রাজাকারের তালিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন

ডা. জাহেদ উর রহমান
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাজাকারের তালিকা। প্রতীকী ছবি
রাজাকারের তালিকা নিয়ে ডামাডোল থিতিয়ে এসেছে অনেকটা। তুমুল সমালোচনার মুখে তালিকাটা স্থগিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও দুঃখ প্রকাশ করেছেন এজন্য। কিন্তু সেটা হলেও এ তালিকা নামের কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অনেক সাপ, সেগুলো দেখে নেয়া জরুরি।
তালিকাটা আমাদের সামনে আসে এক বিতর্কের সূত্র ধরে; কিন্তু বিতর্কটার সুরাহা হয়েছে কি? মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচিত বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত বেশকিছু মানুষের নাম এসেছে এ তালিকায়। তার মানে আমরা কি এটি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, এ দেশে একটা সঠিক ত্র“টিমুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করা হয়েছে? মোটেও না।
আদৌ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, এমন বহু মানুষের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আছে, এরকম খবর আমরা অহরহ দেখি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ৫-৭ বছর ছিল এমন মানুষের নামও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় থাকার খবরও আমরা পত্রিকায় পেয়েছি।
তাই যাদের নাম তালিকায় আসা নিয়ে এ বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তারা মুক্তিযোদ্ধা হতেই পারেন; কিন্তু এ দেশে এ সময় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম আছে এটি কারও রাজাকার না হওয়ার যুক্তি হতে পারে না।
এ তালিকা নিয়ে চরম বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল শুরুতেই- তালিকায় থাকা নামগুলোর সূত্র আসলে কী? রাজাকারের তালিকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আমাদের জানান, ‘আমরা নিজেরা কোনো তালিকা প্রস্তুত করিনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যে তালিকা করেছে, আমরা শুধু তা প্রকাশ করেছি।
সেখানে কার নাম আছে, আর কার নাম নেই, সেটা আমরা বলতে পারব না।’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে স্পষ্ট করা দরকার ছিল, কোন ভিত্তিতে তিনি এ দাবি করেছেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। পরবর্তী আলোচনার আগে এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলেছেন, তা আবার পড়ে নেয়া যাক।
তিনি বলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকারের লিস্ট করবে। আমাদের কাছে তারা চিঠি পাঠিয়েছিল, আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে সেগুলো যেন পাঠানো হয়। রাজাকারের লিস্ট তৈরি করা দুরূহ ব্যাপার। আমরা প্রাথমিকভাবে দালাল আইনে যাদের নামে মামলা হয়েছিল, সেই দালাল আইনের লিস্টটা পাঠিয়েছি।’
এ মন্তব্যের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আরও কিছু কথা ছিল, সেটা পরবর্তীকালে প্রসঙ্গক্রমে আসবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা যদি সঠিক হয়, তাহলে দালাল আইনে মামলা তো পাকিস্তানিরা করেনি, করেছে বাংলাদেশ সরকার।
তাহলে ‘এই তালিকা পাকিস্তানিরা করে গেছে’- মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর এ দাবি সঠিক নয়। আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী সঠিক হলে বেঠিক বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সমস্যা একটা পর্যায়ে বাড়তে থাকে; জানা যায়, এ তালিকায় ৩০-এর বেশি নারী, প্রায় ১০০ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং রাজশাহী, বরগুনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম এসেছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে পরিচিত।
এসেছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার নামও। মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী এরপর জানান, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে তালিকা পেয়েছি, হুবহু তা প্রকাশ করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সে সময়ের সরকারি রেকর্ড দিয়েছে, নতুন তালিকা করেনি।’
তার এ মন্তব্য তার আগের মন্তব্যটাকে মিথ্যে প্রমাণ করে। কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছে দালাল আইনে হওয়া মামলার তালিকা। তাহলে প্রথমে পাকিস্তানিদের করা তালিকা বলা সঠিক নয়।
রাজাকারের তালিকার মতো স্পর্শকাতর একটা বিষয় কী পরিমাণ অবহেলার সঙ্গে করা হয়েছে, সেটা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের আচরণে দেখা যায়। তালিকার সব ভুলের দায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী যেহেতু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর দিয়ে দিয়েছিলেন, তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবার যেটা বললেন তাতে বেরিয়ে পড়ল আরেক অবিশ্বাস্য বিষয়।
তাদের পাঠানো তালিকার সঙ্গে একটা নোট দিয়েছিলেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো নোটটি ভালোভাবে আমলে নিলে এমন পরিস্থিতি হতো না। আসলে নোটটি আমলে নেয়া তো দূরের কথা, পড়েও দেখা হয়নি।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আসলেই একটা নোট পাঠানো হয়েছিল, যার কপি আমরা পত্রিকায় দেখেছি।
এরপর আবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রীর বয়ানে জানি, আগেভাগে ফাঁস হয়ে যেতে পারে এ ভয়ে তিনি নিজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আসা পেন ড্রাইভটি নিজের কাছে আগলে রেখেছিলেন এবং এরপর সেটা তিনি নিজেই প্রকাশ করেন।
মানে এমন একজন মানুষ একটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন, যিনি আরেক মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো একটা গুরুত্বপূর্ণ নোট পড়ে দেখার প্রয়োজনই বোধ করেননি। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, ‘প্রথা অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লেখা নোটটি সচিবের দফতরে এলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না।
কারণ, আমরা নোটটি পড়তাম। নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতাম।’ তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী অতি বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা থেকেই হয়তো কাউকে কিছু শেয়ার করেননি।’
পাকিস্তানিদের তালিকাভুক্ত অথবা ভাতাপ্রাপ্ত রাজাকারদের তালিকা তুলনামূলকভাবে বেশি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারত। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত তালিকা জেলা প্রশাসকদের কাছে চাওয়া হয়েছিল। মন্ত্রী বলেন, সেই সময় ১৯টি জেলা ছিল। জেলা প্রশাসকদের বলা হয়েছে ওই সময়ে তাদের রেকর্ড রুমের তালিকা দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য।
দুঃখজনক হল সেভাবে আমরা সহযোগিতা পাইনি। এ তালিকাবিষয়ক ঘটনা আরেকটা বিষয় স্পষ্ট করল, প্রশাসনের মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এমন একটা বিষয়েও একজন মন্ত্রীর চাহিদা পূরণ করেন না, যেটা করার সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নেয়া হয়েছিল।
জনগণের ম্যান্ডেট না থাকার পরও বারবার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সরকার প্রশাসনের ওপর চরমভাবে নির্ভর করার ফলে এমনটা হয়ে থাকতে পারে।
এ তালিকা তৈরিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ৬০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল এমন একটা খবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পত্রিকায় (যেনতেন অনলাইন পোর্টাল নয়) এসেছিল। এরপর এটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চরম শোরগোল শুরু হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন তথ্য অস্বীকার করেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, ৬০ কোটি কেন, ৬০ পয়সাও খরচ হয়নি এ তালিকা প্রস্তুত করতে। কোনো রকম তথ্য ছাড়া একজন মন্ত্রীর নামে এমন অসত্য তথ্য কীভাবে ছড়াতে পারে? তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে যখন এত ক্যামেরা, এত রেকর্ডিং ডিভাইস চারদিকে, তখন বহুযুগ আগের মতো এসব কথা বলার সুযোগ কতটা আছে?
তথাকথিত রাজাকারের এ তালিকায় যদি কিছু তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ এবং বেশকিছু নারীর নাম না থাকত, তাহলে হয়তো এ তালিকা নিয়ে শোরগোল হতো না। মানুষ এ তালিকা মেনে নিত সম্ভবত।
কিন্তু আমরা কি এটি তলিয়ে দেখছি, কোনো রকম আইনি প্রক্রিয়া শেষ না করে কিছু অভিযুক্ত মানুষকে রাজাকারের মতো এত ভয়ংকর তকমা দিয়ে দিচ্ছি? এটি আইনগত এবং নৈতিকভাবে ভীষণ বড় ভুল। কেউ কেউ বলছেন, বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাছ থেকে নাম নিয়ে এ তালিকা করা উচিত।
বর্তমানে যখন নানা ইস্যুতে জাতিকে বিভাজিত করে ফেলা হয়েছে, যখন একজন সেক্টর কমান্ডার এবং বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্তকে রাজাকার বলা হয় সরকারি দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে, তখন এ তালিকা এভাবে করা আরও নতুন জটিলতা তৈরি করতেই পারে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে এ তালিকা প্রণয়ন।
বহু রাজাকার এখনও বেঁচে আছে। যেসব রাজাকার বেঁচে নেই তাদের পরিবারের সদস্যরা আছেন এ পৃথিবীতে। এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নানা রকম অপকর্ম করেছে সেই মানুষের কথা আমাদের জানা দরকার, সন্দেহ নেই।
কিন্তু আমরা ভুলে যাই এ অভিযোগটা একটা ভয়ংকর অভিযোগ। মুক্তিযোদ্ধা নন কিংবা রাজাকার ছিলেন এমন কোনো মানুষের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আসা অন্যায়, কিন্তু এটি বিপর্যয়কর নয়। কিন্তু একজন মানুষ যিনি রাজাকার ছিলেন না, তার নাম রাজাকারের তালিকায় আসা বীভৎস ব্যাপার।
শুধু দালাল আইনে অভিযুক্ত মানুষ, কিংবা বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দেয়া তালিকা থেকে নাম নিয়ে প্রকাশ করে দিলেই সেটা একটা সত্যিকারের রাজাকারের তালিকা হয়ে উঠবে- এটা কোনোভাবেই বলা যায় না। এভাবে যেনতেন একটা তালিকা করাটা অনৈতিক, বেআইনি।
শেষ করছি ব্রিটিশ আইনবিদ উইলিয়াম ব্ল্যাকস্টোনের বিখ্যাত উক্তিটি দিয়ে, যেটা আমরা অনেকেই জানি। এটা ব্ল্যাকস্টোন’স রেশিও বলে পরিচিত- ‘আইনের দ্বারা একজন নির্দোষ ব্যক্তি ভুক্তভোগী হওয়ার চেয়ে দশজন দোষী ব্যক্তির মুক্তি পাওয়া অনেক ভালো।’
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট