শতফুল ফুটতে দাও
ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রচিন্তা আজও কি প্রাসঙ্গিক?
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলামী সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছেন একদল বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদ। তাদের মধ্যে সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যার অবদান বর্তমান শতাব্দীতেও আলোচিত ও প্রশংসিত হয়, তিনি হচ্ছেন ইবনে খালদুন।
তার পুরো নাম আব্দ আল্-রাহমান ইবনে খালদুন। ১৩৩২ সালে তার জন্ম এবং ১৪০৬ সালে মৃত্যু। অর্থাৎ তিনি চতুর্দশ শতাব্দীতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৩৮২ সালে এই আরব মুসলিম পণ্ডিত, যিনি তিউনিশিয়ার শাসকবর্গের দরবারে কাজ করতেন, মক্কায় হজে যাওয়ার জন্য তার নিয়োগকর্তাদের কাছে অনুমতি চাইলেন।
তিনি জাহাজে করে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়াতে পৌঁছান। তার জীবনের ৫০তম বছরে তিনি চিরদিনের জন্য মাগরিবের দেশগুলো ছেড়ে যান। ইসলামী বিশ্বকে দু’ভাগে ভাগ করা হতো। পশ্চিমের ইসলামী দেশগুলোকে বলা হতো মাগরিব এবং পূর্বের ইসলামী দেশগুলোকে বলা হতো মাশরিক। উত্তর আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো ছিল মাগরিবের অন্তর্ভুক্ত।
ইবনে খালদুনের পরিবার দক্ষিণ আরব থেকে স্পেনে গিয়ে সেভিলে বসতি স্থাপন করে। এটা সম্ভব হয়েছিল আরবদের স্পেন বিজয়ের পর। উত্তর স্পেনের খ্রিস্টান রাজারা দক্ষিণ দিকে তাদের রাজ্য সম্প্রসারিত করার পর পরিবারটি তিউনিশিয়ায় গমন করে।
সাংস্কৃতিক দিক থেকে যারা উন্নত ছিল এবং যারা রাষ্ট্রীয় চাকরিতে নিয়োজিত ছিল তারা অনেকেই এ পথের আশ্রয় নেয়। মাগরিবের নগরগুলোয় এরা উচ্চমর্যাদা লাভ করে এবং স্থানীয় শাসকরা তাদের রাজকার্যে নিয়োগ করে।
ইবনে খালদুনের প্রপিতামহ তিউনিশিয়ার রাজদরবারের রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এক সময় রাজার রোষানলে পড়ে নিহত হন। তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করলেও রাজনীতি পরিত্যাগ করেন এবং একজন পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে তার অবসর জীবনযাপন করেন। সেই সময়কার রীতি হিসেবে ইবনে খালদুন যত্নের সঙ্গে তার পিতা এবং অন্য পণ্ডিতবর্গের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন।
এরা তিউনিশের মসজিদ ও বিদ্যালয়ে পাঠদান করতেন। শিক্ষার জন্য তিনি অন্যান্য শহরেও গেছেন। সে সময়কার একটি রীতি ছিল যথাসম্ভব সর্বাধিকসংখ্যক পণ্ডিতদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করা। তিনি তার আত্মজীবনীতে তার শিক্ষকদের নাম উল্লেখ করেছেন, যাদের লেকচার তিনি শুনেছেন এবং যারা বিভিন্ন বিষয় শিখিয়েছেন। শেখার বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল আল কোরআন।
মুসলমানরা বিশ্বাস করে, আল কোরআন হচ্ছে আল্লাহর বাণী যা রাসূল (সা.)-এর মাধ্যমে আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে। হাদিসও ছিল শিক্ষার অন্যতম বিষয়। হাদিস হল রাসূল (সা.)-এর কথা ও কাজের আখ্যান।
ইবনে খালদুন Jurisprudence, অর্থাৎ আইনের বিজ্ঞান, কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে সামাজিক নৈতিকতা এবং আরবি ভাষাও অধ্যয়ন করেছেন। সে কালে আরবি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন না করলে ধর্মীয় বিজ্ঞান বোঝা সম্ভব ছিল না।
এ ছাড়াও তিনি যুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা এবং দর্শনও অধ্যয়ন করেছেন। তিনি সবিস্তারে অনেক ব্যক্তিত্ব এবং তার শিক্ষকদের সম্পর্কে লিখেছেন। তার লেখা থেকে জানা যায় এসব সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক এবং তার পিতা-মাতারা প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিশেষ করে এ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মরণব্যাধি প্লেগ মহামারী আকারে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।
তরুণ বয়সেই ইবনে খালদুন ভাষা এবং আইনের বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এর ফলে তিনি তিউনিশের শাসকের দরবারে চাকরিতে নিযুক্ত হন। প্রথমে সচিব হিসেবে এবং পরবর্তীকালে আরও দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ পান।
মজার ব্যাপার হল, দায়িত্বশীলতার উচ্চতর পর্যায় নিরাপত্তাহীনতারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবনের ২০টি বছর কেটে যায়।
তিনি তিউনিশ ত্যাগ করেন এবং মাগরিবের অন্য শাসকদের অধীনে কাজ করেন। তিনি গ্রানাডায় গমন করেন। গ্রানাডা ছিল স্পেনে টিকে থাকা শেষ মুসলিম রাজ্যের রাজধানী। সেখানে তিনি যথেষ্ট মর্যাদা লাভ করেন এবং তাকে সেভিলের খ্রিস্টান শাসকের কাছে মিশনে পাঠানো হয়। সেভিল ছিল তার পূর্বপুরুষদের শহর।
সেখানে তিনি শাসকদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে পড়েন এবং দ্রুত আলজেরিয়াতে চলে যান। আলজেরিয়ায় এসে তিনি পূর্বাহ্নে সরকারি কাজ করতেন এবং অপরাহ্নে মসজিদে পাঠদান করতেন। তিনি আরব অথবা বার্বার গোত্রপ্রধানদের কাছে টেনে আনেন এবং তিনি যেই শাসকদের অধীনে চাকরি করতেন তাদের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশে উৎসাহিত করেছেন।
এভাবে তিনি ব্যক্তিগত প্রভাব বৃদ্ধিতে সফল হন। তার এ ব্যক্তিগত প্রভাব শাসকদের রোষানলে পতিত হলে খুব কাজে আসত। একবার তিনি ৪ বছর আলজেরিয়ার গ্রামাঞ্চলে এক আরব গ্রোত্রপ্রধানের আশ্রয়ে একটি প্রাসাদে সময় অতিবাহিত করেন।
বস্তুত ওই সময়টা ছিল দুঃসময়। এ সময় তিনি মাগরিবের বিভিন্ন রাজবংশের ইতিহাস রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তবে তিনি এ ইতিহাস রচনা করেছেন একটি বিস্তৃত কাঠামোর মধ্যে।
তার রচিত ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় ‘মুকাদ্দিমা’ নামে পরিচিত। ‘মুকাদ্দিমা’ শব্দটির অর্থ হল পূর্বকথন। মুকাদ্দিমায় ইবনে খালদুন রাজবংশগুলোর উত্থান ও পতনের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। এ যেন এক পরশপাথর। যার সাহায্যে ইতিহাসের বয়ানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বিচার করা সম্ভব। তিনি বিশ্বাস করতেন মানবসমাজের সবচেয়ে প্রাচীন এবং সরলতম জনগোষ্ঠী স্টেপ (Steppes) তৃণভূমি অঞ্চলে এবং পার্বত্য অঞ্চলগুলোয় বসবাস করত।
তারা ফসল ফলাত এবং গবাদিপশু পালন করত। তারা এমন সব নেতাকে মান্য করত যাদের ছিল বল প্রয়োগের সংগঠিত ক্ষমতা। এসব জনগোষ্ঠীর স্বভাবজাত কারণে কিছু ভালো গুণ এবং শক্তিমত্তা ছিল, কিন্তু তারা নিজেরা কোনো স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে পারত না,গড়ে তুলতে পারত না শহর-নগর অথবা উঁচুমানের সংস্কৃতি। এগুলো সম্ভব করার জন্য প্রয়োজন ছিল একজন শাসকের, যার থাকবে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব।
এ রকম একজন শাসক প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন যদি তিনি একদল অনুসারী সৃষ্টি করে তাদের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে পারতেন। এ রকম অনুসারীদের ইবনে খালদুন নাম দিয়েছেন আসাবিয়া। এ আসাবিয়ার মধ্যে থাকবে একটি কর্পোরেট স্পিরিট। এ স্পিরিটের লক্ষ্য হল ক্ষমতা অর্জন ও সংরক্ষণ। এ ধরনের গ্রুপ তৈরি করা সম্ভব।
স্টেপ কিংবা পার্বত্যাঞ্চলের বল ও শক্তিসমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী থেকে আসাবিয়া সৃষ্টি করা সম্ভব। এ রকম জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য অভিন্ন পূর্বপুরুষের দোহাই পাড়া হতো। অভিন্ন পূর্বপুরুষের বিষয়টি হয়তো ছিল বাস্তব অথবা কাল্পনিক।
এদের গোষ্ঠীবদ্ধ থাকার আরও কারণ ছিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। এ নির্ভরশীলতা আরও জোরদার হয়েছে সবাই মিলে একই ধর্ম গ্রহণ করার ফলে। এ রকম সু-সমন্বিত অনুসারীর দল থাকলে একজন শাসকের পক্ষে বংশানুক্রমিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে মনে করতেন ইবনে খালদুন।
এ রকম একজন শাসক থাকলে বিশেষায়িত কারুকাজ, হস্তশিল্প এবং বিলাসবহুল জীবনযাত্রা সংবলিত স্থিতিশীল জনবহুল নগরী গড়ে উঠতে পারে। শহর নগর গড়ে ওঠা সম্পর্কে ইবনে খালদুনের যে চিন্তা-ভাবনা ছিল সে চিন্তা-ভাবনার ফলে ইবনে খালদুন একজন নগর-সমাজতত্ত্ববিদ হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন।
প্রত্যেক রাজবংশ তা যতই চোখধাঁধানো হোক না কেন, তার নিজের মধ্যেই তার ধ্বংসের বীজ ধারণ করে। এ ধ্বংস আসতে পারে অত্যাচার-অবিচারের ফলে, অপচয় ও ভোগবিলাসের ফলে এবং নেতৃত্বগুণ হারিয়ে ফেলার ফলে।
এর ফলে শাসকের ক্ষমতা তার নিজস্ব দলের অন্য কোনো সদস্যের হাতে চলে যেতে পারে। কিন্তু শিগগিরই হোক কিংবা একটু পরেই হোক, এক রাজবংশের পরিবর্তে আরেকটি রাজবংশ একইভাবে গড়ে উঠতে পারে।
এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে শুধু শাসকের অপসারণই হয় না, তার সঙ্গে যে পুরো গোষ্ঠীর ওপর ভিত্তি করে তার ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছিল তাদেরও বিদায় নিতে হয়। তারা যে ধরনের জীবনযাপন পদ্ধতি বা চালচলনের প্রবর্তন করেছিল তারও অবসান ঘটে।
ইবনে খালদুন ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে বলেছেন, 'When there is a general change of conditions, it is as if the entire creation had changed and the whole world been altered'. এক সময় গ্রিক ও পার্শিয়ানরা বিশাল ক্ষমতাধর শক্তি ছিল। তাদের জায়গায় এসেছে আরবরা।
আরবদের শক্তি ও সংহতি এমন একটি রাজবংশের জন্ম দেয় যার বিস্তৃতি ছিল আরব থেকে স্পেন পর্যন্ত। কিন্তু তাদের হটিয়ে স্পেনে এবং মাগরিবে বার্বাররা ক্ষমতায় আসে এবং আরও পূর্ব দিকে তুর্কিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
শাসকদের সৌভাগ্যের পরিবর্তনে এ পালায় তাদের ভৃত্যদেরও ভাগ্যে পরিবর্তন ঘটে। ইবনে খালদুন যখন আলেকজান্দ্রিয়া ছেড়ে যান তখন তিনি একটি নতুন কর্মজীবন শুরু করতে যাচ্ছিলেন। সেবার তিনি হজব্রত পালন করেননি এবং হজ না করে কায়রোতে চলে যান। অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি হজ করেছিলেন।
কায়রো দেখার পর নগর ও নগর জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। কায়রো দেখে তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়ে যান। কারণ কায়রো ছিল ভিন্ন মাত্রার এক নগরী। একে বলা যায় বিশ্বের মেট্রোপোলিস, বিশ্বের বাগিচা, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ঘনবসতি, ইসলামের পীঠস্থান এবং ক্ষমতার আসন।
কায়রো ছিল মামলুক সুলতানাতের রাজধানী। ওই সময়কার মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মামলুক সুলতানাতের রাষ্ট্রটি ছিল অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র। এর বিস্তার ছিল মিসর ও সিরিয়াজুড়ে। ইবনে খালদুনকে সুলতানের দরবারে হাজির করা হয়।
সুলতান তাকে অনুগ্রহ করেন এবং প্রথমে তিনি একটি পেনশন পান এবং পরবর্তীকালে একজন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি এর পর একটি রাজকীয় স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান এবং তার পরিবারের সদস্যরা তিউনিশ থেকে কায়রো আসার সমুদ্রপথে জাহাজ ডুবে সবাই মৃত্যুবরণ করেন। ইবনে খালদুন মৃত্যু পর্যন্ত কায়রোতে অবস্থান করেন। অধিকাংশ সময় তিনি লেখাপড়া করে অতিবাহিত করেছেন।
কায়রোর জীবনেও তিনি সময়ান্তরে প্রভাব-প্রতিপত্তি যেমন অর্জন করেছেন তেমনি ক্ষমতাবানদের রোষানলেও পড়েছেন। এর জন্য তিনি তার শত্রুদের দায়ী করলেও তার নিজের ব্যক্তিত্বও কম দায়ী ছিল না। শাসক তাকে একটি প্রধান আদালতে কয়েকবার বিচারক নিয়োগ করলেও হয় তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেন অথবা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তিনি সুলতানের সঙ্গে সিরিয়া গমন করেন এবং জেরুজালেম ও হেবরনের পবিত্র স্থানগুলো দর্শন করেন। দ্বিতীয়বার যখন তিনি সেখানে যান তখন দামেস্ক তৈমুর লংয়ের অবরোধে অবরুদ্ধ।
তৈমুর ছিলেন এশিয়ার একজন বিখ্যাত বিজয়ী বীর, যার সাম্রাজ্য উত্তর ভারত থেকে সিরিয়া এবং আনাতলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইবনে খালদুন তৈমুরের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তৈমুরকে দেখে তার মনে হয়েছিল তৈমুরের হুকুম কায়েম করার বিশাল ক্ষমতা রয়েছে।
এ ক্ষমতা তার সেনাবাহিনী এবং জনগোষ্ঠীর ওপর নিরাপদভাবে প্রতিষ্ঠিত। এ ক্ষমতা দিয়ে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল। ইবনে খালদুন দামেস্ককে তৈমুরের লুণ্ঠন থেকে রক্ষা করতে পারেননি। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মিসরে ফিরে আসার অনুমতি লাভ করেন। পথিমধ্যে ফিলিস্তিনের পাহাড়ে ডাকাতরা তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে।
ইবনে খালদুনের জীবন থেকে আমরা জানতে পারি তিনি কেমন দুনিয়ার মানুষ ছিলেন। এ দুনিয়া ছিল মানবিক প্রচেষ্টার ভঙ্গুরতার দৃষ্টান্ত। তার নিজের কর্মজীবন দেখিয়েছে স্বার্থের জন্য মিত্রতা কত অস্থিতিশীল।
অথচ এ অস্থিতিশীল স্বার্থের মিত্রতার ওপরই নির্ভর করে রাজবংশগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। দামেস্কে তৈমুরের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ইবনে খালদুন বুঝতে পারেন নতুন শক্তির অভ্যুদয় কীভাবে নগর ও নাগরিকদের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।
নগরীর বাইরে শৃঙ্খলা প্রায় ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছে যায়। একজন শাসকের দূত সেখানে নিহত হতে পারেন এবং যে রাজকর্মচারী শাসকের কৃপা দৃষ্টি হারিয়েছেন তিনি নগরীর বাইরে এসে শাসকের নিয়ন্ত্রণেরও বাইরে চলে যেতে পারেন এবং আশ্রয় খুঁজে পেতে পারেন।
ইবনে খালদুনের আসাবিয়াতত্ত্ব আমাদের কী শিক্ষা দেয়? শুরুর দিকে আসাবিয়ার শক্তি শাসককে অপ্রতিরোধ্য রূপ দান করলেও যতই সময় যেতে থাকে ততই শাসকরা অত্যাচার-অবিচারের জন্য জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এমনকি আসাবিয়ার অভ্যন্তরেও সংঘাত দেখা দেয় এবং এর মধ্য থেকে ভিন্ন কেউ বিদ্যমান শাসকের শাসনক্ষমতা কেড়ে নিতে পারে অথবা সম্পূর্ণ নতুনভাবে গড়ে ওঠা আসাবিয়ার শক্তিতে ভিন্ন ধরনের কোনো রাজশক্তি গড়ে উঠতে পারে।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আমরা ‘রাজশক্তি’ শব্দটির পরিবর্তে শাসক-মহল শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। লেনিন বিপ্লব কখন সফল হয় তার শর্ত নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন, (ক) জনগণ থেকে শাসকগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতা; (খ) শাসকগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত; এবং (গ) পুরাতন শাসকদের পরিবর্তে নতুনভাবে শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে এমন সংগঠিত শক্তির অস্তিত্ব।
দেখা যাচ্ছে, চতুর্দশ শতাব্দীর ইবনে খালদুনের সঙ্গে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর লেনিনের কত মিল। এ দেশে যারা ক্ষমতাচর্চা করেন তারা ক্ষমতার ব্যাকরণ বুঝে নিতে পারেন ইবনে খালদুন অথবা লেনিনের কাছ থেকে। কথায় বলে, আকলমান্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ