Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাড়িওয়ালার রাজা-প্রজা

Icon

প্রণব মজুমদার

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাড়িওয়ালার রাজা-প্রজা

বাড়িওয়ালা নিজেরাই রাজা। বিশেষ করে ঢাকা শহরে। তবে বাড়িওয়ালাদেরও রাজা আছে। কে সেই রাজা? অবশ্যই ভূমির খাজনা গ্রহীতা বা বাড়ি থেকে আয়ের কর গ্রহীতা। সেটা হোক ভূমি অফিস কিংবা সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা অথবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

মহানগরে বাড়িওয়ালাদের রাজার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। সে রাজা হল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর। বাড়িওয়ালাদের রাজা যেহেতু আছে, প্রজাও আছে নিশ্চয়ই। কে সেই প্রজা? আমরা যারা ভাড়াবাড়িতে থাকি, অসহায় ভাড়াটিয়ারাই বাড়িওয়ালাদের প্রজা।

এ বাড়িওয়ালাদের খুব দাপট। দুর্ভাগ্য যে, যাদের অর্থে তাদের বিত্তবাসনা, সে অর্থদাতা প্রজারা তাদের চোখে ‘মিসকিন’। আশা করি, সে কথা সবাই স্বীকার করবেন।

নগরকেন্দ্রিক বাড়িওয়ালাদের গর্জন শুনতে পায় দেশের জনগণ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বাড়িওয়ালাদের খোঁজেও। যারা বাড়ি ভাড়া দিয়ে আয় করেন, সঠিকভাবে আয়কর দিচ্ছেন কিনা, তা খতিয়ে দেখতেই এ উদ্যোগ ২০১৬ থেকে। বাড়ি, অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এনবিআর কর্মকর্তা ও পরিদর্শকরা খোঁজখবর নিচ্ছেন।

মূলত কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) রয়েছে কিনা, সেই খোঁজখবরও নেয়া হচ্ছে। টিআইএন না থাকলে তা গ্রহণের জন্য নোটিশও দেয়া হচ্ছে। মূলত দু’ভাবে বাড়িওয়ালাদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এনবিআর কর্মকর্তা বা পরিদর্শকরা সশরীরে বিভিন্ন এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন।

আবার সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, ডেসা, ডেসকো, তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলগুলো। সেখান থেকে তথ্য জেনে বাড়িওয়ালা চিহ্নিত করা হচ্ছে।

২০২০ সালের মধ্যে টিআইএনধারীর সংখ্যা কোটিতে উন্নীত করতে চায় এনবিআরের আয়কর বিভাগ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুয়ায়ী, কিছুদিন আগেও ৩৫ লাখ টিআইএনধারী ছিল।

কিন্তু এনবিআর সদ্যসমাপ্ত সময়ে আদায় করতে পেরেছে অর্ধেকের একটু বেশি করদাতার আয়কর। নতুন টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়াতে বাড়িওয়ালাদের করজালে আনার উদ্যোগের বিকল্প নেই।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন দেশব্যাপী করমেলার সময় সাংবাদিকদের কাছে বাড়িওয়ালাদের দীর্ঘদিনের কর ফাঁকির বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। তিনি সে সময় বলেছিলেন, কর শনাক্তকারী নম্বর বা টিন নেই এমন বাড়িওয়ালার সংখ্যা ৭৩ হাজার।

বাড়িওয়ালারা রাজার নজরদারিতে পুরোপুরি নেই কেন? জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সঠিক উত্তর দিতে পারবে না। কারণ আগেও কর পরিদর্শক বা কর্মকর্তাদের জালে তারা আবদ্ধ ছিলেন। তবে নজরদারির ফলে কর নামক প্যাকেট সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তার পকেটে ঢুকত।

কর বিভাগে নিয়োজিত অসাধু কর্মকর্তাদের সমঝোতামূলক ব্যবস্থায় মহানগরীর বাড়িওয়ালারা যে মহারাজা, সে কথা শুধু এনবিআর কেন, প্রায় সবাই জানেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়িওয়ালারা ভাড়ার টাকা নেয়ার সময় ভাড়াটিয়াকে রসিদ দেন না। এতে অর্থ লেনদেনের কোনো দালিলিক প্রমাণ থাকে না।

বছর শেষে বহু বাড়িওয়ালা তার বার্ষিক আয়কর বিবরণী দাখিলের সময় বাড়ি ভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয় গোপন করে থাকেন। যারা এ আয় প্রদর্শন করেন, তারা ভাড়া বাবদ কম আয় দেখান। ফলে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়।

বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া এবং কর বিভাগের কর্মকর্তারা কী করেন। শুনুন, সংক্ষেপে বলছি। রাজধানীর একজন অসহায় ভাড়াটিয়া আমি। রাজধানীর বাসিন্দা হিসেবে বর্তমান বাসাটি আমার সপ্তম। ব্যস্ত কর্মজীবনের কারণে বাসায় কমই থাকা হয়। পরিবারের নির্ঝঞ্ঝাট থাকার জন্য নগরে সমস্যাহীন বাসা! সে তো দুরাশা।

স্ত্রী কন্যাসহ ৩ সদস্য পরিবারের জন্য ভালো বাসা খুঁজতে গিয়ে পেলাম চকচকে এক বাসা। চকচক করলে যে সোনা হয় না, তা বুঝলাম এ বাসায় উঠে। ৫ কক্ষবিশিষ্ট ৬ তলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় আমাদের বসবাস। বাড়িটি অসম্পূর্ণ।

সিঁড়ির ঠিকমতো সিমেন্ট নেই, রেলিং নেই, বারান্দার জানালা নেই, সম্পূর্ণ ইমারতের সিমেন্টের আস্তর নেই। অথচ ঘরের ভেতরের মেঝ সম্পূর্ণ শুভ্র টাইলসে সজ্জিত যা চকচক করে। ভাড়াটিয়াদের পানি ঠিকমতো দেয়া হয় না। ‘মিসকিন’ ভাড়াটিয়ার ছাদে ওঠা বারণ, ভঙ্গুর কোনো কিছু মেরামত করে দেয়া হয় না, ভাঙা জানালা দিয়ে বর্ষায় জল আসে।

এসব সমস্যাতো আছেই। কেন এমন অসম্পূর্ণ প্রাসাদ? অথচ ৮ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত এ বাড়িটির আয়করের জন্য কেউ আসে না! কেন? সে উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানলাম অনেক তথ্য। অসম্পূর্ণ বাড়ির ভাড়া নাকি আয়করমুক্ত। তাছাড়া কর বিভাগের কর্তাদের সঙ্গে নাকি তার যোগাযোগ আছে, বললেন আমার বাড়িওয়ালা। অথচ প্রতি মাসে ভাড়ার রসিদ চাইলে বলেন অসুবিধা আছে। কী অসুবিধা? ‘এত কথা বলা যাবে না! পছন্দ না হলে বাড়ি ছেড়ে দিন’।

আগে যে বাসাটিতে থাকতাম, ৬ বছরে ঠিকাদারি ব্যবসা করে কোটিপতি ৪২ বছর বয়সী সেই বাড়িওয়ালার প্রায় সব সংযোগই ছিল অবৈধ। নিচতলায় থাকতাম বলে কাপড়-চোপড় রোদে শুকাতে সমস্যা হতো বেশ। একদিন গিন্নি কাঁথা শুকাতে ছাদে যাবেন স্থির করলেন। বাধা দিলেন তিনতলায় বসবাসরত বাড়িওয়ালার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। বললেন, ভাড়াটিয়াদের ছাদে ওঠা নিষেধ! এ ভাইয়ের বাসায় ব্যবহৃত এসির সংযোগ ছিল আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত মিটারের সঙ্গে। বিদ্যুতের সংযোগ সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে বাড়িওয়ালার নিজস্ব বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির শরণাপন্ন হতে হতো। একদিন চুপেচাপে নিকটাত্মীয় মিস্ত্রির মাধ্যমে পরীক্ষা করে জানতে পারি আমাদের অর্থে বাড়িওয়ালার এ ভাইয়ের আরামে থাকার রহস্যটি। শত বছরের পুরনো এ বাড়ি থেকেও বাড়ি ভাড়ার আয় সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। কেয়ারটেকার জানান, একজন কর পরিদর্শক নাকি মাঝেমাঝে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করে যান। আয়কর দেয়ার ক্ষেত্রে রাজধানীর বাড়িওয়ালা প্রায় সবারই নাকি এমন ব্যবস্থা।

কর ও শুল্ক বিভাগে অতীতে কাজ করেছেন ও বর্তমানে করছেন যারা, তারা কম বিত্তবান নন! কর-জিডিপি অনুপাতে তলানিতে আমরা। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ নেপাল, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো। দেশে রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

কর-জিডিপির হার কম থাকার পেছনে অনিয়ম-দুর্নীতিকে বড় করে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিষ্ঠানটি ক’মাস আগে নিবিড় গবেষণা করে। গবেষণার ফল হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে এক চিঠিতে দুদক বলেছে, অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করতে পারলে বছরে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব, যা দেশের জিডিপির ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে।

বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও বলেছেন, কর রাজম্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া তখনই সম্ভব, যখন কর রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করা যাবে।

রাজস্ব আদায়ের কাজে নিয়োজিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি কোষাগারের ন্যায্য পাওনা না নিয়ে ব্যক্তি পকেট ভারি করেন। এটা নতুন কোনো তথ্য নয়। জবাবদিহিতার কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন যা করেন, প্রায় বেশিরভাগ সম্পদই করছেন স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের নামে।

তাছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়কর নীতি এতটাই জটিল করে রাখে যাতে করে আয়করদাতা তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন। আয়কর আইনজীবীর সংখ্যাও সেজন্য বাড়ছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের সময় নিজের এবং পরিবারের সবার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিয়েছিলেন। বিদায়ের সময়ও তাই করেছিলেন তিনি। যদিও সহকর্মীদের দিয়ে তিনি তা করাতে পারেননি।

পরিবারসহ নিজের এবং একইভাবে সহকর্মীদের ক্ষেত্রে এ কাজটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যানও করতে পারেন। সময় ফুরিয়ে যায়নি। আয়কর ফাঁকি রোধে অন্তর্নিহিত সমস্যাটির সমাধান হতে পারে। প্রান্তিকভাবে না হোক ৬ মাস অন্তর নিজের এবং সহকর্মীদের সম্পদের হিসাব নেয়া হোক। তাতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে।

নগর-মহানগরে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত অসম্পূর্ণ বাড়িকে পুরোপুরিভাবে করজালে আনা জরুরি। করের আওতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অস্বচ্ছতা দূর করলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে নিঃসন্দেহে। ফলে বাড়িওয়ালার রাজা বলে খ্যাত প্রতিষ্ঠানকে সবাই সমীহ করবে। যারা আইন এবং শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে তারাই তো রাজা। হোক তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কিংবা বাড়িওয়ালা বা ভাড়াটিয়া।

প্রণব মজুমদার : গল্পকার, কবি ও সাংবাদিক

reporterpranab@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম