও বলেন না। জনগণকে সর্বদাই রাষ্ট্রের এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সেবার পরিবর্তে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, কষ্ট করেই তাদের প্রাপ্য নিতে হয়। ব্যতিক্রম দেখলাম, শিক্ষা সচিব অন্তত জনগণের কথা কিছুটা হলেও বলেছেন।
দেশের দূরদূরান্ত থেকে হাজারও সমস্যা নিয়ে সম্মানিত শিক্ষকরা বহু কষ্ট করে, বহু সময় ও অর্থের অপচয় করে মাউশিতে আসেন, মন্ত্রণালয়ে আসেন। কিন্তু যার সঙ্গে তারা দেখা করতে আসেন, তার দেখা হয়তো পাঁচ-সাতবার এসেও পান না; কারণ তারা মিটিং নিয়ে আর বিদেশে যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এতে সেবাপ্রার্থীরা সেবা পান না, দফতরের কাজ দিনের পর দিন পেছাতে থাকে, জট লেগে থাকে, সমস্যার পাহাড় সৃষ্টি হয়, সর্বত্রই দেখা যায় অদক্ষতার ছাপ আর বাম হাতের কাজ; যারা করেন তাদের হয় পোয়াবারো। এভাবেই চলছে সব দফতর, অধিদফতর আর মন্ত্রণালয়। কোনো সেবাপ্রার্থী কখনও একবারে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত কর্মকর্তাকে তার চেয়ারে পাবেন না, পেলেও তাকে সময় দেয়া হবে না। পাবেন কীভাবে? তারা যে অন্য গ্রহের বাসিন্দা। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলের আমলাতন্ত্রের সঙ্গে এর তফাত কি আছে? তফাত আছে মানের দিক দিয়ে, বর্তমানে সেবার মান অনেক নিু। সেবার কথা শুধু কাগজে আর টেলিভিশনের পর্দায়, বাস্তবে সরকারি অফিসে সেবার মান আগের চেয়ে অনেক নিচে। আরেকটি পার্থক্য আছে, সেটি হচ্ছে ঘুষ বিনিময়ের হার আগের চেয়ে অনেক বেশি। সেবাপ্রাপ্তির এসব অফিসে মাসের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন কিংবা সপ্তাহের একদিন যদি নির্দিষ্ট করা থাকে, কর্মকর্তারা কোনো মিটিংয়ে যাবেন না, অফিসে থাকবেন শুধু সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাহলে কিছুটা কাজ হতে পারে। সরকারি এসব অফিসে বাথরুম ব্যবহার করার মতো অবস্থা কোথাও নেই। বাথরুম আছে ঠিকই; কিন্তু ব্যবহার করার মতো নয়। দেশের দূরদূরান্ত থেকে ভিজিটররা আসেন অথচ বাথরুম ব্যবহার করার মতো অবস্থা নেই, কোথাও এক টুকরো সাবান নেই, হাত ধোয়ার তোয়ালে নেই। বাথরুমের দুর্গন্ধে সেখানে প্রবেশ করা দায়। স্বাধীনতা লাভের অর্ধ শতাব্দী হতে চলল, আজও এসব বিষয় ঠিক হল না। কবে ঠিক হবে? কবে আমরা মানুষকে, একে অপরকে সম্মান করতে শিখব?
অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শিক্ষা সচিব বলেন, একটি সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিলে এর বিরোধিতায় আরেকটি গ্র“প সোচ্চার হয়ে ওঠে। অনেক সময় বাধা সৃষ্টি করতে আদালতের দ্বারস্থ হয়। এ দেশের বাস্তব কথাগুলো সচিব অকপটে বলেছেন, তাই তাকে জানাই অজস্র ধন্যবাদ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনে সৎ পরামর্শ চান তিনি। দায়িত্ব পাওয়ার দুই সপ্তাহের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নতুন সচিব আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি ১ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছি। এ ১৩ দিনে যারাই আমার কাছে এসেছেন, তারা শুধু তাদের স্বার্থের কথাই বলেছেন। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কেউ কথা বলেননি। এটি খুব কষ্টের। অথচ শিক্ষার উন্নয়নে সৎ পরামর্শ দরকার।’ চমৎকার কথা বলেছেন সচিব মহোদয়। মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদে বসে সাধারণ মানুষের কথা সব জানা যায় না। তাই তাদের প্রয়োজন হয় সৎ পরামর্শের। সেটি তারা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পেতে পারেন, যারা তার কাছে বিভিন্ন দাফতরিক কাজে যান তাদের কাছ থেকে পেতে পারেন। তারা পেতে পারেন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে। দেশে ভার্চুয়ালি যেহেতু কোনো বিরোধী দল নেই, তাই দেশের সমস্যার কথা, বিভিন্ন অসঙ্গতির কথা বলার কেউ নেই। কোনো সরকার কখনোই তার নিজের ব্যর্থতার কথা অর্থাৎ জনগণের কষ্টের কথা কখনও বলে না, বলবে না। ভুক্তভোগী হন জনগণই। সরকারে যারা থাকেন নির্বাচিত হওয়ার পর কিংবা নির্দিষ্ট হওয়ার পর তারা জনগণের কাছ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থান করেন। তারা যাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন, তারা আসল জনগণ নন। তারা নিজ দলের সুবিধাভোগী কিছু লোক। তাই জনগণের কষ্ট থেকেই যায়।
নিজের স্বার্থের কথা না বলে সবার স্বার্থের কথা বলার জন্য আহ্বান জানিয়ে সচিব বলেন, ‘আমি শিক্ষা মন্ত্রণালেয় এসেছি মাত্র ১৩ দিন হল। এর মধ্যে একজনও এসে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেননি। যারা এসেছেন তারা ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও স্বার্থ নিয়ে কথা বলেছেন। আমি কালেক্টিভ ইন্টারেস্ট নিয়ে কাজ করতে চাই। আমাকে কিছুটা সময় দেন। আমি চেষ্টা করব। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই, শুনতে চাই।’ তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা পরিবর্তন না আনলে দেশ পরিবর্তন হবে না। কেননা, আপনারাই দেশকে তৈরি করেন। শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হলে শিক্ষকদের অবস্থারও পরিবর্তন হবে।’ অজস্র ধন্যবাদ সচিব মহোদয় সত্য কথা বলার জন্য, দেশবাসীর সমস্যার কথা অন্তত বোঝার জন্য এবং অনুভব করার জন্য। এ কথাগুলো আমরা তো কাউকে বোঝাতেই পারছি না, উন্নয়নের জোয়ারে সবাই এসব কথা ভাসিয়ে নিয়ে যান। আমরা সাধারণ মানুষ আসলে কিসের জোয়ারে যে ভাসছি, তা নিজেরাই বুঝতে পারছি না!
মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক
masumbillah65@gmail.com