জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
তো ফা য়ে ল আ হ মে দ
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২০, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাঙালি জাতির জীবনে ১০ জানুয়ারি চিরস্মরণীয় অনন্য ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২-এর এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ বিজয়ের পরিপূর্ণতা অর্জন করে।
যদিও ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হয়; কিন্তু বাংলার মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। কারণ, যার নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, তিনি তখনও কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি।
যতক্ষণ মহান নেতা ফিরে না এসেছেন, ততক্ষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় ১০ জানুয়ারি, যেদিন জাতির জনক স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে তার স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলায় ফিরে এসেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অক্টোবর মাসে জাতির জনকের ফাঁসির আদেশ হয়; কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয়ী হলে ইয়াহিয়া খান সেই আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানকে অপসারণ করে ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন।
ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে আবেদন করেছিল ‘আমার একটি স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে, সেটি হল শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো, আমাকে সেই সুযোগ দেয়া হোক।’ যে কারণে ভুট্টো মিয়ানওয়ালি কারাগারের জেল সুপার হাবীব আলীর কাছে বার্তা পাঠায় এবং বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে চশমা ব্যারাজস্থ হাবীব আলীর বাসভবনে নিয়ে রাখা হয়।
এরপর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুনয়-বিনয় করে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সম্পর্ক রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করে। বঙ্গবন্ধু ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ভুট্টো ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। পরদিন অর্থাৎ ৯ জানুয়ারি লন্ডনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি প্রদান করেন।
‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলার মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এ মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য অনুরোধ জানাবে।’
পরিশেষে তিনি বলেন, ‘আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ বিবৃতির শেষে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যে আপনার বাংলাদেশে ফিরে যাবেন, সেই দেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপ?’
তখন জাতির জনক উত্তর দিয়েছিলেন ‘আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করব।’
মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ট্রেনিং সমাপ্ত করে শপথ গ্রহণ করতাম এই বলে যে, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আমরা জানি না। কিন্তু যতক্ষণ আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশকে আমরা হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’
১৬ ডিসেম্বর প্রিয় দেশ শত্রুমুক্ত হলেও তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আমরা জানতাম না। যেদিন ৮ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংবাদ জানলাম, সেদিন এক অনির্বচনীয় আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল সারা দেশে।
মানুষের যে কী আনন্দ, তা ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। যেদিন তিনি ফিরে এলেন সেদিনটি ছিল সোমবার। সকাল থেকেই লাখ লাখ মানুষ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে দশদিক মুখরিত করে মিছিল নিয়ে বিমানবন্দর অভিমুখে যাচ্ছে।
রণক্লান্ত যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধা, শ্রদ্ধাবনতচিত্তে সংগ্রামী জনতা, অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে সন্তানহারা জননী, স্বামীহারা পত্নী, পিতৃহারা পুত্র-কন্যা সব দুঃখকে জয় করে স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথা ভুলে গর্বোদ্ধত মস্তকে সবাই অধীর আগ্রহে আজ অপেক্ষমাণ দু’হাত বাড়িয়ে জাতির জনককে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করার জন্য।
ঢাকায় যখন সাজ সাজ রব, তখন সকাল থেকেই দিল্লির রাজপথ ধরে হাজার হাজার মানুষের মিছিল পালাম বিমানবন্দর ও প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দিল্লির জনসাধারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।
বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি শ্রী ভিভিগিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট জেটটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবতরণ করলে তার সম্মানে ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়।
ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর আগেই উপস্থিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ তাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, ‘আপনার জন্য আমি গর্বিত।
ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ আপনার জন্য গর্ব অনুভব করে। শেখ মুজিবকে আমাদের মাঝে পেয়ে ভারতের জনগণ আজ আনন্দে আত্মহারা। শেখ মুজিব তার জনগণকে নতুন জীবনদান করেছেন।
তার স্বাধীনতার স্বপ্ন আজ সার্থক।’ দিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিকালে লাখো মানুষের সমাবেশে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ভারতবাসীর উদ্দেশে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেন, ‘আমার জন্য এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত।
বাংলাদেশে যাওয়ার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী- যিনি কেবল মানুষের নন, মানবতারও নেতা।
তার নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব। এ অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায়। অবশেষে আমি ৯ মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি।’ অভ্যর্থনার আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বঙ্গবন্ধু একান্তে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমি ঋণী।
আপনি আমার বাংলার মানুষকে অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন; আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে আপনি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আপনার কাছে আমরা চিরঋণী।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমার একটি অনুরোধ। আপনি কবে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবেন।’ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মহানুভবতার স্বরে বলেছিলেন, ‘আপনি যেদিন চাইবেন।’
বঙ্গবন্ধু এমন বিচক্ষণ নেতা ছিলেন যে, এরকম একটি অবস্থার মধ্যেও রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যর্পণের বিষয়টি আলাপ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায় করে নেন।
এরপর অবসান ঘটে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশসীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।
দুপুর ১টা ৫১ মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতা, আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারাসহ ছুটে যাই নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে।
আমার হাতে ছিল পুষ্পমাল্য। জাতির জনককে মাল্যভূষিত করার সঙ্গে সঙ্গেই তার সংযমের সব বাঁধ ভেঙে যায়, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত; যা আমার মানসপটে এখনও জ্বলজ্বল করে।
বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তার চোখে তখন স্বজন হারানোর বেদনা-ভারাক্রান্ত অশ্রুর নদী, আর জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়ানো মুখাবয়ব জুড়ে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি।
বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
চারদিক থেকে তার ওপর পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। বাংলাদেশ সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। এ সময় বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণী ওসমানী, লে. কর্নেল শফিউল্লাহ্ এবং বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র লেফটেন্যান্ট শেখ কামাল জাতির জনকের পাশে ছিলেন।
গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতারা, ঢাকাস্থ বিদেশি মিশনের সদস্যরা, মিত্রবাহিনীর পদস্থ সামরিক অফিসার, বাংলাদেশ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে করমর্দন করেন।
এরপর রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যাওয়ার জন্য জাতীয় নেতারাসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষমাণ ট্রাকে উঠে রওনা দেই। সুদৃশ্য তোরণ, বাংলাদেশের পতাকা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত রাজপথের দু’পার্শ্বে দাঁড়ানো জনসমুদ্র পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট পর ময়দানে পৌঁছাই।
ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকাল সাড়ে ৪টা। চারদিকে লাখ লাখ অপেক্ষমাণ জনতা, কোনোদিকে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আবালবৃদ্ধবনিতার মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত।
‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনিতে সবকিছু যেন ডুবে গেল। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে চতুর্দিকে তাকালেন এবং রুমালে মুখ মুছলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেবলই মনে হয়েছে, জাতির জনক জীবনভর এমন একটি দিনের অপেক্ষায়ই ছিলেন। দীর্ঘ কারাবাসের ক্লান্তিতে মলিন মুখটি তবু সমুজ্জ্বল।
উন্নত ললাট, প্রশান্ত বদন, দু’চোখ তখনও অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। সে অবস্থায়ই চিরাচরিত ভঙ্গিতে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে নিবেদন করলেন তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা।
হৃদয়ের সবটুকু অর্ঘ্য ঢেলে আবেগঘন ভাষায় বললেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন নির্জন কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গোনা একজন মানুষ কী করে এরকম উদ্বেলিত পরিস্থিতিতেও স্থির-প্রতিজ্ঞ থেকে বলছেন, ‘ভাইয়েরা, তোমাদেরকে একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। আজকে আমি বলি, আজকে আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে।’
আরও বললেন, ‘সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।’ বক্তৃতায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে।
আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’ ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদান স্মরণ করে বেদনা-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাংলায় আজ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে।
৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বলেন, ‘গত পঁচিশে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে।
একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।’ পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধজননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ লাখ লাখ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ইতিহাসের মহামানব জাতির জনকের বক্তৃতা শুনেছে এবং পরম পরিতৃপ্ত হয়েছে এই ভেবে যে, আজ থেকে আমরা প্রকৃতই স্বাধীন।
সভামঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডির ১৮নং বাড়িতে গেলেন। যেখানে পরিবারের সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। সেই বাড়ির সামনে আরেকটি বাড়ি তখন তার জন্য রাখা হয়েছিল। কেননা ধানমণ্ডির ৩২নং বাসভবনটি শত্রুবাহিনী এমনভাবে তছনছ করে দিয়েছিল যা বসবাসের অনুপযুক্ত ছিল। প্রিয় সহকর্মীদের সঙ্গে ১১ জানুয়ারি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন এবং আবু সাইদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করলেন। ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় তার রাজনৈতিক সচিব করেন। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র।
প্রতি বছরের মতো এবারও আমাদের জাতীয় জীবনে যখন ১০ জানুয়ারি আবার ফিরে এসেছে, তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা বারবার মনে পড়ছে। যে ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন।
যে ভাষণের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্ভবপর হয়েছে। এখন ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত। আমার বিবেচনায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’ তিন মিনিটের লিখিত বক্তৃতা; মার্টিন লুথার কিংয়ের সতেরো মিনিটের লিখিত বক্তৃতা।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু হৃদয়ের গভীরতা থেকে সেদিন ‘ভাইয়েরা আমার’ সম্বোধন করে যে অলিখিত বক্তৃতা করেছিলেন, সেটা বিশ্ববিখ্যাত বক্তৃতা। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আমরা যখন এ ভাষণটি মাইকে প্রচার করতে চাইতাম, স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান আমাদের প্রচার করতে দেয়নি।
পরবর্তীকালেও খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এ ভাষণ প্রচার করতে দেয়নি। সভামঞ্চ ভেঙে মাইক কেড়ে নেয়া হয়েছে; কিন্তু ইতিহাস তার নিজস্ব পথে চলে এবং সত্য কখনও চাপা দেয়া যায় না। ভাবতে আজ বুক ভরে ওঠে সেই ভাষণই আজ বিশ্বে শ্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদা পেয়েছে।
এবার এক নতুন প্রেক্ষাপটে ১০ জানুয়ারি আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। এ বছরটি জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বছরটিকে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে দেশে এবং জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো বিশ্বজুড়ে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। আগামীর বছরগুলো আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা বিগত দিনে গৃহীত সব উন্নয়ন প্রকল্প আগামী দিনগুলোতে দৃশ্যমান হবে এবং দেশের মানুষ তার সুফল ভোগ করবে এবং পূর্বঘোষিত রূপকল্প অনুযায়ী ২০২১-এ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে। চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে নিয়ে যাবেন এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবেন।
জাতির জনকের দুটি স্বপ্ন ছিল- বাংলাদেশ স্বাধীন করা এবং দেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। আমাদের তিনি স্বাধীনতা দিয়েছেন। তার প্রথম স্বপ্ন তিনি পূরণ করেছেন। আরেকটি স্বপ্ন যখন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছিলেন, তখনই বুলেটের আঘাতে সপরিবারে জাতির জনককে হত্যা করা হয়।
জাতির জনককে হারানোর দুঃখের মধ্যে ’৮১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার হাতে আমরা রক্তেভেজা দলীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলাম, সেই পতাকা হাতে নিয়ে নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে আজ তিনি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। প্রতিপক্ষের শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচক-অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে-সামগ্রিকতায় আজ ইতিবাচক অগ্রগতির দিকে ধাবমান।
আমাদের আশা ঘোষিত ‘রূপকল্প’ অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম-আয়ের ডিজিটাল দেশে রূপান্তরিত হবে। বিশ্বব্যাংককে অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে অনন্য-সাধারণ সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে এবং পদ্মাবক্ষে সেই সেতুর অবয়ব এখন দৃশ্যমান।
যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে জাতির জনক পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেন; দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে অর্থনৈতিক সর্বসূচকে এগিয়ে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান এ পাঁচটি সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার আজ মানুষের দোরগোড়ায়। এক সময়ের অন্ধকার গ্রামবাংলা আজ আলোকিত।
পিচঢালা পথ, সেই পথে সশব্দে ছুটে চলছে যাত্রীবাহী বা মালবাহী গাড়ি। ঘরে ঘরে টিভি, ফ্রিজ। পাকা দালান-কোঠা। খালি পায়ে লোকজন চোখে পড়ে না। বাজারগুলো সরগরম। গ্রামীণ জনপদের মানুষের হাতে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা। গ্রামগুলো এখন শহরে রূপান্তরিত হয়েছে।
এসবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং ইতিমধ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ tofailahmed69@gmail.com